Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মাদকে সর্বনাশ: যে কোনো মূল্যে পরিহার করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ব্যাধি, সর্বগ্রাসী মরণ নেশা। এ নেশার কারণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশেষ করে যুব সমাজ। মাদকের নীল দংশনে তরুণ সমাজ আজ বিপথগামী ও বিপন্ন। এর বিষবাষ্প দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। মাদকের বিষাক্ত ছোবল নিঃশেষ করে চলেছে নতুন প্রজন্মকে। এ মরণনেশায় আক্রান্ত হয়ে ঝরে পড়ছে বহু তাজা প্রাণ। শূন্য হচ্ছে অনেক মায়ের বুক। সন্তান হারা মা-বাবার আহাজারিতে দিন দিন ভারি হচ্ছে বাতাস। ভোক্তভোগী পরিবারগুলোতে চলছে শোকের মাতম। কারা সৃষ্টি করছে এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতি? কারা ছড়িয়ে দিচ্ছে এ ভয়ানক আতংক। কারা কেড়ে নিচ্ছে মায়ের বুক থেকে তার প্রিয় সন্তানকে? দায়ী কারা? আজ আমরা এমনই এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি।
জর্জ বানার্ডশকে আমরা জানি। তিনি বলেছিলেন, ‘মধ্যযুগের লোকেরা তাদের রুচিসম্মত উৎকৃষ্ট দ্রব্য উৎপন্ন করতো বলেই যে বর্তমানের তুলনায় সহজ সুন্দর জীবন যাপন করত তা নয়, তার প্রধান কারণ তারা মাদকাসক্ত ছিল না।’ ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতীদের মাদকাসক্তি দেখে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোস্তাত্বিক বিভাগের অধ্যাপক হেরিংটন অভিমত ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, সমাজ, দেশ ও জাতিকে সুস্থ রাখতে হলে ছেলেমেয়েরা যাতে মাদকাসক্ত না হয় সেদিকে প্রতিটি নাগরিকের সচেতন হওয়া উচিত। এ বার্তা বিশ্বের প্রতিটি দেশের সচেতন নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি মিডিয়ার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার দৃষ্টিতে নেশা জাতীয় দ্রব্য উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও সেবন গর্হিত কাজ হিসেবে পরিগণিত হলেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে এসব উৎপাদন, বিতরণ ও পাচারের মাধ্যমে আয় করছে প্রভূত অর্থ, গড়ে তুলছে অবৈধ সম্পদ। অথচ এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে বিচরণ করছে সর্বনাশা মাদক। ঘুণে পোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে মানব অস্থিমজ্জা। অজগরের ন্যায় হা-মুখে খাওয়ার উপক্রম করছে গোটা মানব জাতিকে। এ ভয়ানক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব। অভিভাবকরা আতঙ্কিত, উৎকন্ঠিত। তারা শংকিত কখন মাদকের স্রোতে দিক হারিয়ে ফেলবে তাদের প্রিয় সন্তান। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিজের সন্তানকে রক্ষার জন্য মা-বাবার সাথে পুরো জাতি আজ শংকিত, আতংকিত।
মাদক কী?:
ফেনসিডিল, হিরোইন, কোকেন, সিডাকসিন, ইনোকট্রিন, মরফিন, টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনল, মেথাডন, বিয়ার, কেনা বিসরেসিন, এ্যাবসলিউট এ্যালকোহল, ভেষজ কেনাবিস, গাঁজা, দেশি-বিদেশি মদ প্রভৃতি। তবে বর্তমানে ফেনসিডিল আর ইয়াবার ব্যবহার হচ্ছে সর্বত্র। এর পরিণাম যে কী হবে তা নিয়ে ভাবলে শরীরে শিহরণ জাগে।
মাদক ব্যবহারে শরীরে স্বল্প মেয়াদী প্রতিক্রিয়া:
মাদক রক্তচাপ কমায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা হ্রাস করে।
মাদক সেবনে ক্ষুধা ও যৌন অনুভ‚তি দ্রুত হ্রাস পায়।
মতি বিভ্রম ঘটে এবং তার মধ্যে সন্ত্রস্ত ভাব দেখা যায়।
শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়।
মাদকসেবী ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ এবং অবসন্ন হয়ে যায়।
হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলে রক্তচাপও বৃদ্ধি পায়।
চলাফেরায় অসংলগ্নতা ধরা পড়ে।
স্মৃতি শক্তি ও মনোযোগের ক্ষমতা সাময়িক হ্রাস পায়। তাই যে কোন মুহুর্তে জীবন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
চোখ লালচে হয় এবং মুখ শুকিয়ে যায়।
উগ্র মেজাজ, নিদ্র্র্রাহীনতা ও রাগান্বিত ভাব দেখা যায়।
চামড়ায় ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব এবং নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
অধিক মাত্রায় মাদকসেবী মাতালের মতো আচরণ করে এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।
মাদক ব্যবহারে শরীরে দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া:
স্বাস্থ্যর অবনতি ঘটতে থাকে।
এছাড়া মস্তিস্কে কোষের ক্ষয় প্রাপ্তি ঘটতে পারে।
স্মৃতি শক্তি লোপ পায়।
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান লোপ পায়।
জীবনের সব বিষয়ে নিরাসক্ত হয়ে পড়ে।
কোন কোন মাদকদ্রব্যে আসক্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
মাদকাসক্ত মেয়েদের গর্ভের সন্তানের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং সন্তানও মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মাদক ব্যবহারে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি:
শ্বাস, প্রণালীতে ক্ষতি: খুসখুসে কাশি থেকে যক্ষা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, ক্যান্সার, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ হওয়া।
চোখের ক্ষতি: চোখের মনি সঙ্কুচিত হওয়া, দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া।
লিভারের ক্ষতি: জন্ডিস, হেপাটাইটিস, সিরোসিস ও ক্যান্সার।
কিডনীর ক্ষতি:
কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ঘন ঘন সংক্রমণ হওয়া, পরিশেষে কিডনি অকার্যকর হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি
হৃদযন্ত্র ও রক্ত প্রণালীতে ক্ষতি:
হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্র বড় হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া। রক্ত কণিকার সংখ্যায় পরিবর্তন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তস^ল্পতা ইত্যাদি
খাদ্য প্রণালীতে ক্ষতি:
রুচি কমে যাওয়া, হজম শক্তি হ্রাস পাওয়া, আলসার, এসিডিটি, কোষ্ঠ কাঠিন্য, ক্যান্সার ইত্যাদি
ত্বকের ক্ষতি:
ভিটামিন ও পুষ্টির অভাবে ত্বক হয়ে উঠে খসখসে শুস্ক। চুলকানী, ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, ফোঁড়া, ঘা ইত্যাদি
যৌন ক্ষমতা ও প্রজননের ক্ষতি:
যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া, বিকৃত শুক্র থেকে বিকৃত সন্তানের জন্ম, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা। সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে এ প্রভাব আরো মারাত্মক। গর্ভের সন্তান বিকৃত হয়ে যাওয়া, মৃত সন্তান প্রসব করা, জন্মকালীন শিশুর স্বল্প ওজন, জন্মের সাথে সাথেই নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হওয়া।
মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্র এবং মানসিক ক্ষতি:
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রলাপ বকা, আত্মহত্যার প্রবণতা, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা স¤পর্কে অসচেতনতা, মাথা ঘুরানো, চিন্তা শক্তি লোপ পাওয়া, অমনোযোগীতা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, অস্থিরতা ও অধৈর্য অবস্থা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, উদ্বেগ, ভয় পাওয়া, বিষণœতা ইত্যাদি মানসিক রোগ দেখা দেয় অনেক ক্ষেত্রে।
মাদকসেবীদের চিহ্নিত করার উপায়:
১. চোখে সাধারণ আকৃতির চেয়ে বড় করে তাকানো।
২. হঠাৎ স্বাস্থ্যহানী বা আকস্মিক স্বাস্থ্যবান হয়ে যাওয়া।
৩. চোখ ও মুখ ফোলা এবং চোখ লালচে হওয়া।
৪. সামান্য বিষয়ে অতিরিক্ত রেগে যাওয়া।
৫. অধিক রাত করে ঘুমানো এবং বিলম্বে ঘুম থেকে উঠা।
৬. একাকী অন্ধকার নির্জন রুমে সময় কাটানো।
৭. উদাসী-উদাসী ভাব এবং সবকিছুতে ভুল করা।
৮. নিকটাত্মীয় এবং পরিবার পরিজনদের সাহচর্য এড়িয়ে চলা।
৯. সব বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, হীনমন্যতায় ভোগা। বিষন্ন খেয়ালে ভাবনার গভীর অন্তরালে কিছু খোজাঁ।
১০. বেশি বেশি টাকা ব্যয় করা এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা।
১১. কখনো খাদ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া আবার কখনো হ্রাস পাওয়া।
১২. নিজের শরীর স্বাস্থ্য ও পোশাকের প্রতি খেয়ালহীনতা ইত্যাদি সাধারণ কারণ, যা সহজেই ধরা পড়তে পারে।
পারিবারিক কর্তব্য:
১. মাদকে আসক্তির মূল কারণ খুঁজে বের করা।
২. প্রেম ঘটিত কোন কারণ হলে এর সুস্থ সুন্দর সমাধান দেওয়া।
৩. মানসিক পারিবারিক চাপ প্রয়োগ না করে তাকে ভালোবাসা ও স্নেহের বন্ধনে আরো নৈকট্যে নিয়ে আসা। পরিবারের কেউ অন্ততঃ তার খুব কাছাকাছি হওয়া এবং বন্ধুত্বের স¤পর্কে আবদ্ধ হওয়া।
৪. সর্বোপরি তাকে বুঝিয়ে মাদক সেবন থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করা।
সুতরাং, এ মাদক বা ড্রাগের বিষাক্ত ও ভয়াবহ ছোবল থেকে নিজে বাঁচুন, আগামী প্রজন্মকে বাঁচান। পারিবারিক, ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ রক্ষা করুন। আসুন, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে আমরা পরস্পর পরস্পরের সহযোগী বন্ধু হই। শুধু আইন করলেই হবে না, বিপ্লব করলেই হবে না, সংস্কারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসাধারণের বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে প্রোথিত করতে হবে মাদকবিরোধী চেতনাকে, জোরদার করতে হবে এ আন্দোলনকে। আমরা সেদিনই মাদকবিরোধী আন্দোলনে সফল হবো, যেদিন সকলে মিলে সুস্থ জীবনবোধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে সক্ষম হবো। গড়ে তুলতে পারব সুস্থ, সুন্দর, সবল ও সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা।
পবিত্র ক্বোরআন শরীফের সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, হে নবী! আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আপনি বলে দিন, এ দুটোর ব্যবহারই মহাপাপ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সদস্য, জেলা মাদক নিয়ন্ত্রণ কমিটি, সিলেট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ