Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গা নিয়ে ভারতের বিভ্রান্তিকর নীরবতা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দক্ষিণ এশিয়া সফর করলেন পোপ। আট লাখ ৩৬ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ও পুনরোত্রীকরণের উদ্দেশে তিনি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেন। অভিবাসন বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইএমও) মতে ২৫ আগস্ট থেকে কমপক্ষে ৬ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে নৃশংস সহিংসতা থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এ অভিযানে পোপ একাই নন। গত মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে মিয়ানমারে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সিনিয়র টিম, বৃটিশ ও কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রীরা বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছেন।
সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের রাজধানী ন্যাপি’ড এবং বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সফর করেছেন। তিনি এই সঙ্কটে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্য সহায়তার ক্ষেত্র বের করায় ভূমিকা রেখেছেন। নভেম্বরের শুরুর দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি, জার্মান, সুইডেন ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শনে যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে ভারতীয় কোনো নেতা ওই আশ্রয় শিবিরগুলো পরিদর্শন করেননি।
চীন অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের জড়িত করে না। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এটা তাদের অবস্থানের এক বিরল পরিবর্তন। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মধ্যস্থতা করায় একটি ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গিয়েছিলেন ঢাকায়। তিনি ১৮ নভেম্বর সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। এরপর তিনি ন্যাপিডতে সাক্ষাত করেছেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতিন কাইওয়ার সঙ্গে। ক’দিনের মধ্যে রোহিঙ্গাদেরকে দু’মাসের মধ্যে রাখাইন প্রদেশে ফিরিয়ে নেয়া শুরু করার বিষয়ে একটি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রস্তাবিত তিন দফার অংশ এ প্রক্রিয়া।
এখানে উল্লেখ করার বিষয় হলো একই সপ্তাহে চীন সফরে গিয়েছিলেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। উদ্দেশ্য রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে অধিকতর আলোচনা করা। অন্যদিকে মিয়ানমারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি তিনদিনের জন্য উড়ে যান বেইজিং। কূটনৈতিক এই ব্যাপক তৎপরতায় ভারত কেন এতটা নীরব, এতটা কোমলতা প্রদর্শন করছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এমনিতেই এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় দুই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তেই থাকে তাহলে এতে আক্রান্ত হওয়ার বড় ঝুঁকিতে রয়েছে ভারতও। তাই ভারতের উচিত এই সংকটে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখানো। তার পরিবর্তে ধারাবাহিক ভুল করে যাচ্ছে ভারত। এর শুরু হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজের মিয়ানমার সফরের মধ্য দিয়ে। মিয়ানমারকে তার সত্য গোপনে অনুমোদন দিয়েছে ভারত। নিজ দেশে ভয়াবহ সহিংসতায় যখন হাজার হাজার মানুষ পালাচ্ছিলেন তখন সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ন্যাপি’ডতে সংবাদ সম্মেলনে মোদি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে অস্বীকৃতি জানান। যখন রাখাইনে সহিংসতা নিয়ে আলোচনার পর্ব আসে তখন শুধু আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির সন্ত্রাসী হামলার কথা বাদে অন্য প্রসঙ্গ আনেনি ভারত।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচার পর দু’দিন পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। তাতে শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য রোহিঙ্গা সঙ্কট তখন উদ্বেগজনক হারে বা এলার্মিং মাত্রায় পৌঁছেছে। এটাকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এখন জাতি নিধন বলে উল্লেখ করছে। উপরন্তু ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ৫০ জাতির পার্লামেন্টারিয়ান কনফারেন্সের ঘোষণা অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানায় ভারত। কারণ, ওই ঘোষণায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি উল্লেখ করা হয়েছিল। এমন কি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভুটান ও শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ বালি’র ওই ঘোষণা অনুমোদন দিয়েছে। পরে সেপ্টেম্বরে সরকার ‘অপারেশন ইনসানিয়েত (হিউম্যানিটি)’ নামের অধীনে মানবিক ত্রাণ সহায়তা পাঠানো শুরু করে ভারত সরকার। এ অভিযানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, আজারবাইজান, মালয়েশিয়া ও অন্য আরো অনেকে। এর মধ্যে অন্যতম দেশ হলো ভারত। গত সপ্তাহে সরকার মিয়ানমারে ৩ হাজার পরিবারের কাছে সহায়তা হিসেবে ‘ফ্যামিলি ব্যাগ’ পাঠায়। কিন্তু রাখাইনের ভিতরে বাস্তুচ্যুত বিপুলসংখ্যক মানুষ ও তাদের জরুরি সহায়তার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারত যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর। এ সফরে তিনি রিাহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শনের জন্য সময় পাননি। অন্য দেশগুলো যা করেছে এটা তার বিপরীতমুখীই নয় শুধু, একই সঙ্গে ভারতের নিজের যে রেকর্ড রয়েছে তারও বিপরীত এটা। যে কোনো অর্থে রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি ভয়াবহ বিষয়। এতে প্রায় ১০ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু অবর্ণনীয় দুর্দশায় বসবাস করছে মিয়ানমারে ও বাংলাদেশে। ভারতের একটি প্রচলিত রীতি আছে। তারা দ্রæততার সঙ্গে মানবিক সহায়তা পাঠায়, চিকিৎসা সেবা, চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবক পাঠায় অন্য দেশগুলোতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২০০৪ সালের সুনামির পরের কথা, ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস মিয়ানমারে আঘাত করার পরের কথা, ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের পরের কথা। কিন্তু ভারত রোহিঙ্গা সঙ্কটে হাতপা গুটিয়ে বসে আছে বলেই দৃশ্যত দেখা যায়।
অন্যদিকে জাতিসংঘেও ভারতের কণ্ঠ উচ্চকিত নয়। তারা অন্য দেশকে এ ইস্যুতে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের পাশাপাশি মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে একটি বৈঠক আয়োজন করে বৃটেন। এতে যোগ দেন ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেন, ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র কর্মকর্তারা। এরপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে থার্ড কমিটির ভোটে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধের আহŸান সম্বলিত একটি প্রস্তাবে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে ভারত। মিয়ানমারে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১৩৫টি দেশ। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোটদানে বিরত থাকে ২৬টি দেশ। তার মধ্যে ভারত অন্যতম। হস্তক্ষেপমূলক এই প্রস্তাবে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভোট ছিল। কিন্তু তারা কোনো রকম নেতৃত্ব প্রদর্শন করেনি। যদি তারা তা করতো তাহলে তা বাংলেোদশের পক্ষে ভারতের অবস্থান সুদৃঢ় করতো। এই বাংলাদেশ এই অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের অন্যতম। এ দেশটির নেতৃত্ব শরণার্থীর প্রবাহ নিয়ে এক রকম লড়াই করছে। আগামী বছর কঠোর নির্বাচনের মুখে প্রধানমন্ত্রী। সংক্ষেপে বলা যায়, মিয়ানমারে এবারের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর ভারত যত পদক্ষেপ নিয়েছে আঞ্চলিক, উপমহাদেশীয় ও এশিয়ার নেতৃত্ব হিসেবে ভারতের সেসব পদক্ষেপ নেতিবাচক। এই মর্যাদা ফিরে পেতে সঙ্কট সমাধানের অংশ হতে অনেক বেশি কিছু করতে হবে। এটা করতে প্রথমেই যা করতে হবে তাহলো ২০১২ সাল থেকে ভারতে বসবাস করছে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। সরকার তাদেরকে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বলা হচ্ছে, এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে। তবে এ বিষয়ে সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে যে, ভারতের এমন সিদ্ধান্তের পিছনে কোনো আন্তর্জাতিক আকাঙ্খা নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো ইস্যুতে যতক্ষণ ভারত কাজ করতে না পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতকে এই প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে তার উদ্বেগ জানিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সমাধান হতে হবে ত্রিদেশীয়। এই কাজটি চীনের চেয়ে ভারতের জন্য সহজ হবে। কারণ, বিমসটেকের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে তারা কাজ করেছে।
ভারতকে তার শরণার্থী নীতিতে আভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যে সব অসঙ্গতি আছে সেদিকে নজর দিতে হবে। ভারত জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কোনো কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। যখন প্রতিবেশীরা বিপদে পড়ে তখন তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার এক গর্বিত রীতি চর্চা করে ভারত। ১৯৬০ এর দশকে তিব্বতের মানুষকে, ১৯৭০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানিদের (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৯৮০’র দশকে লঙ্কানদের ও ১৯৯০-এর দশকে আফগানদের আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। স¤প্রতি প্রতিবেশী বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সহিংসতার কারণে যেসব সংখ্যালঘু পালিয়ে ভারতে যাচ্ছেন তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দেয়ার আইন পরিবর্তন করেছে মোদি সরকার। এখন যদি ভারত বলে যে, তারা রোহিঙ্গাদের সহায়তা করবে না, তারা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু। তাহলে তারা হয়তো এটাই বলতে চায় যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মানুষ নন। আর না হয় ভারতের প্রতিবেশী নয় মিয়ানমার। এ দু’টি বিষয়ই ভারতের আগের অবস্থানের সঙ্গে সংঘাতময়। সরকার আদালতে যুক্তি তুলে ধরেছে যে, রোহিঙ্গারা ভারতে সন্ত্রাসী হুমকি। তবে এমন কথা শ্রীলঙ্কা বা আফগানদের ক্ষেত্রে বলা হয়নি। আঞ্চলিক প্রতিটি ধর্ম চর্চার একটি দেশ ভারত। তাদেরকে এই ভূমিকা জোরালো করতে হবে। এজন্য ভারত একটি ব্যতিক্রমী দেশ। এসব কারণে, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শাসনযন্ত্রে উচ্চমাত্রায় ভূমিকা থাকায় ভারতকে অবশ্যই রোহিঙ্গা ইস্যুতে কণ্ঠ উচ্চকিত করতে হবে। সীমান্তের সঙ্গে লাগোয়া একটি প্রতিবেশী দেশে যখন সবচেয়ে বড় মানবিক ট্র্যাজেডি চলছে তখন ভারত যদি আমতা আমতা করে তাহলে তাতে তার বৈশ্বিক নেতৃত্বের যে উচ্চাকাঙ্খা তা প্রকাশ পায় না। (অনলাইন দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ