Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে নিজের ফর্মুলা নিয়ে শেখ হাসিনা এখন এত ভীত কেন?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কোনো সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে দেশের প্রধান দুই দল এখন পর্যন্ত একেবারে বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। সরকারী দল আওয়ামী লীগ চাইছে বর্তমান সরকারের অধীনেই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। পক্ষান্তরে অন্যতম প্রধান দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি সোহরওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কোন নির্বাচন নয়, কারণ তা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ধরনের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না।
দেশে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য নিয়মিত ব্যবধানে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন বিকল্প নেই। নির্বাচনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের পছন্দের দল ও প্রতিনিধিদেরকে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো। নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয়, তা হলে নির্বাচনের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায় এবং সে ধরনের নির্বাচন বাস্তবে হয়ে পড়ে নির্বাচনী প্রহসন। তার দ্বারা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরালোভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কোন সার্থক ভূমিকা পালন সম্ভব হয় না।
আমাদের দেশে আমাদের যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তেমনি হয়েছে স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা দেখার দুর্ভাগ্য। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার পেছনে সুদীর্ঘকালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবদান থাকলেও দু:খের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারই এক পর্যায়ে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে দেশে এক দলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। বহু দু:খজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে সে এক দলীয় শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুন: প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও এক পর্যায়ে তদানীন্তন সেনা প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন।
দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে তখন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা জেনারেল এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন। এটা বাস্তবে সম্ভব হয় হয়তো এ বিবেচনায় যে, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত হওয়া নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। এর অর্থ হলো নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাইতে শেখ হাসিনার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলকে।
এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের সুদীর্ঘ স্বৈরশাসন। একই সাথে শুরু হয় রাজনীতিতে নবাগতা বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া-সহ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বহুদিন পর্যন্ত স্বৈরাচারী এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। শেষ দিকে তিনি অংশ নিলেও ততদিনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে একটানা অংশ নিয়ে দেশে রীতিমত আপোষহীন নেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ফেলেছেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তার প্রতিফলন দেখা গেল এরশাদের শাসনামলের শেষ পর্যায়ে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে। এই নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে প্রধান দুই দল একমত হয় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে।
এরপর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মেয়াদ-শেষে যখন নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন আসে, তখন প্রধানত শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধিত হয়। বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই যে গণতন্ত্রের নিরিখে সব চাইতে উপযোগী, তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। কারণ এর পর বেশ কয়েক বার সকল জাতীয় নির্বাচন এ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পর পর দুই প্রধান রানৈতিক দল পালাক্রমে নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে।
কিন্তু পরবর্তীকালে ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকে পচিয়ে ফেলে এবং রাজনীতিকদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধার সুযোগে অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে এবং এক পর্যায়ে সেনা-সমর্থিত সরকারের নামে সেনা-নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে। শুধু তাই নয়, দেশের দুই প্রধান নেত্রীকে জাতীয় সংসদের নিকটে দুই পাশাপাশি ভবনে গৃহবন্দী করে রাখে। তারা দুই প্রধান দলের কিছু রাজনীতিককে হাত করে তাদের সহযোগিতায় বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলারও প্রয়াস পায়। দুই দলের উচ্চ পর্যায়ের কিছু নেতাকে এভাবে হাত করা সম্ভব হলেও উভয় দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তুমুল বিরোধিতার কারণে এসব ষড়যন্ত্র ভÐুল হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে অন্যতম গৃহবন্দী শেখ হাসিনা জানান, তিনি ক্ষমতায় গেলে অসাংবিধানিক শক্তির সমস্ত অবৈধ ভূমিকার বৈধতা দান করবেন। এরপর তথাকথিত সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। পরবর্তীকালে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ তার অতীতের সমঝোতা থেকে সরে যাওয়ার অভিযোগে সে নির্বাচন বর্জন করেন। একটি বড় দল ৫ জানুয়ারীর সে নির্বাচন বয়কট করায় বাস্তবে সে নির্বাচন হয়ে পড়ে নির্বাচনী প্রহসন।
নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল প্রায় লোকশূন্য, ফাঁকা। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা তো দূরের কথা, সরকারী দলের অনেক নেতাকর্মীও ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারাও জানতেন, দলের পক্ষ থেকে তাদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা হবে। বাস্তবে হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে সরকারী দলের অল্প সংখ্যক নেতাকর্মী সরকারী দলের প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালটপত্রে ইচ্ছামত সীল মেরে তাদের পক্ষে বহুগুণ বেশী ভোট প্রদত্ত হল বলে দেখাতে সক্ষম হন। অথচ ভোটদানের প্রায় সমস্ত সময়টাই সকল ভোট কেন্দ্র ছিল ভোটার শূন্য, ফাঁকা। পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় ফাঁকা সব ভোট কেন্দ্রের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে প্রকৃত অবস্থা জনগণের কাছে উদঘাটিত হয়ে পড়ে। পত্রিকায় জনশূন্য ফাঁকা ভোট কেন্দ্রে সমূহে কী ভাবে বিপুল ভোটে সরকারী প্রার্থীরা নির্বাচিত হল তাতে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়ে এ নির্বাচনের নাম দেন ভোটারবিহীন নির্বাচন।
স্বাভাবিকভাবেই বিরোধীদলের পক্ষ থেকে এবার দাবী উঠেছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলীয় সরকারের অধীনে নয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে পরবর্তী নির্বাচন। নইলে আগামী নির্বাচনও হবে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের মত আরেকটি নির্বাচনী প্রহসন। তাছাড়া এখানে আরেকটি প্রশ্নও আসে সঙ্গত কারণেই। এরশাদ- আমলের পর খালেদা সরকারের মেয়াদ শেষে যে নির্বাচন হয়, সে নির্বাচন তো প্রধানত তদানীন্তন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অনুষ্ঠানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সে দিন যে দাবীতে শেখ হাসিনা এত উচ্চ কণ্ঠ ছিলেন আজ তাঁর কাছে তা এত ভীতিপ্রদ মনে হচ্ছে কেন? তবে কি তাঁর আশঙ্কা সে দিনের সে দাবী মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি নিশ্চিত পরাজয় বরণ করবেন? সে কারণেই কি তাঁর নিজের সে দিনের দাবীর ভিত্তিতে নির্বাচন দিতে কিছুতেই তিনি সাহস পাচ্ছেন না?



 

Show all comments
  • জুনাইদ আব্দুল্লাহ ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:৫৬ এএম says : 2
    আল্লাহ যেদিন সিংহাসন থেকে নামাবেন কেও ধরে রাখতে পারবেনা।
    Total Reply(0) Reply
  • নাভিল ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১:৪৩ এএম says : 2
    স্যার অনেক সুন্দরভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • আরমান ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১:৪৪ এএম says : 2
    নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে বর্তমান সরকারি দলের করুণ পরাজয় হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • শুভ্র ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১:৪৬ এএম says : 2
    নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয়, তা হলে নির্বাচনের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায় এবং সে ধরনের নির্বাচন বাস্তবে হয়ে পড়ে নির্বাচনী প্রহসন।
    Total Reply(0) Reply
  • আরফান ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১:৪৮ এএম says : 2
    এটা তো দিনের মত স্পষ্ট
    Total Reply(0) Reply
  • S. Anwar ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ৮:৩১ এএম says : 3
    সু্ষ্টু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অতি শোচনীয়ভাবে হারবে এটা তারাও ভালো করেই জানে। তাদের ভয় হেরে যাওয়াতে নয়। তাদের ভয় হলো, হেরে যাবার পর তাদের অস্তিত্বের কি হবে?? এই দুশ্চিন্তায় তারা অস্থিরতায় ভুগছে।
    Total Reply(1) Reply
    • জামান ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১১:১৯ এএম says : 4
      ঠিক বলেছেন
  • Imteaz Ikram ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ৮:৪৯ এএম says : 2
    জাতি জানার জন্য আগ্রহী
    Total Reply(0) Reply
  • Shuvo ২৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:৫০ এএম says : 2
    awami ra indiar kothamotho chole tai dadara jai bole tai hobe.
    Total Reply(1) Reply
    • no name ২৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১১:৩৯ পিএম says : 4
      ar BNP pakistaner dalalé
  • no name ২৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১১:৪১ পিএম says : 3
    MAMA Barir abdar. that will not be fulfilled for BNP-JAMAT
    Total Reply(0) Reply
  • omayer ২৮ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:৪৩ এএম says : 0
    যদি ৫০% সুষ্ঠু নির্বাচনও হয় তাহলেও আওয়ামি লীগের করুণ পরাজয় অনিবার্য৷
    Total Reply(0) Reply
  • Jubair Hasan ২৯ নভেম্বর, ২০১৭, ৮:৫০ এএম says : 0
    এটাতো একটা ছোট বাচ্চায় ও বুঝে যে, আওয়ামীলীগ কেনো নিজেরা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দিতে চায়। কারন, ভরাডুবি নিশ্চিত জেনে তারা কেনো সে পথে হাটতে যাবে।
    Total Reply(1) Reply
    • tuhin ২৯ নভেম্বর, ২০১৭, ৩:৩৬ পিএম says : 4
      bnp andolon kore tader dabr protestito koruk.

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় নির্বাচন


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ