Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল

| প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হানিফ ফ্লাইওভারে ৭টি বাস স্টপেজ
গাড়ি থামাতে ব্যারিকেড : বেড়েই চলেছে দুর্ঘটনা : জানুয়ারিতে নিহত ৪ আহত ১৫ গত বছরে নিহত ১২ আহত ৪৮
নূরুল ইসলাম : ঢাকার মেয়র  মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি থামতে বাধ্য করা হচ্ছে। ওঠানামার জন্য বানানো হয়েছে তিনটি ইস্পাতের সিঁড়ি। ফ্লাইওভারের ওপরই বাস থামছে, চলছে যাত্রী ওঠানামা। চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন পথচারীরা। এতে করে ফ্লাইওভারের উপরে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত মাসে ফ্লাইওভারের উপরে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪ জন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৫ জন। গত বছর ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১২ জন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৮ জন। এই পরিসংখ্যান বলছে ফ্লাইওভারে সিঁড়ি লাগানো ও বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার কারণে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। যদিও ফ্লাইওভার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের দাবি, পথচারীদের ‘সুবিধার জন্যই’ তারা ওই সিঁড়ি বানিয়ে দিয়েছে। নকশাবহির্ভূত ওই সব সিঁড়ির কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকির জন্য সেগুলো ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। ফ্লাইওভারে বাস থামানো বন্ধ এবং সিঁড়ি অপসারণের আরজি জানিয়ে গত সপ্তাহে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন একজন আইনজীবী। হাইকোর্ট সেই রিট খারিজ করে দিয়েছেন। দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে সড়ক থেকে ফ্লাইওভারের ওপর এ ধরনের সিঁড়ি তুলে দেয়ার নজির নেই। তিনি বলেন, এতে যাত্রী ও পথচারীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। ফ্লাইওভারে সবসময় গাড়ি চলে দ্রুতগতিতে। এখানে যাত্রীরা নেমে রাস্তা পারাপার হতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। ফ্লাইওভারে সংঘটিত দুর্ঘটনার বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিছুর রহমান বলেন, ইদানীং প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় পথচারীকে চাপা দিয়ে দ্রুতগতিতে গাড়িগুলো চলে যায়, সেই গাড়িকে শনাক্ত করা আর সম্ভব হয় না।
সরেজমিন দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের দু’দিকের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ির গতি কমাতে বাধ্য করা হচ্ছে। আড়াআড়িভাবে স্থাপিত হলুদ রঙের ব্যারিকেড অতিক্রম করতে গিয়ে কোনো কোনো গাড়ি আচমকা ব্রেক কষে থামছে। যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের দিকে আসতে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার উপরে রয়েছে বাস স্টপেজ। এর কিছুদূর আগে দেয়া হয়েছে ব্যারিকেড। সেগুলো অতিক্রম করতে গিয়ে গাড়িগুলোকে আঁকাবাঁকা হতে হচ্ছে। গতি কমাতে বাধ্য হচ্ছে গাড়ির চালকরা। এর কিছু সামনে বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায় যানজট লেগেই আছে। এতে করে প্রায় সব গাড়িই কয়েক মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে থাকছে।
একইভাবে গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে যেতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পরে বসানো হয়েছে ব্যারিকেড। এর কিছু দূরে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার উপরে ডেমরার রাস্তার মুখে বাস ও টেম্পো দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। সেখানেও যানজট লেগেই আছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের দিকে আসতে ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়ে যানজট, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার উপরে যানজট, এরপর গুলিস্তান বা ঢাকা মেডিক্যালে নামতে গিয়ে ভয়াবহ যানজটে পড়ছে গাড়িগুলো। দ্রুতগামী যানবাহনের সামনে দিয়েই ফ্লাইওভারের ওপর রাস্তা পার হচ্ছেন যাত্রীরা। যাত্রী ওঠানামার জন্য ফ্লাইওভারের ডেমরা র‌্যাম্প ও দোলাইরপাড় র‌্যাম্পে দু’টি এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ফ্লাইওভারে ওঠার র‌্যাম্পে একটি স্টিলের সিঁড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে,  টিকাটুলী অংশে সড়ক বিভাজকের একটি অংশ ফাঁকা রাখা হয়েছে যাত্রীদের পারাপারের জন্য। পথচারী পারাপারে ফ্লাইওভারের ওপর নিরাপত্তাকর্মীরা সঙ্কেত দিয়ে যানবাহন থামিয়ে দিচ্ছেন। ডেমরা র‌্যাম্প লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে গুলিস্তান থেকে এসে যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার যাত্রীরা নামেন। দোলাইরপাড় র‌্যাম্প দিয়ে ফ্লাইওভারে ওঠেন গুলিস্তানগামী যাত্রীরা। বিভিন্ন এলাকা থেকে সায়েদাবাদে এসে ফ্লাইওভারের ওপর নেমে রাস্তা পার হয়ে তারপর টার্মিনালে যান অনেকে। সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে যাত্রীরা ফ্লাইওভারে উঠে বাস ধরেন। আবার অনেকে সায়েদাবাদ থেকে বাস ধরতেও ফ্লাইওভারের সিঁড়ি ব্যবহার করেন। মতিঝিল, টিকাটুলি, হাটখোলা এলাকায় আসা-যাওয়ার জন্য যাত্রীরা নামেন রাজধানী সুপার মার্কেট এলাকায়। সায়েদাবাদ জনপথ মোড়, সায়েদাবাদ টার্মিনাল ও রাজধানী সুপার মার্কেট অংশে ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হন যাত্রীরা। এই তিনটি স্পটে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানান ফ্লাইওভারের কর্মীরাই।
গুলিস্তান যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী অংশে ওঠা কয়েকজন যাত্রীর সাথে কথা বললে তারা জানান, মূলত সময় বাঁচানোর জন্যই তারা ফ্লাইওভারের উপরে উঠে বাস ধরেন। তবে ফ্লাইওভারের উপরে ওঠা যে জুঁকিপূর্ণ তা তারা সবাই স্বীকার করেছেন। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, আসলেই ফ্লাইওভারের এই অংশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে একটু বেখেয়াল হলেই দুর্ঘটনা ঘটবে। তারপরও তিনি কেন উঠেছেন, জানতে চাইলে বেসরকারি ওই চাকরিজীবী বলেন, ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। রাস্তাগুলো সংস্কার করার কথা ছিল গত বছর। এখনও তা করা হয়নি। রাস্তাজুড়ে শুধু ধুলাবালি। ওই সব রাস্তা দিয়ে গেলে অফিস করার মতো অবস্থা আর থাকে না। ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে চলাচলকারী বাসের কয়েকজন চালকের সাথে কথা বললে তারা জানান, আগে ফ্লাইওভারের উপর যাত্রী খুব একটা দাঁড়াতো না। সিঁড়ি করার পর যাত্রীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন শত শত যাত্রী ফ্লাইওভারের উপরে ওঠানামা করে। এতে করে যেসব গাড়ি ফ্লাইওভারের উপরে দাঁড়ায় না তাদের জন্য ঝুঁকি বেশি। কমল পরিবহনের চালক মোতালেব বলেন, ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে চলাচল করা এখন খুবই বিরক্তিকর। টাকা দিয়ে আমরা ফ্লাইওভারে উঠি অল্প সময়ে পার হয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে নিচের রাস্তা যানজটমুক্ত থাকে। যত জ্যাম উপরেই।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানান, ফ্লাইওভারের অনিয়ম নিয়ে এর আগে একাধিকবার তারা মেয়রকে জানিয়েছেন। এখন বাসগুলো ফ্লাইওভারের উপরে যাত্রী ওঠানামা করানোতে দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় মানুষ আহত হচ্ছে জানিয়ে বাস মালিক সমিতির নেতা বলেন, এটা বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে শৃঙ্খলা বলে কিছুই থাকবে না।
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড (যাত্রাবাড়ী) কাউন্সিলর আবুল কালাম অনু অভিযোগ করেন, তার স্বাক্ষর ও প্যাড জালিয়াতি করে অরিয়ন গ্রুপ সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে ফ্লাইওভারের উপরে বাস দাঁড়ানোসহ সিঁড়ি লাগানোর অনুমোদন নিয়েছে। এ ব্যাপারে কাউন্সিলর আবুল কালাম অনু যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি (নং-১০৮৯, তাং ১৩/১১/২০১৬ ইং) করেছেন। একই অভিযোগে ডিএসসিসি অঞ্চল-৫ এর কর্মকর্তাও পৃথক জিডি করেছেন। কাউন্সিলর আবুল কালাম অনু জানান, গত বছর তিনি পবিত্র হজে থাকাকালে অরিয়ন গ্রুপ তার প্যাড ও স্বাক্ষর জাল করে জনস্বার্থে ফ্লাইওভারের উপরে বাস দাঁড়ানো ও জনগণের উপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি লাগানোর ব্যবস্থা করার আবেদন করে। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ এর অনুমোদন দেয়। হজ থেকে ফিরে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। কাউন্সিলর জানান, জিডি করা ছাড়াও তিনি বিষয়টির তদন্ত চেয়ে ডিএসসিসির মেয়রের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ফরাজী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, লোকজন যাতে চলাচল করতে পারে সে জন্য বাধ্য হয়েই আমরা সিঁড়ি করার অনুমতি দিয়েছি। তবে সিঁড়িগুলো নকশাবহির্ভূত বলে স্বীকার করেছেন তিনি। অন্যদিকে, সিঁড়ি দেয়ার কারণে ফ্লাইওভারের ওপর দুর্ঘটনা কমেছে বলে দাবি করেছেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের দায়িত্বে থাকা ওরিয়নের প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান আলী পাটোয়ারী। তিনি বলেছেন, লোকজন ফ্লাইওভারের ওপরে নামতে চায়। তাছাড়া ফ্লাইওভার ব্যবস্থাপনায় কর্মীরাও সিঁড়ি ব্যবহার করে ওপরে ওঠেন। এদিকে, ডিএসসিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনাও ঘটছে। সে কারণে সিঁড়িগুলো ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা চলছে। এছাড়া ফ্লাইওভারের উপরে চলমান বাসগুলো যাতে না দাঁড়ায় সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের সাথে কথা বলার জন্য তার মোবাইলে কয়েকবার কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।



 

Show all comments
  • আরিফুর রহমান ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:১৪ এএম says : 0
    পৃথিবীর কোনো দেশে সড়ক থেকে ফ্লাইওভারের ওপর এ ধরনের সিঁড়ি তুলে দেয়ার নজির নেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Rimon ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:১৬ এএম says : 0
    asa kori mayor druto bebostha niben
    Total Reply(0) Reply
  • হিমেল ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:১৮ এএম says : 0
    দ্রুত সিঁড়িগুলো ভেঙে ফেলতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Nobin ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:১৯ এএম says : 0
    thanks a lot to the reporter and The Daily Inqilab for this important news
    Total Reply(0) Reply
  • আসিফ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:২০ এএম says : 0
    ফ্লাইওভারের উপরে চলমান বাসগুলো যাতে না দাঁড়ায় সে বিষয়েও ব্যবস্থা নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Ripon ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:২২ এএম says : 0
    এটা বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে শৃঙ্খলা বলে কিছুই থাকবে না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ