Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি প্রতিষ্ঠায় রাসূল স.

মাওলানা এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ | প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

\ শেষ \

রাসূলে কারীম (সা.)-এর ঘরে এক ইহুদি মেহমান হয়ে আসল। রাসূল (সা.) তাকে যথাযথ মেহমানদারী করলেন এবং রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। ইহুদি মেহমান অসুস্থতাবশত বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে, রাসূল (সা.) তাকে কিছু বলবেন এই ভয়ে সে প্রভাতের আগেই ঘর থেকে পালিয়ে যায়। ভোরে ওই ময়লাযুক্ত বিছানা দেখে রাসূল (সা.) এ মর্মে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে, হায়! আমি ওই ব্যক্তিকে যথাযথ মেহমানদারী করতে পারিনি; হয়তো সে কষ্ট পেয়েছে। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানা পরিষ্কার করলেন এবং ঐ ব্যক্তির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন, ভাই আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে। আমি আপনার কোন যতœ করতে পারিনি। এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন ইহুদি লোকটি বলল, অপরাধ করলাম আমি আর ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি। ইসলামের আদর্শ তো সত্যিই মহৎ! অতঃপর রাসূল (স.)-এর এমন উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরূপ উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও জাগরণ ঘটেছে।
হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সমাধান: ৬০৫ সালে মক্কায় প্লাবনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কাবা সংষ্কারের সময় হাজরে-আসওয়াদ স্থাপনকে কেন্দ্র করে গোত্রসমূহের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের উপক্রম হয়। এই সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে আবু উমাইয়া বিন মুগীরা বললেন- আগামীকাল প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যিনি প্রথম প্রবেশ করবেন, তার ফায়সালা সবাই মেনে নেব। আর এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নিরসনে ৩৫ বছরের যুবক সত্যাশ্রয়ী মুহাম্মদ স. কে সর্বপ্রথম মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখে উদিগ্ন জনতা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলতে লাগল- হে আমাদের আল-আমিন! আমরা সকলেই তোমার মীমাংসায় সম্মত। এভাবেই রাসূল স. নিশ্চিত সংঘর্ষ লিপ্ত হওয়া গোত্রসমূহকে রক্ষা করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার অনুপম নজির রেখে গেছেন।
মদিনার সনদে সা¤প্রদায়িক স¤প্রতির নজির স্থাপন: রাসূল স. সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির শুধু থিওরি দিয়েই ক্ষান্ত হননি। সমাজ ও রাষ্ট্রে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকে প্রাকটিক্যালি রূপদান করেছেন তিনি। মদিনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ(সা.) মদিনাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তখন মদিনা ছিল পৌত্তলিক, ইয়াহুদি ও মুসলিম এই তিন স¤প্রদায়ের লোকের একটি আবাসভূমি। রাসূলুল্লাহ(সা.) লক্ষ করলেন, এই স¤প্রদায়গুলোর মধ্যে স¤প্রীতি স্থাপিত না হলে মদিনার শান্তি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই বিশ্ব শান্তির দূত মুহাম্মদ (সা.) মদিনাবাসীকে একটি লিখিত শান্তির সনদ দান করেন। সনদে প্রত্যেক স¤প্রদায়ের নেতারা স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সনদকে বলা হয় মদিনা সনদ। মদিনা সনদই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বা সংবিধান এবং শান্তি-স¤প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন “সনদে স্বাক্ষরকারী সকল গোত্র-স¤প্রদায় ‘মদীনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সকল ধর্মস¤প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোন স¤প্রদায় বহিঃশত্রæ কর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত স¤প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোন নাগরিক কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।” (ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ)। এভাবে ঐতিহাসিক মদীনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের মাঝে সৌহার্দ-স¤প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন।
মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম ধর্ম কোন বিরোধ চায় না, শান্তি চায়। মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শত্রæতা চায় না, মৈত্রী চায়। মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম কঠোরতা চায় না, উদারতা চায়। মদিনা সনদই সাক্ষ্য দেয়, ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার সমান। রাষ্ট্রীয় জীবনে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামই দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম বাস্তব আদর্শ স্থাপন করে, মদিনা সনদই তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
হুদায়বিয়ার সন্ধিতে সা¤প্রদায়িক স¤প্রতির নজির স্থাপন: মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশক’টি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্তে¡ও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুহাম্মদ (সা.) তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর সন্ধিতে মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সাথে ‘রাসূলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আর আপনার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লায় যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল (সা.) হযরত আলী (রা.) কে বললেন ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লিখ। এতে হযরত আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসূল (সা.) নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন।
আউস-খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মাঝে সম্প্রীতি স্থাপন: আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- জমীনের মধ্যে তোমরা ফাসাদ সৃষ্টি করো না। মহানবী স. এর হিজরতের প্রাক্কালে মদীনার দু’টি পরাক্রমশালী গোত্র ( আউস ও খাযরাজ) দীর্ঘ দিন ধরে পারস্পারিক দ্বন্ধে লিপ্ত ছিল। এক পর্যায়ে এ দ্বন্ধ ভয়াবহ যুদ্ধের আকার ধারন করলে মহানবী স. অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে উক্ত গোত্রদ্বয়ের বিরোধ মীমাংসা করেন এবং উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে সিসা ঢালা প্রাচীরের মত ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সেতু স্থাপন করে দেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরষ্পরে শত্রæ। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা পরষ্পরে ভাই ভাই হয়ে গেছো।” ( সূরা আলি ইমরান-১০৩)
মক্কা বিজয়ের দিনে অমুসলিমদের অভয়দান: ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (স.) বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী (স.) বিজিত শত্রæদের প্রতি কোন ধরণের দুর্ব্যবহার করেননি এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ প্রতিশোধস্পৃহাও প্রকাশ করেননি, বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো বলে তোমরা মনে করো? তারা বললো, ‘আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসূল (স.) বললেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেনÑ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সকলেই মুক্ত। (সূরা ইউসুফ- ৯২)
উপসংহার: সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার যে, রাসূল (স.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম স¤প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে জায়েজ নেই। সহিংসতা তো দূরের কথা অন্য ধর্মের প্রতি সামান্য কটূক্তিও না করার জন্য কুরআনে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমরা তাদের মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে।” (আনআম-১০৮)।

লেখক: সভাপতি: বাংলাদেশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদ, টাঙ্গাইল জেলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ