হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
গত ২৬ নভেম্বর শেষ হল দেশের বৃহত্তম পাবলিক পরীক্ষা যা সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে পিএসসি এবং মাদরাসা বোর্ডে ইবতেদায়ী নামে পরিচিত। নভেম্বরের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট(জেএসসি) ও জেডিসি(জুনিয়র দাখিল) স্তরের পাবলিক পরীক্ষা। সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারবাহিকতায় এসব প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়া, শিক্ষক-অভিভাবক, শিক্ষাকর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গণনকলবাজি বা জিপিএ ফাইভ নিশ্চিত করার সর্বাত্মক কসরত দেখা গেছে এবারের পরীক্ষাগুলোতেও। এর আগে মাধ্যমিক. উচ্চমাধ্যমিক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাসহ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও এবার শিশুদের (পিইসি ও ইবতেদায়ী)প্রথম পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মধ্য দিয়ে দেশের প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় পাবলিক পরীক্ষাসমুহের মেধা যাচাইয়ের ব্যবস্থা নস্যাৎ করার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। এসব পরীক্ষাকে ঘিরে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের প্রথম দিকে ভর্তি বাণিজ্য, সারাবছর ধরে কোচিং বাণিজ্য, গাইডবই বাণিজ্য ইত্যাদি পর্যায়ক্রমিক শিক্ষাবাণিজ্য চালানোর পর পাবলিক পরীক্ষায় শত ভাগ পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির উচ্চহার নিশ্চিত করতে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহ নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করে থাকে। তাদের এসব প্রতিযোগিতায় পড়ে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই একটি অনৈতিক দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়ে শিশুরা। প্রশ্নপত্র ফাসের বহুবিধ কুফল ইতিমধ্যেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলেছে। শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই ও মেধাস্থান নির্ধারণ পাবলিক পরীক্ষার মূল লক্ষ্য হলেও এসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তা সম্ভব হচ্ছেনা। সারা বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে প্রস্তুতি গ্রহণ করে কিছু শিক্ষার্থী ভাল ফলাফল ও বৃত্তিলাভের প্রত্যাশায় পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিলেও যারা আগেই প্রশ্নপত্র পেয়ে যায় এবং শিক্ষক-অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ প্রযোজনায় পরীক্ষা হলের কার্যক্রম সম্পন্ন করছে তাদের সাথে প্রকৃত মেধাবীরা পেরে উঠছেনা। শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা এবং কর্মজীবনে প্রবেশ করা পর্যন্ত এই অসম প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা হলের সিন্ডিকেট, নানাবিধ কোটা, দলবাজি ও স্বজনপ্রীতির মধ্য দিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের দূরে ঠেলে দেয়ার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি, অনৈতিক মুনাফাবাজি, রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির জয়জয়কার চলছে। শিক্ষা ব্যবস্থার এই অনৈতিক ও অবিমৃশ্যকারি তৎপরতার প্রভাব পড়ছে দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, প্রশাসনে, রাজনীতিতে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে ও পুরো সমাজব্যবস্থায়। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে বিদ্যমান অবক্ষয়, অনিশ্চয়তা ও পিছিয়ে পড়ার ধারাক্রম থেকে জাতিকে মুক্ত করে প্রত্যাশার দিগন্তকে উন্মোচিত করতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈষম্য, দুর্নীতি ও অনৈতিক মুনাফাবাজির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করে স্বচ্ছ সুন্দরের পথে পরিচালিত করতে হবে।
নতুন শিক্ষানীতির আওতায় প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পঞ্চম শ্রেনী থেকে অষ্টম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ করা হলেও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার নামে পঞ্চম শ্রেনীতে একটি পাবলিক পরীক্ষা চালু করার যৌক্তিকতা শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে পঞ্চম, অষ্টম এবং দশম শ্রেনীশেষে তিন তিনটি পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনৈতিক প্রতিযোগিতার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। একদিকে শিক্ষার্থীদের শারীরিক মানসিক চাপ অন্যদিকে অভিভাবকদের উপর একটি অহেতুক ও অন্যায্য অর্থনৈতিক চাপ একটি বড় ধরনের সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। আমাদের সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার নিশ্চয়তা দিলেও সন্তানদের জন্য ন্যুনতম মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে দেশের কোটি কোটি স্বল্প আয়ের মানুষকে জীবনযাপনের অনেক কিছুই কাটছাঁট করে সন্তানদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। সন্তানদের ভর্তির খরচ, স্কুলের বেতন, টিউশন ফি, কোচিং খরচ, শিক্ষা সরঞ্জামের যোগান দিতে গিয়ে সুষম খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবাসহ জীবনমানের আনুসাঙ্গিক অনেক কিছুই বাদ দিতে হচ্ছে। অতিরিক্ত পাবলিক পরীক্ষা এবং এসব পরীক্ষায় গ্রেড নিশ্চিত করতে শিশুদেরকে দিন-রাতের প্রায় পুরোটা সময় হোমওয়ার্ক, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রাখা হয়। এর ফলে শিশুদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য ও বিকাশ চরমভাবে ব্যহত হয়। লাখ লাখ শিশুর শারীরিক গঠন, দৃষ্টিশক্তি, নিউট্রিশান ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে তাদের মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ও সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে শিশুর নৈতিক-চারিত্রিক উন্নতি, মননশীলতার বিকাশ, শারীরিক সুস্থতা, দেশাত্মবোধ, ভবিষ্যত নাগরিক ও নেতৃত্বের সহায়ক কিনা সেদিকে লক্ষ্য রেখেই পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা এসব অপরিহার্য্য লক্ষ্য থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বিশেষত: দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং শাসকশ্রেনীর ভ্রান্ত নীতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অকেজো, অথর্ব ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করেছে। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে পুন:প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকরা একটি অগণতান্ত্রিক শ্রেনীচরিত্রকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনকি আশির দশকের সামরিক স্বৈরাচারের আমলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও গত ২৭ বছরেও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নির্বাচন দিতে পারেনি। দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির বিকাশ মূলত: শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গণ থেকেই নাগরিক সমাজে সঞ্চারিত হয়ে থাকে। আমাদের গণতান্ত্রিক সরকার দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ও গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা রুদ্ধ করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূতিকাগার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গণবিচ্ছিন্ন, রাজনীতি বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিনত করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের মাল্টিকালচারালিজম ও বহুদলীয় রাজনৈতিক সহাবস্থানের চর্চা ও পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই শুরু হয়েছিল। বিপরীতে আমাদের দেশকে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে দেয়ার আত্মঘাতি ব্যবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়েছিল। সামরিক শাসনামলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সব ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রা সূচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্ষমতাসীনদের একক আধিপত্যের জায়গায় পরিনত হওয়ার বাস্তবতা বিষ্ময়কর। গত এক দশকে অবস্থার শোচনীয় অবনতি ঘটেছে। বিশেষত: ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগের সহযোগি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং সরকার সমর্থিত শিক্ষকদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকারান্তরে জিম্মি হয়ে পড়ার বাস্তবতা দেশের কোন বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারছেনা। একেকবার পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যই বলতে বাধ্য হয়েছেন যে ছাত্রলীগের কারণে আওয়ামীলীগ সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
দেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জাতীয় ইতিতহাসের প্রতিটিন চড়াই উৎরাই পার করে একটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত করার সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রায় এ দেশের ছাত্র সমাজের একটি নিবিড় ও অবিচ্ছিন্ন ভ‚মিকা রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্রলীগের ভ‚মিকা অবশ্যই অগ্রগণ্য। আওয়ামিলীগের অংগ সংগঠন হলেও ছাত্রলীগের জন্ম আওয়ামীলীগেরও আগে। আওয়ামিলীগের অভ্যুদয় ১৯৪৯ সালের ২৩জুন, আর ছাত্রলীগের জন্ম ১৯৪৮ সালের জানুয়ারীতে। মুসলিমলীগের একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা এই উভয় সংগঠনের নামের সাথেই শুরুতে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছিল। আওয়ামি মুসলিমলীগ এবং আওয়ামি মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র দেয়ার চেষ্টা করা হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রলীগের যে ভ‚মিকা থাকার কথা ছিল তা থেকে সংগঠনটি স্পষ্টতই বিচ্যুত হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের রাজনীতির জন্য এক ধরনের দায়বদ্ধতায় পরিনত হয়েছে। একটি প্রধান ছাত্র সংগঠনের একশ্রেনীর নেতাকর্মীর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানাবিধ অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার কুপ্রভাব অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোতেও কমবেশী পড়তে বাধ্য। বিশ্বের দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণার ঔৎকর্ষ ও উদ্ভাবনার মধ্য দিয়ে মানুষের সামাজিক- রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি শান্তি, সৌহার্দ্য ও সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টিতে অনন্য ভ’মিকা রাখলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি, সংঘাত-সংর্ঘষ, রক্তপাত ও হত্যাকান্ডের মধ্যদিয়ে একেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রস্ত আতঙ্কের জনপদে পরিনত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময়ে বহুমত ও দলের সহাবস্থানের সুযোগ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরও ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘাতের রণক্ষেত্রে পরিনত হতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রেও ছাত্রলীগের কোন তুলনা নেই। ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানাবিধ হীনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও বিভাজিত গ্রুপের অসংখ্য সংঘাত-সংর্ঘষের ফিরিস্তি তুলে ধরা এখানে সম্ভব নয়। পুরাণ ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্মীরা পোশাক শ্রমিক বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্য কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য, সিলেটে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাস আগুনে ভষ্মিভ’ত করা, এমসি কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগমকে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্য কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার দৃশ্য অথবা জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগনেতা মানিকের ধর্ষনের সেঞ্চুরি উদযাপন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির মত অভিযোগ ছাত্রলীগের ৭ দশকের গৌরবময় ইতিহাসকে ম্লান ও কলঙ্কিত করার ধারা সমগ্র জাতির ললাটে এক একটি কলঙ্ক লেপিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে যুব সমাজের মধ্যে যে অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, কিশোর অপরাধ, পারিবারিক-সামাজিক সহিংসতা, নির্মমতার মত উপসর্গের মহামারি দেখা যাচ্ছে তার পেছনে শিক্ষাব্যবস্থার হালচিত্র, ছাত্র রাজনীতির বিপথগামিতা এবং জাতীয় রাজনীতির অপরিনামদর্শিতার বড় ধরনের দায় রয়েছে। ক্ষমতাকেন্দ্রীক জাতীয় রাজনীতির কুশীলবরা ক্ষমতায় আকড়ে থাকতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেনতেন প্রকারে দখলে রেখে সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম রাখতে গিয়ে এবং ছাত্র রাজনীতিকে শিক্ষা ও ছাত্র স্বার্থের বাইরে নিয়ে গিয়ে ছাত্রনেতাদের মধ্যে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার প্রতিযোগিতা এবং এ লক্ষ্য অর্জনে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত হওয়ার মত প্রবণতা দেশের অসুস্থ জাতীয় রাজনীতি থেকেই সংক্রামিত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী হয়েও এরা ভবিষ্যতের সুযোগ্য নেতৃত্বের উপযোগি হয়ে গড়ে ওঠার বদলে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশের আগেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পারমিটবাজিতে হাত পাকাচ্ছে। এদের দিয়ে জাতীয় রাজনীতির ইতিবাচক পরিবর্তন আদৌ সম্ভব নয়।
দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শতাধিক। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাজনীতিতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থানের পরিবেশ দূরের কথা, ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ-সংঘাতই সামাল দেয়া যাচ্ছেনা। এখন আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীন কোন্দল ও অনৈক্য ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাতীয় রাজনৈতিক চলমান ছত্রখান অবস্থা একদিনে হয়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গণগুলোর অনিয়ম, বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলার প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য। গত ৮ বছরে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে কমপক্ষে ১২৫জনের মৃত্যুরখবর পাওয়া যায়। এদের বেশীরভাগই ছাত্রলীগ নেতা হলেও প্রতিপক্ষ সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও শিশু ও সাধারণ মানুষও ছাত্রলীগের কোন্দলে শিকার হয়ে মারা গেছে। যেখানে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে কোন নিয়ম-শৃঙ্খলায় আনতে পারছেনা, সেখানে বর্তমান সরকার দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্তরের হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। এক সময় দেশের স্কুলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি ছিল, বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হত। সে সব নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির তেমন কোন সংশ্রব থাকতোনা। জাতীয় সমস্যা ও সংকটের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল-কলেজ পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতির মূল বিষয় ছিল শিক্ষাকেন্দ্রিক ও শিক্ষার স্বার্থসংশ্লিষ্ট। সে সব প্লাটফর্ম থেকে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতির নেতৃতের¡ বীজ রোপিত হত। সেই স্মৃতি এখন শুধুই ইতিহাস। কলুসিত ও অনিশ্চিত জাতীয় রাজনীতির ধারা পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ না নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সহাবস্থান নিশ্চিত না করেই স্কুল-কলেছে নতুন করে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের ফলাফল কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষা শান্তি প্রগতি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন মটো হলেও গত এক দশকে ছাত্রলীগের কর্মকান্ড তাদের এই মূলমন্ত্রের সম্পুর্ন বিপরীত। খোদ প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ হয়ে একসময় ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব পরিত্যাগ করার ঘোষনা দিয়েছিলেন তিনি। ছাত্রলীগের উñৃঙ্খল ও নিয়ন্ত্রণহীন তান্ডবে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি বাতিলসহ কর্মকান্ড বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে দলীয় ফোরাম। এরপরও অব্যাহতভাবেই নিয়ন্ত্রণহীন ছাত্রলীগ। এক সময়ের শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃত ছাত্রলীগের একশ্রেনীর নেতাকর্মী এখন বন্দুক চাপাতির নৃশংসতাকেই যেন বেছে নিয়েছে। তাদেরকে কেউ নিয়ন্ত্রন করতে পারছেনা। স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিপক্কতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক কমিটমেন্ট স্থিতু হওয়ার কথা থাকলেও এসব নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে জাতীয় রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতির বিপথগামিতাকেই দায়ী করা যায়। এবারের জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতেও বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় ছাত্রলীগের প্রভাব ও অনধিকার প্রবেশের ঘটনা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আওয়ামীলীগের দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি গঠিত হলে সারাদেশে হাজার হাজার পরীক্ষাকেন্দ্রের প্রায় প্রতিটিতে ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্কুল ও স্থানীয় কমিটির মধ্যে বিরোধ ও প্রভাববিস্তারের রণক্ষেত্রে পরিনত হবে। যেখানে হাতে গোণা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা কমিটি সরকার ও দলীয় ভাবমর্যাদার তোয়াক্কা না করে যখন তখন আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও রক্তাক্ত সংঘাত নিয়ন্ত্রন বা নিবৃত্ত করা যাচ্ছেনা, সেখানে হাজার হাজার স্বুল কমিটির কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা আছে কিনা আমাদের জানা নেই। এ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজির মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতা স্কুল থেকেই শুরু হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এ কথা ঠিক যে, আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক ও দক্ষ নেতৃত্ব গঠনের পরিকল্পনা স্কুল থেকেই শুরু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব দল ও মতের ছাত্রসংগঠনের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পরিবেশ তৈরী করে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। শিক্ষক রাজনীতিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধুমাত্র শিক্ষাকেন্দ্রিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির পুনরুজ্জীবন শুরু করা সম্ভব হলে দেশে ইতিবাচক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা সূচিত হওয়ার পরই আওয়ামীলীগ বা বিএনপি’র মত রাজনৈতিক দলগুলো স্কুলগুলোতে কমিটি গঠনের চিন্তা করতে পারে। এটা নিশ্চিত যে ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি গঠিত হলে বিএনপিসহ অন্যান্য বড় দলগুলোও স্কুল কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিবে। প্রতিপক্ষ সংগঠনের সাথে এবং আভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংসের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হতে পারে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।