Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাপার বিশাল জয় ও আ.লীগ-বিএনপির শোচনীয় পরাজয়ের নেপথ্যে

হালিম আনছারী, রংপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রংপুর সিটি কর্পোরেন নির্বাচন নিয়ে রংপুরবাসীর কৌতুহলের শেষ নেই। গতকালও নগরবাসীর মুখে মুখে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রসিক নির্বাচন। তবে গতকাল যে বিষয়টি সবার মুখে মুখে ছিল সেটি হলো জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফার ব্যাপক ভোট বিপ্লব। নির্বাচন মোস্তফার জয়ের বিষয়টি ক’দিন আগে থেইে নগরবাসীর কাছে অনেকটা নিশ্চিত থাকলেও এত বিশাল ভোটের ব্যবধানের বিষয়টি সবার কাছেই ছিল অকল্পনীয়। খোদ জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরাও কখনও কল্পনায় আনেননি এত বিশাল ভোটের ব্যবধান। বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন করছেন সচেতন মহল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরফুদ্দিন ঝন্টুর লজ্জাজনক ভরাডুবির জন্য ব্যক্তি ঝন্টুকেই দায়ী করেছেন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। নির্বাচনে অপর পরাজিত বিএনপির প্রার্থী কাওছার জামান বাবলার ভোটের হিসেব নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষন। তার ভোটের সংখ্যা কম হওয়ার পেছনে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অসহযোগিতাকেই দায়ী করেছেন অনেকেই। অনেকেই আবার মন্তব্য করেছেন ব্যক্তি বাবলাকে নিয়েও।
সাধারণ দৃষ্টিতে রসিক নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে মনে হয় রসিকের গত নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট অনেক বেশি বেড়েছে। সামান্য বেড়েছে বিএনপির। আর অনেকটাই কমে গেছে আওয়ামী লীগের। কিন্তু ভেতরের চিত্রটা একটু ভিন্ন। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন হয ২০১২ সালে। ঐ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবারের মূল তিন প্রার্থী। সেই সময় জাতীয় পার্টির একাধিক প্রার্থী থাকায় ভোট ভাগাভাগি হয়ে যায় এবং বাজিমাত করেন সরফুদ্দিন আহমদ ঝন্টু। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫টি। এবার তিনি পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট। তার কমেছে ৪৪ হাজার ভোট।
আর জাপার দুই প্রার্থীর মধ্যে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। এবারে তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে। তার ভোট বেড়েছে প্রায় ৮৪ হাজার। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আরেক নেতা আব্দুর রঊফ মানিক পেয়েছিলেন ৩৭ হাজার ২০৮ ভোট।
মোস্তফা তখন উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন। সাবেক পৌর মেয়র জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রউফ মানিক পেয়েছিলেন ৩৭ হাজার ২০৮ ভোট। এ সময় জাপা চেয়ারম্যান মেয়র পদে প্রথমে মশিউর রহমান রাঙ্গা এবং পরবর্তীতে দফায় দফায় সমর্থন পরিবর্তন করায়। জাতীয় পার্টির দায়িত্বশীল অনেকেই প্রকাশ্যে ঝন্টুর পক্ষে কাজ করেন। ফলে জাতীয় পার্টির ভোট দুই ভাগে বিভক্ত ছাড়াও একটি অংশ চলে যায় ঝন্টুর ভোট বাক্সে। যে কারনে ওই নির্বাচনে ঝন্টু খুব সহজেই বাজিমাত করেন। মেয়রের পদটি হাতছাড়া হয়ে যায় জাতীয় পার্টির। ঐ নির্বাচনে দুই প্রার্থী না থাকলে অর্থাৎ দু’জনের ভোট যোগ করলে ঝন্টুর প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও অনেক বেশি হয়। জাপার একক প্রার্থী থাকলে বিগত নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করতো এটা নিশ্চিত ছিল। বিষয়টি হাড়ে হাড়ে অনুভব করে এবার জাপা চেয়ারম্যান আগে থেকেই একজনকে তথা মোস্তফাকেই প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়ে তার পক্ষেই ভোট চেয়ে বেড়িয়েছেন।
মোস্তফার বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়ের নেপথ্যে
বিজ্ঞজনদের মতে, মোস্তফা ব্যক্তি হিসেবে অনেক ভালো। নিরহঙ্কার ও সাদামাটা। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, সামাজিক অবস্থান, আচার-আচরণ সবটাই কালিমা মুক্ত। মাটি ও মানুষের নেতা হিসেব সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে এসে বিগত সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। তখন জাতীয় পার্টি তার পক্ষে ছিল না। বরং বিপক্ষে কাজ করেছে। ওই নির্বাচনে মোস্তফা যে ভোট পেয়েছিলেন সেটি তার ব্যক্তি ইমেজেই পেয়েছিলেন। সুতরাং ধরা যায় ভোটের অংকটি তার নিজস্ব। আর এবারে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ অনেক আগে থেকেই তাকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মাঠে কাজ করেছেন। সে কারনে মোস্তফার ভোট এবং জাতীয় পার্টির ভোট মিলে ভোটের অংকটি গত নির্বাচনের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ঝন্টুর পরাজয়ের নেপথ্যে
সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর পরাজয়ের নেপথ্যের কারন হিসেবে ব্যক্তি ঝন্টুকেই দায়ী করছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে তার দুর্ব্যবহার নগরবাসীকে তার কাছ থেকে দুরে ঠেলে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তার দুর্ব্যবহারের কারনেই মুলত তিনি জনগণ থেকে ছিটকে পড়েছেন। আর সে কারনেই তিনি তার নিজস্ব ভোট কেন্দ্রেও লজ্জাজনক ভাবেই পরাজিত হয়েছেন। বিজ্ঞজনরা মনে করেন আওয়ামীলী প্রার্থী ঝন্টু যা ভোট পেয়েছেন তার পুরোটাই দলীয় ভোট। ব্যক্তি ঝন্টু কোন ভোট টানতে পারেননি, শুধুমাত্র তার মুখ এবং ব্যবহারের কারণে। অনেকেই বলেছেন, একমাত্র তার আচরণের কারণে দলের নেতাকর্মীদেরও অনেকেই তাকে ভোট দেননি। সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ৯১ সালে রংপুর পৌরসভার নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে রংপুর-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তার পরাজয়ের বিষয়টি অনেকটাই আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিলেন সচেতন মহল। কিন্তু এতটা ভোটের ব্যবধান ছিল সবার কাছেই কল্পনাতীত।
যে কারণে অনেকটা পিছিয়ে বাবলা
রংপুরে ভোটের অংকে বিএনপি বরাবরই পিছিয়ে। রংপুরের কোনো আসনেই বিএনপি সাধারণত জিততে পারে না। এবারের প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা গত সিটি নির্বাচনেও প্রার্থী ছিলেন। সেই নির্বাচনে তার অবস্থান ছিল চতুর্থ। তিনি তখন পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৩৫ ভোট। এবারের নির্বাচনে অবশ্য তার ভোটের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। তিনি পেয়েছেন ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট। সিটিতে অবাঙ্গালী ভোট রয়েছে প্রায় ২২ হাজারের অধিক। অবাঙ্গালীদের ভোটগুলোর অধিকাংশই বিএনপির পক্ষে যায়। তাছাড়া জামায়াতের ভোট আছে প্রায় ২৫ হাজারের অধিক। সব মিলে বিএনপির একটা বড় সুযোগ ছিল এবারের নির্বাচনে। কিন্তু দলীয় কোন্দল ও স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মীদের অসহযোগিতার কারনেই বিএনপি প্রার্থী বাবলা এখানে ভালো অবস্থান করতে পারেননি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেষ দিকে এসে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের তৎপরতা দেখে বিস্মিত হয়েছেন নগরবাসী। তাদের দৃষ্টিতে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী কাওছার জামান বাবলার পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে গণসংযোগ ও তৎপরতা চালিয়েছেন তার অর্ধেক তৎপরতা ছিল না স্থানীয় বিএনপির। দলীয় কোন্দলের কারণেই মুলতঃ কয়েকজন নেতাকর্মী ছাড়া বাবলার পাশে ছিলেন না তেমন কেউ। তাদের মতে, বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে থেকে শেষ মুহূর্তে এসে যেভাবে এখন তৎপরতা চালাচ্ছেন তা আগে থেকে চালালে বিএনপি আরও অনেক এগিয়ে যেতে পারতো। অনেক বড় একটি সুযোগ হাতছাড়া করলো বিএনপি
পাত্তাই পেলেন না এরশাদের ভাতিজা
রংপুরের মাটি এরশাদের ঘাঁটি। সেটার প্রমাণ দিয়েছে রংপুরবাসী। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এরশাদের প্রার্থী মোস্তফা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। এই নির্বাচনে এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফও প্রার্থী ছিলেন। চাচার কথা উপেক্ষা করে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার ঘোষণা দেন। পরে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন এরশাদ। ফলে ভোটের লড়াইয়ে তিনি পাত্তাই পাননি। হারিয়েছেন জামানতও। সর্ব সাকুল্যে ভোট পেয়েছেন দুই হাজার ৩১৯টি।
জানা যায়, আসিফ এই নির্বাচনে লাঙ্গল পেতে পারিবারিকভাবে অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত এরশাদ তার শহরে দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন জনপ্রিয় নেতা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে। পরে আসিফ বিদ্রোহী হিসেবে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন।
গত ৮ ডিসেম্বর ভাতিজা আসিফকে দল থেকে বহিষ্কার করেন দলীয় প্রধান এরশাদ। তবে আসিফ বলিষ্ঠভাবে বিশ্বাসী ছিলেন তাকে নগরবাসী বাছাই করবে। নির্বাচনে মার্কা কোনো ফ্যাক্টর হবে না। কিন্তু এরশাদ প্রিয় রংপুরের মানুষ বাস্তবে ফল দেখিয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনে তার এই বিপুল পরাজয়ে তিনি অনেকটা মুষড়ে পড়েছেন। ফল ঘোষণার পর তিনি কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন না। তাকে এখন ফোনেও পাচ্ছেন না সাংবাদিকরা। এরশাদের ছোট ভাই মরহুম মোজাম্মেল হোসেন লালুর ছেলে শাহরিয়ার আসিফ। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি রংপুর-১ আসনে জাপা থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দেখাল ইসলামী আন্দোলনের চমক
রংপুরেও অনেকটা চমক দেখিয়েছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। রংপুরে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে দলটি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কাছাকাছি তাদের ভোটের সংখ্যা।
গত বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে রংপুরে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী এটিএম গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন ২৪ হাজার ছয় ভোট। মোট ৭ জন প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারী প্রার্থীর মধ্যে তিনি চতুর্থ স্থান দখল করে নিয়ে অনেকটা চমক দেখিয়ে দিয়েছেন।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ