Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শান্তির অগ্রদূত হযরত মোহাম্মদ (সা.)

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে আরবি হিজরি ক্যালেন্ডারের ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) আরবের মক্কা মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের কিছুদিন পূর্বে পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ৬ বছর বয়সে মাতা আমিনাও পারলৌকিক জীবনে প্রস্থান করেন।
হযরত মোহাম্মদ (স.) ১০ বছর বয়সেই সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে হিলফুল ফুজুল নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। মানবাধিকার ও সমাজসেবা এ সংগঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মক্কার অভিজাত মহিলা খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায় সহযোগিতা শুরু করেন। সিরিয়া ও ইয়েমেন প্রদেশে দু’বার বাণিজ্যিক সফর করেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সাথে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করেন। ফলে বিধবা মহিলা খাদিজা (রা.) তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। খাদিজার বয়স তখন ৪০ বছর। ২৫ বছরের তরুণ হযরত মোহাম্মদ (স.) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন খাদিজা (রা.)।
হযরত মোহাম্মদ (স.) তাঁর ৩৭ বছর বয়স থেকে মক্কার হেরা গুহায় ধ্যান শুরু করেন। ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট সোমবার রাতে হেরা গুহায় তিনি প্রত্যক্ষ ওহি লাভ করেন। স্বর্গদূত জিব্রাইল (আ.) নিয়ে এলেন স্রষ্টার অমৃত বাণী। তখন তিনি রসুল ও নবী খেতাব অর্জন করলেন। ৬১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন, তখন থেকে একদল লোক হযরতকে নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে। তাঁকে উপহাস, অপমান করতেও ছাড়েনি তারা। তবু থেমে থাকেননি তিনি। মক্কার অলিতে-গলিতে নিয়ে গেলেন ইসলামের বার্তা। শত্রæরা তাঁর সাথে সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব পাঠায়। তাঁকে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার লোভ দেখানো হয়। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে ৬০ মাইল দূরে তায়েফ শহরে ইসলাম প্রচার করতে যান। সেখানে মানুষকে আহŸান জানালেন শান্তির পথে পরিচালিত হওয়ার। কিন্তু মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। তাঁর উপর শুরু হয় পাথরবৃষ্টি। মাথা ফেঁটে রক্ত ঝরে। শরীরের তাজা রক্ত পায়ে জমাট বেঁধে যায়। তখন স্বর্গদূত জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, হে নবী, আপনি যদি বলেন, তাহলে আল্লাহ সাফা এবং মারওয়া নামক দুটি পাহাড় একত্রিত করে গোটা তায়েফের প্রতিটি মানুষকে ধ্বংস করে দিবেন। নিঃশেষ করে দিবেন তায়েফের প্রান্তর। তিনি বলেন- না, খোদা ওরা বোঝেনি, ওরা নির্দোষ, ক্ষমা করে দাও ওদেরকে।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে নবীকে হত্যা করার জন্য একটি সংগঠন তৈরি হয়। আবুজাহেল ছিলেন এ সংগঠনের নেতা। ঐ বছর প্রায় সকল মুসলমান মদিনা শহরে হিজরত করেন। মানুষ নবীর কাছে অনেক সম্পদ আমানত রেখেছিল। মানুষের জমাকৃত আমানত হযরত আলী (রা.)’র কাছে রেখে হযরত মোহাম্মদ (স.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার জনতা বোঝেনি তাঁর ভালবাসার ভাষা, বোঝেনি হৃদয়ের আর্তি। বাধ্য হয়ে তিনি মদিনা শহরে হিজরত করলেন। মদিনার জনতা প্রাণ খুলে আহŸান জানায় তাঁকে। আনন্দে উল্লসিত হয়ে দু’হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়। তবুও হযরত মক্কার জনগণকে অভিশাপ দেননি, আবারও ফিরে এসেছিলেন জন্মভূমিতে। জয় করলেন শত্রæদের হৃদয়। মদিনা শহরে মহাসমারোহে শুরু হলো ইসলামের প্রচার। অজস্র মানুষ ইসলামের শীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ৬২৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মসজিদ-এ নববী নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ক্রমে সর্বত্র ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন হতে থাকল। মদিনায় নতুন শাসন ব্যবস্থা চালু হলো। এ সময় মদিনায় বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনতার সাথে একটি চুক্তি করেন তিনি। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে তিনি পবিত্র মক্কা অভিযান করেন। বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি বিরলতম ঘটনা। মক্কার আমজনতাকে তিনি বুকে টেনে নিলেন। প্রতিশোধমূলক কোন কথাই বলেননি। ক্রমশঃ ইসলাম ধর্ম গোটা আরবে বিস্তার লাভ করে। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রয়ারিতে ১ লক্ষ ২৪ হাজার অনুসারী নিয়ে তিনি মক্কায় হজ্জ পালন করলেন। আরাফাত প্রান্তরে বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মে হিজরি ক্যালেন্ডারের ১১তম বর্ষের ১২ রবিউল আউয়াল হযরত মোহাম্মদ (দ.) পারলৌকিক জীবনে প্রস্থান করেন।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে মানুষের ইহলৌকিক জীবন ও পারলৌকিক জীবনের প্রতিটি সমস্যার বাস্তব সমাধান দেখিয়েছেন। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, পারিবারিক জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনের সব সমস্যার সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তিনি পবিত্র হাদিসে বর্ণনা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার নিজের স্ত্রীর কাছে উত্তম সে সর্বত্র উত্তম।’ এ কথায় বোঝালেন একজন স্বামীকে তার স্ত্রীর সব প্রয়োজন মেটাতে হবে। স্ত্রীর দৈনন্দিন প্রয়োজন, স্ত্রীর সব ধরনের চাহিদা মেটানো একজন প্রকৃত ‘উত্তম’ স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রীকে বাড়িতে ফেলে রেখে পাহাড়ে গিয়ে দিনরাত উপাসনা করলে নবীর প্রিয় হওয়া যাবে না। স্ত্রীর সাথে মধুর সম্পর্ক ও প্রেম-প্রীতি ভালোবাসাকে মর্যাদা দিয়েছেন তিনি। নবী বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটোকে স্নেহ ও বড়দের শ্রদ্ধা করে না সে আমার উম্মত নয়।’ সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনের সমাধানের তিনি সহজ পথ দেখিয়েছেন। সঠিকভাবে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে তিনি তা হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম বা কোনো অনুগত নাগরিককে অত্যাচার করবে অথবা তার ন্যায্য প্রাপ্য কম দিবে বা তার উপর অতিরিক্ত কর চাপাবে, অনুমতি ছাড়া তার কোনো দ্রব্য হস্তগত করবে এরূপ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি মহাবিচারের দিন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদি হব।’ বিশ্বনবী প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আজীবন নিরলস চেষ্টা করেছেন। তাই তাঁকে ‘শান্তির অগ্রদূত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন