Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রয়োগ

জেরুজালেম ইস্যুতে ১৫ সদস্যের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ১৪ রাষ্ট্রের সমর্থন

ইনকিলাব ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আরব দেশগুলোর নিন্দা : মধ্যস্থতা করার আগ্রহ প্রকাশ রাশিয়ার
জেরুজালেম ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত এক খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেওয়ার ও ওই শহরে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে এই খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল।
খবরে বলা হয়, এ প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, সেটা আগে থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল। গত ছয় বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করলো। নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল মিসর। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, জেরুজালেমের মর্যাদা প্রসঙ্গে যেকোনও সিদ্ধান্তের ‘কোন আইনি ভিত্তি নেই, এ সিদ্ধান্ত অকার্যর এবং একে প্রতিহত করতে হবে’।
ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধিতা থেকে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হলেও এতে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র বা ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে জেরুজালেমের অবস্থান নিয়ে স¤প্রতি যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর ‘তীব্র নিন্দা’ জানানো হয় এতে।
নিরাপত্তা পরিষদে ভোটগ্রহণ শেষে জাতিসংঘে মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি নিক্কি হ্যালে বলেন, ‘আজ নিরাপত্তা পরিষদে যা দেখলাম, তা স্পষ্টতই অপমান। আমরা এটা ভুলে যাবো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফিলিস্তিনের জন্য জাতিসংঘ যে ভালোর চেয়ে খারাপটাই বেশি করছে, এটা তারই আরেকটি প্রমাণ। ইহুদিদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মাতৃভূমি হিসেবে জেরুজালেম ছাড়া তাদের আর কোনও রাজধানী কখনোই ছিল না। তবে জেরুজালেম ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিলেও মার্কিন মিত্রদেশগুলোসহ পরিষদের বাকি ১৪টি দেশই এতে সমর্থন দিয়েছে। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেওয়ার পরই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল বিভিন্ন দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করবে বলেই আশঙ্কার কথা জানান বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর বলেন, ‘আমরা সবাই যখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শান্তিপূর্ণ একটি পরিকল্পনার প্রত্যাশা করছিলাম, তখন দেশটি শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ইসরাইলকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে আরও বেশি অপরাধ করতে এবং আমাদের ভূমিতে তাদের দখলদারি মনোভাব অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত করবে।’
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের একজন মুখপাত্রও যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, এমন সিদ্ধান্ত ‘অগ্রহণযোগ্য এবং এটা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ এটা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে অসম্মান করেছে।’
তবে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য নিক্কি হ্যালেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এক টুইটে নেতানিয়াহু বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত হ্যালেকে ধন্যবাদ জানাই। আপনি সত্যের আলো জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করেছেন। আপনি একা হয়েও পরাজিত করেছেন অনেককে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আপনাকে ধন্যবাদ। নিক্কি হ্যালে, আপনাকে ধন্যবাদ।’
উল্লেখ্য, গত ৬ ডিসেম্বর জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির কথাও জানান ট্রাম্প। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
আরব দেশগুলোর নিন্দা
জেরুজালেম প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উত্থাপিত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেওয়ার সমালোচনা করেছে আরব দেশগুলো। প্রস্তাবটিতে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতিসহ যেকোনও ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত বাতিলের কথা বলা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রদানের পর দেশটির সমালোচনা করেছে মিসর, ফিলিস্তিন, কুয়েত ও কাতার।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আহমেদ আবু যিয়েদ এক লিখিত বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান ও আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রদান করায় মিসর দুঃখ পেয়েছে।’ জেরুজালেমের মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য জাতিসংঘে আরব দেশগুলো একত্র হবে বলেও উল্লেখ করেন আবু যিয়েদ।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের নিন্দা জানিয়ে একে ‘আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের প্রতি উপহাস ও ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের সমর্থন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ওয়াফা এ খবর জানায়। আবু রুদেইনা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের বিরক্তির উদ্রেগকারী এই ভেটো যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।’
ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী আন্দোলনের সংগঠন হামাস একটি লিখিত বিবৃতিতে বলেছে, ‘জেরুজালেম চিরদিনই ফিলিস্তিনের রাজধানী। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সিদ্ধান্ত এই সত্যকে পরিবর্তন করতে পারবে না।’
বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়, আরব ও ইসলামি বিশ্বের প্রতি জেরুজালেমকে সংরক্ষণের আহ্বান জানায় হামাস। একই সঙ্গে জেরুজালেমের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনে ইসরাইলকে কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয় সংগঠনটি।
কুয়েত পার্লামেন্টের স্পিকার মারজুক আলী আল গানিম এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, ‘জেরুজালেমকে ইসরাইলের বলে স্বীকৃতির একতরফা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত প্রমাণ করেছে আমরা একা নই। আমাদের আসল লক্ষ্য হলো একটি মুক্ত বিশ্ব।’ বিবৃতিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আন্তর্জাতিক গণভোটের মতো একটি প্রস্তাব উত্থাপন করায় মিসরকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক মুসলিম পন্ডিতদের সংগঠন-আইইউএমএস’র পক্ষ থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ‘সব দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও চ্যালেঞ্জ’। কাতারভিত্তিক সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আলী কারাদাঘি এক টুইট বার্তায় এ মন্তব্য করেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের জেরুজালেম নীতির বিষয়ে বিশ্বজুড়ে তুমুল নিন্দা ও প্রতিবাদ জারি রয়েছে। ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলোসহ মার্কিন অনেক মিত্র দেশও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
এর আগে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রস্তাবটিতে নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্যেরই অনুমোদন জেরুজালেম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের অবৈধতা নির্দেশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভেটো জাতিসংঘকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে। তবে তুরস্ক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও এর জনগণের পক্ষেই অবস্থান নেবে।’
জাতিসংঘে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ফ্র্যাঙ্কয়েস ডেলাট্রেও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে বলেন, ‘এই খসড়া প্রস্তাব যুগ যুগ ধরে জেরুজালেম প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মতৈক্যের প্রতিফলনকেই নিশ্চিত করেছিল। এটা পাস না হওয়াটা দুঃখজনক।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর পর ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্কট সমাধানে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে রাশিয়া। জাতিসংঘে দেশটির সহকারী রাষ্ট্রদূত ভøাদিমির সাফ্রোনকোভ বলেন ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সরাসরি সমঝোতার বিষয়টি দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।’ সে সময় তিনি ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি নেতাদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের আহ্বান জানান। বৈঠকে রাশিয়া ‘একজন সৎ মধ্যস্থতাকারী’ হতে প্রস্তুত বলেও জানান তিনি। রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করে সাফ্রোনকোভ নিরাপত্তা পরিষদকে ‘মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ’ দেওয়ার আহ্বান ও জানান। সূত্র : আল-জাজিরা, বিবিসি, এএফপি ও আনাদোলু।



 

Show all comments
  • কাজল ২০ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১:৩৬ এএম says : 0
    এই ইসরাইলই একদিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনের কারণ হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জেরুজালেম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ