Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থীর সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার চেয়ে প্রতীকের গুরুত্ব বেশি প্রাধান্য পায়। প্রতীক এমন একটি জিনিস, প্রার্থী যতই মন্দ মানুষ হন না কেন, প্রতীকই তার সব দোষ ঢেকে দেয়। এক্ষেত্রে প্রতীক এক ধরনের ‘ওয়াশিং মেশিন’-এর মতো কাজ করে। যেমন নৌকা, ধানের শীষ, লাঙল- এই তিনটি প্রতীক নিয়ে যেসব প্রার্থী নির্বাচন করে সমর্থকরা তাদের পছন্দ না করলেও ভোটটি পছন্দের প্রতীকে ঠিকই দেয়। কারণ এটি প্রার্থীর প্রতীক নয়, দলের প্রতীক। দলকে ভালবাসার কারণে অপছন্দের প্রার্থীকেও ভোট দিতে হয়। তবে দলীয় সমর্থকের বাইরে যেসব সাধারণ ভোটার রয়েছে, তারা ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দলের সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়টি বিবেচনা করে। বাংলাদেশের রাজনীতি যেহেতু প্রধানত দুইটি ধারায় বহমান, তাই ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতার বিষয়টি ভোটারদের কাছে বিচার্য বিষয় হয়ে উঠে। তার সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়টি বিশ্লেষণ করে পুনরায় ভোট দেয়ার বিষয়টি স্থির করে। ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হলে অটোমেটিক্যালি বিরোধী দলের দিকে ভোটটি চলে যায়। বিরোধী দল তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সরকারের সাথে কতটা তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছে, তা খুব একটা আমলে নেয় না। মূল দুই দলের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু দলের প্রার্থীও বিজয় লাভ করে। তারা মার্কার ইমেজে জয়ী হয় না, ব্যক্তি ইমেজে বিজয়ী হয়। এজন্য দলের বাইরে কিছু স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যকে দেখা যায়। রংপুরে যে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল তাতে জাতীয় পার্টি বিজয় লাভ করলেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির যথেষ্ট হিসাব-নিকাশের বিষয় রয়েছে।
দুই.
বৃহত্তর রংপুর মূলত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির ভিত্তিভূমি। এ অঞ্চলের আসনগুলোতে জিতেই দলটি রাজনীতিতে টিকে আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে কদর পাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। রংপুরে আধিপত্য দিয়েই এক সময় এরশাদ বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবী করেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে, বৃহত্তর রংপুর প্রদেশ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের ভিত্তিতে তার দায়িত্ব এরশাদের উপরই বর্তাবে। এতে পুনরায় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার অতৃপ্তি ও আফসোস কিছুটা হলেও হয়তো গুচবে। যদিও তার আশা ছিল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাকে প্রেসিডেন্ট করবে। তার এ আশা পূরণ হয়নি। তিনি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এই পদের কাজ কি তা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। অবশ্য তারা অন্তত এটা বুঝতে পেরেছে, এই পদ এরশাদকে সান্ত¦না দেয়া ছাড়া কিছুই নয়। এরশাদও যে বোঝেন না, এমন মনে করার কারণ নেই। তবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা যে একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। শেষ বয়সে হলেও পুনরায় তার প্রেসিডেন্ট পদে বসার ইচ্ছার কথা ইতোমধ্যে রাজনীতি অঙ্গনে ছড়িয়েছে। এরশাদের এ ইচ্ছার পেছনে হয়তো তার ক্ষোভ-দুঃখ লুকিয়ে থাকতে পারে। যাদের প্রবল আন্দোলনের মুখে যে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে একদিন অনিচ্ছা সত্তে¡ও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই তাদের দ্বারাই যদি পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়া যায়, তবে একদিকে যেমন মধুর প্রতিশোধ নেয়া যাবে, তেমনি আত্মতৃপ্তিও পাওয়া যাবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তার এই সুপ্ত বাসনাও যে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাকামী দুই প্রধান দলের কাছে ব্যক্ত হবে না, তা এখনই গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। তিনি এখন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আছেন। তবে এই থাকা যে তার আনপ্রেডিক্টেবল আচরণের কারণে অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে, তা ক্ষমতাসীন দলও জানে। প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি যে তাকে জোটে ভেড়াতে টোপ দেবে না, তার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। ইতোমধ্যে এরশাদের সাথে বিএনপির যোগাযোগের কথাও শোনা গেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাজনীতিতে আলাপ-আলোচনা হতেই পারে। এর শেষ বলে কিছু নেই। তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিএনপি এরশাদকে তার জোটে নিতে চেষ্টার ত্রæটি করবে না। আবার ক্ষমতাসীন দলও এরশাদকে আরও তোয়াজ করে এবং কিছু লোভনীয় আশ্বাস দিয়ে জোটে রাখতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এরশাদের প্রার্থীকে জয়ী করতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার কথা উঠেছে। অর্থাৎ এরশাদের প্রার্থীকে জয়ী করে তাকে খুশি করতে সমঝোতা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ ভোটের দিনই এরশাদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ধন্যবাদ জানান। এর অর্থ হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সহায়তা করেছে। সরকার যদি না চাইত, তবে এরশাদের প্রার্থী বিজয়ী হতে পারত না। সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছে বলেই সুষ্ঠু হয়েছে। হস্তক্ষেপ করলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ছাড়া আর কোনো দলের প্রার্থীর বিজয়ী হওয়া একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠত। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী যে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে, তাতে তারও কারিশমা রয়েছে। লাঙল মার্কার পাশাপাশি তার ব্যক্তি ইমেজ, সর্বোপরি এরশাদের রংপুরÑচিরায়ত এই ধারারই বিজয় হয়েছে। আর রংপুরে এরশাদের এতই প্রভাব যে, জেলে থেকে নির্বাচন করেও তিনি জিতেছেন। রংপুরের মানুষ ‘হামাক ছাওয়াল’ বলে তার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছে। এরশাদ ছাড়া রংপুর বাসীর কাছে আরও কেউই ‘হামাক ছাওয়াল’ হতে পারেনি। আর তিনি যখন তার মনোনীত প্রার্থীকে ‘হামাক ছাওয়াল’ বলেন, তখন সেখানের ভোটাররাও তা মেনে নেয়। রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এরশাদ বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তিনি এখন এ কথা বলতেই পারেন, তার সাথে সমঝোতা ছাড়া আগামীতে আর কোনো দল ক্ষমতায় যেতে পারবে না। তার এ ধারণা অমূলক নয়। বিগত জাতীয় নির্বাচনে একমাত্র বিএনপি ছাড়া আওয়ামী লীগ যে কয়বার ক্ষমতায় এসেছে, তা এরশাদের সঙ্গে জোট বেঁধেই এসেছে। ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে এরশাদের সঙ্গে জোট বাঁধার কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে।
তিন.
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ফলাফলের উপর প্রভাব ফেলবে না বলে দল দুইটির পক্ষ থেকে বলা হলেও এ থেকে একটি ইংগিত পাওয়া যায়। রংপুর মূলত জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাটি। তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী আওয়ামী লীগ। তৃতীয় অবস্থানে বিএনপি। ২০১২ সালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও তার প্রার্থী ছিল জাতীয় পার্টি থেকে আসা। ফলে তার নিজের বা জাতীয় পার্টির একাংশের ভোট ও আওয়ামী লীগের ভোট যুক্ত হয়ে বিজয়ী হয়েছিল। সেবার জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী ছিল নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী। বিএনপি বরাবরের মতোই ছিল তৃতীয়। এবারও তৃতীয় হয়েছে। তবে দলটির ভোট বেড়েছে। গতবার প্রায় ২১ হাজার ভোট পেলেও এবার পেয়েছে ৩৫ হাজারের বেশি। ভোট বৃদ্ধির হারে তা প্রায় ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে প্রায় ৪০ থেকে ৪১ শতাংশ। জাতীয় পার্টিকে আলাদা রাখলে বলা যায়, নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে প্রায় ২৭ হাজার ভোট বেশি পেলেও দলটির ভোট কমেছে। বলা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সরকারে অন্তর্ভুক্ত জাতীয় পার্টির সম্মিলিত এলাকায় বিএনপির ভোট বেড়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণ ক্ষমতাসীন দলের উপর বিরক্ত। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন, চাল, পেঁয়াজ, বিদ্যুৎসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং সুশাসনের অভাবের কারণে সরকারের প্রতি জনসাধারণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটা তাদের ক্ষোভের প্রকাশ। এ ফলাফল আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারি দলের জন্য একটি সিগন্যাল। আবার কেউ বলেছেন, জনসাধারণ ‘ফ্যাটিগ ফেস’ বা একই চেহারা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তারা পরিবর্তন চায়। তাদের পরিবর্তন চাওয়ার এই মনোভাব আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। ভোটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, তারা অদল-বদল করে দেশ পরিচালনা দেখতে চায়। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল যত ভাল রাষ্ট্র পরিচালনা করুক না কেন, জনসাধারণের তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিরোধী দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। অর্থাৎ জনসাধারণ যদি তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর মতো নির্বাচন পায়, তবে তারা পালাক্রমে দুই দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে থাকে। সাধারণ অর্থে, জনসাধারণ ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বরাবরই অসন্তুষ্ট থাকে। এই অসন্তুষ্টি থেকে তারা বিরোধী দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। ২০১৪ সালের নির্বাচনটি যদি তার আগের ধারাবাহিকতায় হতো, তবে বিএনপি ও তার জোট যে ক্ষমতায় আসত, তা অনেকটাই অনুমিত ছিল। কারণ ঐ নির্বাচনের আগে দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর বিপুল বিজয় সেই আভাসই দিচ্ছিল। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘাটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুরেও বিএনপির প্রার্থীর বিজয় জাতীয় নির্বাচনে তার বিজয়ের সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। অথচ এসব সিটি করপোরেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়ররা এলাকায় বেশ ভাল কাজ করেছিলেন। তারপরও তাদের হারতে হয়েছে। সে সময় জাতীয় নির্বাচনেও যে বিএনপি ব্যাপক বিজয় লাভ করবে তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বুঝতে পেরেছিল। ফলে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা বিএনপি ও তার জোটকে বাইরে রেখে জোর করেই একটি ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করে। জনগণের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যে ছেদ টানে। পরবর্তীতে বিভিন্ন উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ভোটারদের ভোটের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতাসীন দল জবরদস্তিমূলক নির্বাচন করে। বলা যায়, জনগণ বহু বছর ধরে তাদের ইচ্ছামতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। জনগণ যদি অবাধে ভোট দেয়ার সুযোগ পায় এবং সরকার যদি কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করে তবে বিরোধী দলের প্রার্থীর যে বিজয় লাভের বেশি সুযোগ থাকে তা ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সরকার খুব বেশি হস্তক্ষেপ না করায় বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছে। আবার নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাটি হিসেবে পরিচিত হওয়ায় প্রভাব বিস্তার ছাড়াই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভির নিজস্ব জনপ্রিয়তা মূল ভূমিকা পালন করে। একইভাবে রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাটি হওয়ায় তার প্রার্থী বিজয় লাভ করেছে। এক্ষেত্রেও নামকাওয়াস্তে বা সমঝোতার বিরোধী দলই বিজয়ী হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হতে পারেনি। এসব অঞ্চলভিত্তিক বা স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না বলে বলা হলেও সারা দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। সাধারণত বিভাগীয় শহর বা জেলা শহরগুলোর ভোটের প্রভাব গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। যেভাবে রাজধানীর আন্দোলন-সংগ্রাম সারা দেশে ছড়ায়। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের যে শাসন ব্যবস্থা চলছে, তাতে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে অনুভব করা কষ্টকর হবে না যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে। এমনিতেই ক্ষমতাসীন দল যত ভাল কাজ করুক না কেন, ‘এন্টি ইনকামবেন্ট সেন্টিমেন্ট’ বা সরকার বিরোধী মনোভাব সবসময়ই কম-বেশি থাকে। তার উপর ভোট থেকে বঞ্জিত করে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আসা সরকারের উপর ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারায় ক্ষমতাসীন দলের উপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে সৃষ্টি হয়েছে, তা আঁচ করা যায়। তাদের এ ক্ষোভ কাজে লাগানোর যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি হলে দেখা যাবে, ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরশন নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় তার ইঙ্গিত দেয়। এটি আরও স্পষ্ট হতে পারে আগামী ফেব্রæয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। যদিও অনেকে সন্দেহ পোষণ করছেন শেষ পর্যন্ত হয়তো সরকার এ নির্বাচনটির আয়োজন করবে না। আর যদি সুষ্ঠুভাবে হয় এবং তাতে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় হয় তবে এর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার এ ঝুঁকি নাও নিতে পারে। কাজেই মুখে যতই বলা হোক না কেন, স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না, এটা সর্বাংশে সঠিক নয়। আগামী বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে। এসব নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তাতে এন্টি ইনকামবেন্ট সেন্টিমেন্টেরই প্রতিফলন ঘটতে পারে। তার প্রভাব যে ছয় মাস পরের জাতীয় নির্বাচনে সুস্পষ্টভাবে পড়বে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
চার.
এন্টি ইনকামবেন্ট সেন্টিমেন্টকে বিএনপি কতটা কাজে লাগাতে পারে তা এখন দেখার বিষয়। রংপুরের মতো প্রতিপক্ষের হার্ডকোর এলাকায় দলটির যে ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে, তা তার জন্য ইতিবাচক। দলটিকে এই ক্ষুদ্র সংখ্যক ভোটারদের মধ্য থেকেই স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করা উচিত। প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল করার জন্য ব্যাপক সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির উপর জোর দেয়া জরুরী। ভোট বর্জন নয়, ভোটে থেকেই অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দেয়ার মতো শক্তি দলটিকে সঞ্চয় করতে হবে। সরকার তাদের কীভাবে এবং কতটা দমন-পীড়ন চালাতে পারে, তা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই দলটিকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন এগার মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এ সময়টিকে কাজে লাগাতে তাদের ব্যাপক পরিশ্রম করতে হবে। একই সাথে জোটের পরিধি বৃদ্ধি করে একটি শক্তিশালী বলয় গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের সখ্য ঐতিহাসিক। সব দল যখন এরশাদবিরোধী তুমুল আন্দোলন করছে, তখন দেখা গেছে আওয়ামী লীগ তার অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং বিরোধী দলে বসেছে। পরবর্তীতেও এই দুই দলের সখ্য অটুট রয়েছে। মাঝে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হলেও রহস্যজনক কারণে এরশাদ বের হয়ে যান। অর্থাৎ বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টির আদর্শগত অনেক মিল থাকলেও তাদের জোটবদ্ধ হতে দেখা যায়নি। আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনটি যে জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা সকলেই জানে। বিএনপির অস্তিত্বের জন্য তো আরও গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় মাথায় রেখে জোটের পরিধি বৃদ্ধিতে দলটিকে অধিকতর কৌশলী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে জোটভুক্ত করতে যৌক্তিক সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, রংপুর এরশাদের ঘাটি হলেও সব আসনেই তার গড়ে পাঁচ থেকে দশ হাজার ভোট রয়েছে। এই ভোটই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জয় পরাজয়ে ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিশ্চয়ই এ হিসাব জানে। এ হিসাব কষেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরশাদকে খুশি করতে এবং জোটে রাখতে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার প্রার্থীকে বিজয়ী করে উপহার দিয়েছে বলে খোদ জাতীয় পার্টির অনেক নেতা মনে করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও একই ধারনা পোষণ করেছেন। এরশাদ যতই বলুক, তার দল আগামী নির্বাচনে এককভাবে নির্বাচন করবে, আদতে তা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শেষ পর্যন্ত তিনি দর কষাকষির মাধ্যমে জোটভুক্তভাবেই নির্বাচন করবেন। কারণ পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এরশাদের নীতি হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের সাথে থাকা। যে দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে তার কাছে প্রতীয়মান হবে, সেই দলের সাথেই সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দর কষাকষি করে জোটভুক্ত হবে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কাজেই রাজনীতিতে শেষ বলে কথা নেইÑএ সূত্র অবলম্বন করে বিএনপি যদি এরশাদকে জোটভুক্ত করতে পারে, তবে বর্তমানে দলটি যে রাজনৈতিক জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে তার যেমন পরিবর্তন হবে, তেমনি ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় নির্বাচন


আরও
আরও পড়ুন