Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধারণ ক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ সংযোগ নিয়ে ধুঁকছে বিটিসিএল

দক্ষিণাঞ্চলে সরকারি টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান-বিটিসিএল’ এর এখন বড় দুর্দিন। বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলা ও ৪৪টি উপজেলার ৪৯টি টেলিফোন এক্সেঞ্জে ধারণ ক্ষমতার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সংযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এখন ধুকছে। মোবাইল পরিসেবা শুরু হবার পর থেকেই দেশে সরকারি টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানটির মনোপলী ব্যবসায় ভাটা লাগে। এর সাথে পুরনো প্রযুক্তির ল্যান্ড ফোন, অতিরিক্ত মাসিক লাইন রেন্ট ও কল চার্জের সাথে দিনের পর দিন টেলিফোন বিকল থাকার বিড়ম্বনায় দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ক্রমশ রাষ্ট্রীয় এ টেলিকম প্রতিষ্ঠানটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এমনকি এ অঞ্চলের বেশীরভাগ এলাকাতেই ভ‚গর্ভস্থ কেবলগুলো হয় অকার্যকর, নয়তো রাস্তা সম্প্রসারণের ফলে চীরতরে হারিয়ে গেছে। ফলে কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থায় এরিয়াল কেবলের সাহায্যে টেলিফোন চালু রাখার ব্যার্থ প্রচেষ্টায় ঘন ঘন গোলযোগের কারণে অতিষ্ঠ গ্রাহকগণ এখন আর তাদের ল্যান্ড ফোনগুলো সচল রাখতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
অথচ নিকট অতীতেও একটি ল্যান্ড ফোনের জন্য সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তদবির করতে দিনের পর দিন ব্যায় করতেন। বেপথে বা পেছনের দরজা দিয়ে একটি টেলিফোন সংযোগের জন্য প্রচুর অর্থও ব্যায় করতে হত। কিন্তু এখন সরকারি এ টেলিকম প্রতিষ্ঠানটি অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েও গ্রাহক পাচ্ছে না। ফলে এক সময়ে সরকারি কোষাগারে রেকর্ড পরিমাণ মুনফার অর্থ জমা দেয়া সরকারি এ টেলিকম প্রতিষ্ঠানটি এখন লোকাসানে। বরিশাল টেলিকম অঞ্চলে গতবছর টেলিফোন রাজস্ব থেকে ১১ কোটি টাকা আয় হলেও ব্যায়ের পরিমান ছিল ১৩ কোটি।
বরিশাল বিভাগীয় সদর ও ৬টি জেলা সদর সহ ৪৪টি উপজেলায় বর্তমানে ৪৩ হাজারের বেশী ধারণ ক্ষমতার ৪৯টি টেলিফোন এক্সেঞ্জে কাগজপত্রে সংযোগ রয়েছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের মত, ১৪ হাজারের কিছু বেশী। তবে তা কাগজে পত্রে। বাস্তবে সচল টেলিফোনের সংখ্যা আরো অন্তত হাজার দুয়েক কম হবে। কারণ অনেক গ্রাহকই দিনের পর দিন অভিযোগ দিয়েও টেলিফোন সচল না হওয়ায় পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে আর সময় ব্যায় করেন না। অনেক সরকারি কর্মকর্তাই আবার ল্যান্ডফোন বিকল বা অচল থাকলে মনে মনে স্বস্তি অনুভব করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ এর ফলে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ তার অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেন না। দায়িত্ব পালনে ফাঁকিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য ল্যান্ডফোন বিকল থাকাটা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এরপরও প্রতিমাসেই অন্তত শ’ খানেক টেলিফোন সমর্পন করছেন গ্রাহকগণ। যদিও ৬টি জেলায় নতুন সংযোগেরও কিছু আবেদন জমা পরছে। তবে তা গড়ে ২০-২৫টির বেশী নয় বলে জানা গেছে।
প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও বরিশাল টেলিকম অঞ্চলটি যথেষ্ঠ নড়বড়ে অবস্থায়। ১/১১-এর সেনা সমর্থিত সরকার তার শেষ সময়ে বরিশাল টেলিকম অঞ্চলটি গঠন করলেও তা ছিল একটি শুভঙ্করের ফাঁকি। ঢাকার তেজগাঁও-এ বিটিসিএল এর তার ভান্ডার অঞ্চলের কার্যকরিতা না থাকায় ঐ দফতরটি বরিশালে স্থানান্তর করা হয়। ফলে এখনো বিটিসিএল-এর কাগজপত্রে এটি বরিশাল টেলিকম অঞ্চল নয়। তবে কোম্পানিটির নতুন জনবল কাঠামোতে একজন পরিচালকের তত্ত¡াবধানে বরিশাল টেলিকম অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। যেখানে এ অঞ্চলটির জনবল থাকার কথা প্রায় ৬শ’। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চলে বিটিসিএল-এর জনবল রয়েছে মাত্র ১৭৫ জনের মত। এরপরও প্রতিমাসে ৫-৭ জন করে অবসরে যাচ্ছেন। এমনকি বরিশাল ও পটুয়াখালী টেলিকম বিভাগে দু’জন বিভাগীয় প্রকৌশলী থাকার কথা। তাবে আছেন ১ জন। মাঠ পর্যায় থেকে দুটি টেলিকম বিভাগ ও বরিশাল টেলিকম অঞ্চলের সদর দফতর পর্যন্ত জনবল সঙ্কট মারাত্মক।
আর এ অবস্থাতেই গ্রাহক সেবাও তলানীতে ঠেকেছে। এখন খোদ বরিশাল মহানগরীতে ৪০ বছরের পুরেনো ভ‚গর্ভস্থ কেবলের সাহায্যে টেলিফোন চালু রাখা হয়েছে। তবে বেশীর ভাগ ভ‚গর্ভস্থ কেবল হয় বিনষ্ট হয়ে গেছে, নয়ত সিটি করপোরেশনের রাস্তা সম্প্রসারণের ফলে তা চীরতরে হারিয়ে গেছে। এ মহানগরীতে প্রায় ১২ হাজার ধারণ ক্ষমতার ৩টি ডিজিটাল টেলিফোন এক্সেঞ্জে বিদ্যমান সংযোগ সংখ্যা ৬ হাজারেরও কম। এমনকি নগরীর মাইক্রোয়েভ এক্সেঞ্জে বিদ্যমান ৭ দিয়ে শুরু টেলিফোন এক্সেঞ্জটির সাথে টেলিকম ভবনের ২১ ও ৬ দিয়ে শুরু দুটি এক্সেঞ্জের জাংশন কেবলটি খারাপ দীর্ঘদিন। ফলে নগরীর মূল এলাকায় ৭ সংখ্যার সব টেলিফোন বিকল দীর্ঘদিন ধরে। এসব টেলিফোন গ্রাহকগন প্রথম দিকে অভিযোগ প্রদান করলেও কর্তাদের সাফ জবাব, ঐসব টেলিফোন আর সচল করা সম্ভব নয়। অথচ ঐসব অচল টেলিফোনের জন্য প্রতিমাসে গ্রাহকদের কাছে লাইনরেন্ট-এর বিল পাঠান হচ্ছে। জাংশন কেবলটি সচল করে ৭ সংখ্যার অচল সব ফোন সচল করতে বরিশাল টেলিকম অঞ্চলের পরিচালকও নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে এখন বিষয়টি নিয়ে সদা ব্যস্ত বিটিসিএল-এর প্রকৌশলীগন কিছু বলছে না। ফলে শুধুমাত্র কতৃপক্ষের উদাশীনতা ও অবহেলায় খোদ বরিশাল মহানগরীর বেশ কিছু টেলিফোন স্থায়ীভাবে বিকল হতে চলেছে।
এছাড়া বরিশালের সাথে ভূগর্ভস্থ অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে সারাদেশ সহ বহিঃবিশে^র সাথে সংযোগ প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ছে। বছর কয়েক আগে বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়ক ধরে স্থাপিত ঐ ভূগর্ভস্থ কেবলটি সঠিক মাপে ও মানে স্থাপন না করায় প্রায়সই কেবল কাটা পরে সারা দেশ সহ বহিঃবিশে^র সাথে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে টেলিযোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।
গ্রাহকদের মতে, বিটিসিএল এখনো ল্যান্ডফোনে মাসিক ১২০টাকা করে লাইনরেন্ট আদায় সহ প্রতি মিনিটে ৩০ পয়সা করে কল রেট আদায় করছে। অথচ দেশের কোন সেল ফোনে মাসিক লাইনরেন্ট নেই। উপরন্তু পুরনো প্রযুক্তির প্রাইমারী কেবল,সেকেন্ডারী কেবল ও ড্রপ ওয়ারের মাধ্যমে টেলিফোন সংযোগ অব্যাহত রাখা দুরুহ হয়ে পরছে। বিশে^র প্রায় দেশেই এধরনের পুরনো প্রযুক্তির পরিবর্তে ওয়ারলেস টেলিফোন ব্যাবস্থা চালু হলেও বাংলাদেশে তা এখনো অনুপস্থিত। তার ও কেবল নির্ভর টেলিফোনের পরিবর্তে ওয়ারলেস প্রযুক্তির ফোন সংযোগ প্রদান না করলে ভবিষ্যতে সরকারী এ টেলিকম প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব থাকবে কিনা সে বিষয়ে সন্দিাহান দক্ষিণাঞ্চলের সাধারন গ্রাহকগন।
এসব বিষয়ে গতকাল বরিশাল টেলিকম অঞ্চলের পরিচালক প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডল-এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, দক্ষিণাঞ্চল সহ সারা দেশের টেলিফোন সক্ষমতা বৃদ্ধিও লক্ষে সম্প্রতি একটি প্রকল্প সরকারের অনুমোদন লাভ করেছে। আগামী দুবছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণাঞ্চলের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার দৃশ্যমান উন্নতি ঘটবে। তবে তা ওয়ালেস প্রযুক্তির টেলিফোন কিনা জানতে চাইলে তিনি না সূচক জবাব দেন। পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান টেলিফোন ব্যাবস্থা সহ গ্রাহক সেবা উন্নয়নের লক্ষে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিটিসিএল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ