Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে বিএনপি কি কোন অপরাধ করেছে?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকা সফর করেন। মিয়ানমার হতে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধদের হাতে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কাহিনী শুনে বেগম খালেদা জিয়া বিশেষভাবে আপ্লুত হয়ে ওঠেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মিয়ানমার যাতে যথাশ্রীঘ্র রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ও প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে সে জন্য মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহŸান জানান এবং বলেন, রোহিঙ্গাদের বেশী দিন বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হবে না।
বেগম খালেদা জিয়ার এসব বক্তব্যের সাথে বাংলাদেশের কেউ দ্বিমত হবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস। কারণ এসব বক্তব্য বাস্তবতা-ভিত্তিক। বাংলাদেশ এমনিতেই বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। তাই তার পক্ষে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাড়তি চাপ বেশী দিন সহ্য করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা বোধের কারণে বাংলাদেশের সরকারে অধিষ্ঠিত নেতারাও রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নেয়ার লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। সে নিরিখে সরকারের আহŸানের সাথে প্রধান বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আহŸান মিলে যাওয়ার সরকারের বরং খুশী হওয়ারই কথা।
কিন্তু সরকারের নেতাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় বেগম খালেদা জিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে যাওয়ার তারা অত্যন্ত অসন্তষ্ট। তাদের এ অসন্তোষ তারা প্রকাশ করেছেন বিএনপি নেত্রীর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই। সরকারী দলের অন্যতম নেতা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঐ সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরই মন্তব্য করেন, বিএনপি ত্রাণ বিতরণে কক্সবাজার যাচ্ছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। প্রশ্ন ওঠে, একই কাজ সরকারে অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ করলে তা হয় মানবিকতার উদ্দেশ্যে, আর বিএনপি করলে হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেÑএটা কেমন কথা?
তবে কি আওয়ামী লীগ চায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কাজ শুধু সরকারী দলই করুক, আর কেউ সেদিকে নজর না দিক? পত্রিকায় বেরিয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ী বহরে পথে পথে বাধা দেয়া হয়েছে। যারা বেগম খালেদা জিয়ার রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরই তার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করে দিয়েছে, স্বাভাবিক হিসাবে তাদের দ্বারাই তো এ বাধা সৃষ্টি হওয়ার কথা। তবে কি বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ী বহরে বিরাট শো-ডাউন হওয়ায় তাতে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারী দলের পক্ষ থেকেই এসব বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে?
সেটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয়, সরকারী দলের সমর্থকরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। আর আসলে বর্তমানে যে সরকার দেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে তা সকল দলের অংশগ্রহণে ধন্য কোন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়নি। এমন এক নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, যাকে জনগণ বাস্তবতা বিবেচনায় নাম দিয়েছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন। ৫ জানুয়ারীর সে নির্বাচনে জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশী ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচনী প্রহসনের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড স্থাপন করা হয়।
মিয়ানমার হতে বিতাড়িত অসহায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার যাওয়ার বিরুদ্ধে সরকারী নেতাদের সমালোচনায় মনে হবে যেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কাজ শেষ হয়ে গেছে, প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার আর সেখানে ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশ্যে যাবার দরকার নেই। নেহায়েৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তিনি (খালেদা জিয়া) সেখানে যেতে চাইছেন। আসলেই কি তাই?
পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায় বেগম খালেদা জিয়া অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ১৯০ টন চাল, ৫০০০ প্যাকেট খাদ্য শিশু ও গর্ভবর্তী নারীদের মাঝে বিতরণ করেন। উল্লেখযোগ্য যে বেগম খালেদা জিয়া উখিয়ায় অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন। এ সময় তিনি অসহায় রোহিঙ্গা শিশুদের অনেককে কোলে নিয়ে তাদের প্রতি তাঁর ¯েœহ-মমতাও প্রকাশ করেন।
এতো গেল মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশ আসা অসহায় নারী-শিশু-বৃদ্ধ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা। কিন্তু মিয়ানমারের সরকার এসব রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরৎ নিতে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে কি? যদিও মিয়ানমারের এককালের গণতান্ত্রিক নেত্রী বর্তমানে সরকারের অন্যতম প্রধান অং সান সুচী সম্প্রতি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, অচিরেই শরণার্থী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফেরৎ নেয়ার কার্যক্রম শুরু হবে, তবুও বাস্তবে ঘটেছে বিপরীতটা। আরাকান তথা রাখাইনে রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত গ্রামে যেসব ঘরবাড়ি অবশিষ্ট আছে, সেগুলোতেও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা। গত মঙ্গলবার দৈনিক সমকাল পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল :‘রাখাইনে ঘরবাড়িতে আবারও আগুন’।
বিস্তারিত বিবরণীতে বলা হয় : রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে অবশিষ্ট যেসব ঘরবাড়ি রয়েছে, সেগুলোও আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা। গত দুদিন ধরে রাখাইন রাজ্যের টাউনশিপের বুথিডং এলাকায় সেনাদের উপস্থিতিতে রাখাইনরা আগুন দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওই সব গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। গত এক সপ্তাহে সাড়ে ৭ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
‘গত সোমবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে সাবরাং-ইউনিয়নের মারিয়াখালি স্কুল মাঠে আশ্রয় দিয়েছেন জাফরুল্লাহ (৩৬) নামের এক রোহিঙ্গা। তিনি জানালেন, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা মিলে তাদের গ্রামে মাইকিং করে। তারা বলে, তোমরা সবাই বাঙালী, বাংলাদেশে চলে যাও। না হলে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হবে। এরপর ঘর থেকে বের হয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে জঙ্গলে ও পারাবনে আশ্রয় নেয়। সেনারা রাখাইনদের দিয়ে বেশ কয়েকটি ঘরে তল্লাশি চালায়। যেসব ঘর খালি পেয়েছে ওই ঘরগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে জাফরের ঘরও রয়েছে।
“দিনের বেলায় সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা যেসব গ্রামে এখনও রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তাদেরকে বার্মিজ ভাষায় লেখা ‘বাঙালি কার্ড’ জোর করে ধরিয়ে দিয়েছে এবং অনেকে প্রাণ ভয়ে এ কার্ড নিয়েছে। তা কেউ নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। এ কারণে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। এই টাউনশিপের দাপুপাড়া গ্রামের নুরুল আমিন (৪০) বলেন, সে দেশে আমাদের জন্ম। কিন্তু দু:খজনক বিষয় সেদেশে আমাদের ঠাঁই হয়নি। পরিবারকে নিয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে। হয়ত সেখানে থাকলে ঘরবাড়ির মতো আমাদেরও আগুনে পুড়ে মরতে হতো। তিনি আরও জানান, গত দুই দিন আগে রাতের বেলায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে রাখাইনরা আমাদের কাঠের দোতলা ঘরটি পুড়িয়ে দিয়েছে। তখন মনে হচ্ছিল আমাদের বুকের ভিতর আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। ওই গ্রামের সোনা বাজারে আমাদের দুটি কাপড়ের দোকান ছিল যা ১০ দিন আগে লুট করে নিয়েছে তারা। নুরুল আমিন আক্ষেপ করে বলেন, পৃথিবীতে কি আর এমন কোন দেশ আছে যেখানে সরকার নিজ দেশের মানুষকে গুলি, আগুন ও জবাই করে হত্যা করে? এ প্রশ্ন শুধু নুরুল আমিনের নয়। আমাদেরও।
একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতাগর্বী এ বিশ্বে মিয়ানমারের মত এখন বর্বরতার দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি কোথাও আছে বলে মনে হয় না। অথচ নির্বিবাদে মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা এই বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, নিরীহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গাদের প্রধান অপরাধ কি এটাই যে তারা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান? আর বেগম খালেদা জিয়ার কি অপরাধ এটাই যে সরকারী দলের কেউ না হয়েও অসহায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিনি ত্রাণ বিতরণে গেছেন?



 

Show all comments
  • Hassan S Chowdhury ৫ নভেম্বর, ২০১৭, ৭:৫৮ এএম says : 0
    Canada needs 10 (ten) lakh more immigrants. Bangladesh has11(eleven) lakh Rohingas. Please send 10(lakh) to Canada.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ