Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

‘রোহিঙ্গা’ উল্লেখ না করেই ভাষণ দিলেন পোপ

‘রোহিঙ্গা’ শব্দ বাদ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কারণেই : ভ্যাটিক্যান

ইনকিলাব ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির সঙ্গের বৈঠক শেষে দেওয়া ভাষণে রোহিঙ্গাদের নাম নেননি পোপ ফ্রান্সিস। মঙ্গলবারের ওই ভাষণে দেশটির অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত এবং জনগণের ভোগান্তি তুলে ধরেন তিনি। বৈচিত্র্য নিয়ে সম্মিলিত হতে বলেন শান্তির পক্ষে। পোপ সরাসরি রোহিঙ্গাদের নাম না নিলেও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে পরোক্ষভাবে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন ওই জনগোষ্ঠীকেই জোরালোভাবে নির্দেশ করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ভ্যাটিকানও স্পষ্ট করে জানিয়েছে, কেবল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কারণেই পোপ রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেননি। এর আগে সোমবার রাজনীতি বিশ্লেষকরাও এমনটাই আভাস দিয়েছিলেন।
পোপের ভাষণকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকের পর দেওয়া ভাষণে দেশটির অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং জনগণের ভোগান্তি নিয়ে কথা বলেছেন পোপ।
ফ্রান্সিস বলেন, ‘মিয়ানমারের বড় সম্পদ হলো দেশটির জনগণ। আর এ জনগণকে প্রচন্ডরকমের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দীর্ঘদিনের ও বিভাজন তৈরিকারী অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত এবং যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে তারা ধারাবাহিকভাবে ভোগান্তিতে আছে।’ শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মিয়ানমারের উদ্যোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পোপ জনভোগান্তি নিরসনকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক অগ্রাধিকার হিসেবে নেওয়ার তাগিদ দেন।
পোপ আরও বলেন, ‘ধর্মীয় ভিন্নতা বিভাজন ও অবিশ্বাসের উৎস নয়, বরং এটি ঐক্য, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত জাতি গঠনের শক্তি’।
আগেই পোপ রোহিঙ্গাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে সরব অবস্থান নিয়েছিলেন। এ বছরের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনের ভয়াবহতায় তাদের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। বলেছিলেন, ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই প্রার্থনা করি তিনি যেন তাদের সুরক্ষিত রাখেন। তাদের সাহায্যে বাকিদের এগিয়ে আসতে বলেন―যারা তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে। মানবিক আবেদন জানাতে গিয়ে চলতি বছরেই দু’বার রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। তাই মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর ভোগান্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে তিনি রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ বাদ দিতে পারেন না।
ভ্যাটিকান মুখপত্র ক্রাক্সের প্রতিবেদনেও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের চাপের কারণে পোপ রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেননি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মঙ্গলবার রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি পোপ। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। মিয়ানমারের কার্ডিনালও পোপকে সরাসরি রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারপরও পোপ ফ্রান্সিস দেশটিকে একেবারে ছেড়ে দেননি। বরং তিনি মিয়ানমারের জনগণকে দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতের কারণে তারা ধারাবাহিক ভোগান্তিতে আছে’।
বিশ্লেষকরাও সোমবার ধারণা করেছিলেন, একক জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের নাম নেওয়া তার জন্য কূটনৈতিকভাবে কষ্টসাধ্য। তিনি তাই সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ তুলে রোহিঙ্গাদের বিপন্নতা তুলে ধরতে পারেন।
মিয়ানমারের মাটিতে দাঁড়িয়ে পোপ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করবেন কিনা; জানতে চাইলে ভ্যাটিকানের মুখপাত্র গ্রেগ বুরকে জানান পোপকে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তা তিনি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন।
সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কেবলই আনুষ্ঠানিকতা নয় পোপের এই সফর। এটি মানবতা ধর্ম আর কূটনীতির মধ্যে সমন্বয়। অস্ট্রেলিয়ার লোয়া ইন্সটিটিউটের রিসার্চ ফেলো আরন কোনেলি সিএনএনকে বলেছেন, নিশ্চয় এই সফর কেবলমাত্র একটা আনুষ্ঠানিকতা হবে না। তিনি বলেন, ‘একটা বিষয় পরিষ্কার। পোপ অবশ্যই রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলবেন। এখন প্রশ্নটা হলো তিনি মিয়ানমারকে তা শক্তভাবে বলেন নাকি বন্ধুত্বপূর্ণ পথে বলেন সেটা’।
পোপ বিশ্লেষকদের মন্তব্যকে সত্য প্রমাণ করে তার ভাষণে কেবল রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ না তুলে সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। বলেন, ‘শান্তিই মিয়ানমারের ভবিষ্যত হতে হবে। সেই শান্তি যা সমাজের প্রত্যেক সদস্যের মর্যাদা ও অধিকারকে সম্মান জানানোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের পরিচয়কে সম্মান করে, আইনের শাসনকে সম্মান করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর জন্য সম সুযোগ নিশ্চিত করে এমন গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে’।
সেনাপ্রধানের সঙ্গে আকস্মিক বৈঠকে বাধ্য হয়েছেন পোপ
এদিকে মিয়ানমারের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাংয়ের সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য করা হয়েছে পোপ ফ্রান্সিসকে। ভ্যাটিকান মুখপত্র ক্রাক্স নিউজের এক প্রতিবেদনে এই দাবি করা হয়েছে। ভ্যাটিকান প্রতিবেদকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমারের কার্ডিনাল চার্লস মং বো’র নির্দেশনা মেনেই তিনি শীর্ষ সামরিক নেত্বত্বের সঙ্গে গত সোমবারের আকস্মিক সেই ১৫ মিনিটের অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। মিয়ানমারের কার্ডিনাল নিজেও এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
পোপের সফরসূচি অনুযায়ী মিয়ানমারের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি সিনিয়র জেনারেল মিং-এর সঙ্গে পোপের নির্ধারিত বৈঠকটি শেষ দিন আগামীকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে শুরুর দিনেই ইয়াঙ্গুনে আর্চ বিশপের বাসভবনে পোপের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন মিয়ানমারের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা। জেনারেল মিং অনের অফিশিয়াল ফেসবুক পোস্ট এবং ভ্যাটিক্যান মুখপত্র ক্রাক্স-এর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, বিশেষ অভিযান ব্যুরোর তিনজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও ছিলেন সেই বৈঠকে। শীর্ষস্থানীয় এই সামরিক কর্মকর্তাদেরই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন এবং ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করার মূল হোতা বলে মনে করা হয়।
উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও পোপের সফরকালে তাকে হুমকি দিয়েছে। পৌঁছানোর আগেই কার্ডিনাল চার্লস মং বো তাকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে মানা করেন। ভ্যাটিক্যান প্রতিবেদক তার প্রতিবেদনে বলেছেন, ১১ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষে পোপের বিশ্রাম করার কথা ছিল বলেই ওইদিন কোনও আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি রাখা হয়নি। তবে কার্ডিনাল চার্লস মং বো পোপকে শীর্ষ সেনাকর্মকর্তা মিন অং হ্লাংয়ের সঙ্গে দেখা করার নির্দেশনা দেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিয়ানমারের কার্ডিয়াল পোপকে বৈঠকের তাগিদ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। ভ্যাটিক্যান প্রতিবেদককে তিনি জানান, পোপ এই নির্দেশনা না মানলে মিয়ানমারের খ্রিস্টান স¤প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন নেমে আসতে পারত।
সিনিয়র জেনারেলের দাফতরিক ফেসবুক পাতায় দেওয়া এক পোস্ট অনুযায়ী, পোপকে স্বাগত জানিয়ে দাবি করা হয়েছে, মিয়ানমারে কোনও সা¤প্রদায়িক বিভেদ নেই। সেখানকার কর্তৃপক্ষ সব স¤প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। সেনাবাহিনীও কারও প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে না। ভ্যাটিকানের মুখপাত্র এ নিয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত কিছু জানাননি সোমবার। অনুষ্ঠিত বৈঠককে অনানুষ্ঠানিক আখ্যা দিয়ে তিনি সোমবারের প্রতিবেদনে বলেছেন, চলমান গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে।
পোপ ফ্রান্সিস প্রথমবারের মতো সোমবার দুপুরে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে পৌঁছান রোহিঙ্গা প্রশ্ন সঙ্গে নিয়ে। ক্যাথলিক স¤প্রদায়ের কয়েক হাজার সদস্য তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও সংগীতের মাধ্যমে পোপকে শুভেচ্ছা জানায়। এদিকে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা তাকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনও কথা না বলার হুমকি দেয়। এক কঠিন কূটনৈতিক পরীক্ষার জমিনে দাঁড়িয়ে আছেন ইতিহাসের আলোচিত এই ক্যাথলিক ধর্মগুরু। তিনদিনের সফর শেষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের উদ্দেশে নেপিদো ছাড়বেন তিনি। সূত্র : বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্স।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পোপ

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ