Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চলে গেলেন চট্টলবীর কাঁদো চট্টগ্রাম কাঁদো

| প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম ও রফিকুল ইসলাম সেলিম : সবাইকে কাঁদিয়েই চলে গেলেন চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। বীরমুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের গণমানুষের নেতা। আজীবন সংগ্রামী এই প্রবীণনেতা জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চট্টগ্রামের স্বার্থে ছিলেন আপোসহীন। চট্টগ্রামের স্বার্থে নিজ সরকারের বিরুদ্ধেও রাস্তায় নেমেছেন তিনি। এই কারণে তিনি ছিলেন চাটগাঁর প্রিয় নেতা। বিদায় বেলাও তিনি পেয়েছেন লাখো মানুষের ভালবাসা। তাকে শেষ বিদায় জানাতে তার বাসভবনে হাজির হয়েছিলেন সব রাজনৈতিক দলের নেতারা। জানাজাতেও ছিল দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার মানুষের ভিড়। আহাজারি আর চোখের পানিতে প্রিয় নেতাকে বিদায় জানিয়েছেন তারা।
এক মাসের বেশি সময় সিঙ্গাপুর ও রাজধানী ঢাকায় চিকিৎসা শেষে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতেই চট্টগ্রামে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে উঠেন তিনি। আর নিজ ঘরে ফেরার মাত্র তিনদিনের মাথায় চাটগাঁবাসীকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন প্রবীণ এ নেতা। তাকে হারিয়ে এখন শোকের সাগরে ভাসছে চট্টগ্রাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কারাবরণ করেছেন, ফেরারি হয়েছেন অনেকবার। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। পর পর তিন দফায় নির্বাচিত হয়ে ১৭ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। এসময়ে চট্টগ্রামের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে তার যে সাফল্য তা নজিরবিহীন। তার স্মৃতি নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডের অলিতে-গলিতে। চট্টগ্রামের উন্নয়নের পক্ষে আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে যাদের নিয়ে রাজপথে তিনি ছিলেন সোচ্চার তারা এখন অভিভাবক হারালেন। অভিভাবক হারানোর শূন্যতায় হাহাকার সকলের হৃদয়ে। আওয়ামী লীগের নেতাদের পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও বলছেন, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে চট্টগ্রাম দরদী একজন জননেতা। তার এ শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। তার ইন্তেকালে চট্টগ্রাম অভিভাবক হারিয়েছে।
১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজানের গহিরায় জন্মগ্রহণ করেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ছাত্রজীবনে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠতা তার। ৬ দফার আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এরপর মুক্তিযুদ্ধে গ্রেফতার হয়ে জেল থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদী হয়ে উঠে মহিউদ্দিন চৌধুরী। একপর্যায়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে দেশে এসে দীর্ঘনি ফেরারী জীবনযাপন করেন। আওয়ামী লীগের এ কাÐারী মহানগরীর দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পরে হন সভাপতি। রাজনীতির শুরু থেকে যেখানে অন্যায়-অবিচার সেখানে সোচ্চার হন তিনি। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে আসা শত শত লাশ নিজহাতে দাফন করেন তিনি। একই বছর বন্দরটিলা এলাকায় নৌবাহিনীর সাথে এলাকাবাসীর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত থামাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামে মহিউদ্দিন চৌধুরী। তার এসব ভূমিকা চট্টগ্রামের মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। এরপর ১৯৯৪ সালের প্রথম মেয়র নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তিনি। এর আগে ১৯৯১ ও ১৯৮৬ সালে রাউজান এবং মহানগরীর একটি আসনে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন তিনি। তবে ১৯৯৪ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর টানা তিনবার হ্যাট্রিক বিজয় অর্জন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। মেয়র থাকাকালে মহানগরীর ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি মেয়র হজ কাফেলার মাধ্যমে হাজীদের সেবা করে ব্যাপক প্রশংসিত হন তিনি। জিয়াউর রহমান, এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া এবং সর্বশেষ ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় কারাবন্দি হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বন্দি থাকা অবস্থায় কারাগারে অন্য দলের রাজনৈতিক নেতাদের সেবাও করেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে পতেঙ্গা মার্কিন কোম্পানীর বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তিনি। রাজপথের আন্দোলনে তার সরকার বিব্রত হলেও তিনি চট্টগ্রামের স্বার্থে সে আন্দোলন চালিয়ে যান। অবশেষে বন্দর নির্মাণ না করে ফিরে যায় মার্কিন কোম্পানী এসএসএ। নগরীতে গৃহকর বৃদ্ধির প্রতিবাদেও তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন। মূলত তার প্রতিবাদের মুখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অকপটে সত্য বলতেন তিনি। সত্য কথা দলের বিরুদ্ধে গেলেও তাতে তিনি পিছপা হতেন না।
এসব ভূমিকায় প্রশংসিত হন তিনি। আলাদা করে পরিচয় ও বিশেষণে ভূষিত না করলেও সমগ্র দেশের মানুষের কাছে পরিচিত একটি নাম আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামবাসীর তাকে দেওয়া উপাধিটি হচ্ছে ‘চট্টলবীর’। বিগত ১১ নভেম্বর তিনি বাসায় হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রাতেই তাকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় পরদিন ১২ নভেম্বর তাকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কিছুটা উন্নতি হলে চিকিৎসকদের পরামর্শে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ১৫ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি হৃদরোগ, ডায়বেটিস ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন দীর্ঘদিন যাবত। সিঙ্গাপুরে তাকে অস্ত্রোপচার করার পর অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এরমধ্যে তিনি চট্টগ্রাম ফিরে আসতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তিনদিন আগে একটি মাইক্রেবাসে করে ঢাকা থেকে সড়কপথে চট্টগ্রাম চলে আসেন তিনি। মাত্র দুই দিনের মাথায় তার অবস্থার অবনতি হয়। গতকাল ভোরে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের খবরে চশমাহীলের বাসায় হাজারে মানুষের ঢল নামে। শোকার্ত নেতাকর্মীদের কান্না আর আহাজারি চলছে সেখানে। আওয়ামী লীগসহ সব দলের নেতারা ছুটে যান তাকে দেখতে। সেখানে সবাই তার স্মৃতিচারণ করছেন। নেতারা বলছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন গণমানুষের নেতা। সবদলের কাছে ছিল তার গ্রহণযোগ্যতা। তার ইন্তেকালে চট্টগ্রাম অভিভাবক হারিয়েছে বলেও মন্তব্য অনেকের। মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন নগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। পুত্র মুহিবুল হাসান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে রাজনীতিতে যে সৌজন্য ও সৌন্দর্য অতীত থেকেই রেওয়াজী ধারার মতোই চলে আসছে তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। দল-মত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদে-আপদে, জানাযায়, নিজ হাতে লাশের কাফন-দাফন এবং বিয়ে-শাদিতেও সবার আগেই তাকে ছুটে যেতে দেখা যায়। তিনি গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও চট্টগ্রামের রাজনীতির সৌন্দর্যবোধ ফুটে উঠেছে পুনরায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময়ে এবং দেখার জন্য এ পর্যন্ত ছুটে গেছেন চট্টগ্রামের নেতা অনেকেই। শুধুই তাই নয়; মহিউদ্দিন চৌধুরী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এ যাবত চাটগাঁর সর্বস্তরের মানুষ তার শারীরিক অবস্থার প্রতিনিয়তই খোঁজ-খবর নিয়েছেন, দোয়া করেছেন আশু সুস্থতার জন্য। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক ছাড়াও বিপরীত মেরুর বিএনপির কর্মীরাও তার সুস্থতা কামনা করছেন। তার হঠাৎ গুরুতর অসুস্থতায় প্রকাশ করে চলে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। তবে চিকিৎসা শেষে ফিরে আসায় সকলে আশাবাদি ছিলেন, তিনি ফের গণমানুষের পাশে আসবেন। তবে তা আর হলো না। তাকে চলে যেতেই হলো। তার ইন্তেকালের পর বাসভবনে এবং জানাজায় লাখ লাখ মানুষের ঢল প্রমাণ করে তিনি সকলের কত আপন ছিলেন। এর মধ্যদিয়েই মহিউদ্দিন চৌধুরীর পাহাড়সম জনপ্রিয়তার দিকটি সুস্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। চাটগাঁর একজন ‘পপুলার লীডার’ বা জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তার আসনটি তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাকে হারিয়ে চট্টগ্রামবাসী আপনজন হারানোর বেদনায় এখন শোকার্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ