Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মিয়ানমারের পর আসাম থেকে মুসলমান বিতাড়ন চরম দুর্ভাগ্যজনক

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গত রবিবার ২০১৭ সাল শেষ হয়ে যাওয়ায় সোমবার শুরু হয়েছে নতুন বছর ২০১৮ সাল। স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে কেমন গেছে বিদায়ী বছরটি এবং তার আলোকে কেমন যেতে পারে নতুন বছর ২০১৮। বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল রোহিঙ্গাদের জন্মভূমি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে দলে দলে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণজনিত সমস্যা। আন্তর্জাতিক বিশ্বের ক্রমাগত চাপের মুখে মিয়ানমার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে এক পর্যায়ে রাজী হলেও যাদের সর্ব প্রথম ফিরিয়ে নেয় তারা ছিল হিন্দু, যদিও রোহিঙ্গাদের সিংহভাগই মুসলমান। এতে প্রমাণিত হয় মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা নামে মুসলমান বিতাড়নই ছিল মিয়ানমার সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
নতুন বছরে বাংলাদেশ শরণার্থী সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছে কিনা, সে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যে তথ্য পাওয়া গেছে তার আলোকে বলতে হয়, মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী সমস্যার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও নতুন বছরে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ভোগান্তির অবসান হবার পরিবর্তে এ সমস্যা বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। এবার বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসাম রাজ্য থেকে বাংলাদেশের জন্য শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির আশংকা নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায়ই এমন ধারণা জনমনে সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদের জন্য এমন ক্ষতিকর পদক্ষেপ গ্রহণ কীভাবে সম্ভব হতে পারে সে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে পত্রিকা-পাঠকদের একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গত বছরের ২৫ আগস্ট নতুন করে রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু হওয়ার পর যে দেশের প্রধান মন্ত্রী সর্বপ্রথম মিয়ানমারে শুভেচ্ছা সফরে যান, সে দেশটিই ছিল বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে ব্যাপক পরিস্থিতি লাভকারী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। সে সময় যে দলটি প্রতিবেশী দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, আজও সে দলটিই যে দেশে ক্ষমতাসীন রয়েছে। শুধু তাই নয়। যে দলটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন রয়েছে, সেই একই দল ভারতের অন্যতম রাজ্য আসামের রাজ্য সরকারেও ক্ষমতাসীন রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাত্রই জানেন, এককালে ভারত সারা বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেও বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে হিন্দুত্ববাদের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতাসীন তো রয়েছেই, ভারতের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামের যে প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি একদা ধর্মানিরপেক্ষতার আদর্শ বিশ্বাসী ছিল, দেশে হিন্দুত্ববাদের জয়জয়কার দেখে তারাও বিজেপির অনুকরণে নিজেদেরকে হিন্দুত্ববাদী প্রমাণের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তার প্রমাণ মিলেছে অন্যতম রাজ্য গুজরাটের সাম্প্রতিক নির্বাচনে। যদিও সে নির্বাচনে ৯৯টি আসন লাভ করে বিজেপি নির্বাচনে রাজ্য পরিষদে প্রধান দলে পরিণত হয়েছে, তবুও যে নির্বাচনে কংগ্রেস ৮০টি আসন লাভ করে বিজেপির আত্মবিশ্বাসে বেশ খানিকটা হলেও চিড় ধরাতে সক্ষম হয়।
গুজরাট ভারতের ক্ষমতাসীন প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য। তাঁর দল রাজ্য সংসদ নির্বাচনে ১৫০টি আসন পাবে এমন ঘোষণা দেন তিনি নির্বাচনী প্রচারণাকালে। কিন্তু যখন ফলাফল প্রকাশিত হল, দেখা গেল ১৫০ তো দূরের কথা, তাঁর নিজের রাজ্যে তাঁর দল ১০০টি আসনও পেল না, পেল মাত্র ৯৯টি আসন। অন্যদিকে কংগ্রেস ৮০টি আসন লাভ করে সকলকে অবাক করে দিল। এটা কেমন করে সম্ভব হলো? কংগ্রেসের নতুন সভাপতি রাহুল গান্ধী নির্বাচনী প্রচারণাকালে বিজেপির অস্ত্রেই বিজেপিকে ঘায়েলের চেষ্টা করাতে এমনটি সম্ভব হয়। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী নির্বাচনী সফরে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় যে এলাকায় তিনি সফরে যান প্রথমেই গেছেন মন্দিরে। মন্দিরে পূজা দিয়েই শুরু করেছেন নির্বাচনী প্রচারণা। এভাবে হিন্দুত্ববাদের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাটে রাজ্য সংসদ নির্বাচনে ৮০টি আসনে কংগ্রেসকে জয়ী করতে সক্ষম হয়েছেন।
ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদের এই বিশেষ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বিজেপি-শাসিত আসাম রাজ্যেও। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন থেকে এ আশংকাই ঘনীভূত হচ্ছে। গত সোমবার দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল : “আসামে অবৈধ হতে পারেন লাখ লাখ মুসলমান।”প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘ভারতের আসামে বিতর্কিত নাগরিক তালিকায় বাদ পড়তে পারেন লাখ লাখ মুসলমান। গতকাল রবিবার ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন্স’ নামে বিতর্কিত এক তালিকার খসড়া প্রকাশ হবার কথা। প্রথম অবস্থাতেই লাখ লাখ মুসলমান বাদ পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর বিবিসির
আসামের সাংবাদিক অমল গুপ্ত জানিয়েছেন, বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হচ্ছে, নাগরিকদের জাতীয় রেজিস্ট্রার এন আর সির এই খসড়ায় শুরুতেই তালিকা থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মুসলমান বাদ পড়বেন। অমল গুপ্ত বলেছেন, রবিবার যে তালিকা প্রকাশ হচ্ছে, তাতে আড়াই কোটি জনগোষ্ঠির আসামে এই তালিকা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাদ পড়বে। এ নিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত বড়পেটা, ধুবরি, করিমগঞ্জ, কাছাড়সহ বিভিন্ন জেলার জনগোষ্ঠির মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ বিরাজ করছে।
বিতর্কিত তালিকা প্রকাশের পর সম্ভাব্য সহিংসতা দমনে আসাম জুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর পঞ্চাশ হাজার বাড়তি সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গুপ্ত। তিনি বলেছেন, শনিবার রাতে আসামের মুখ্য মন্ত্রী এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, কয়েক ধাপে নাগরিকদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রথম ধাপে যারা বাদ পড়বেন, দ্বিতীয় ধাপে তাদের নাম আসতে পারে, না হলে তৃতীয় ধাপে নাম আসবে। তবে এ ধরনের বক্তব্যে শঙ্কা কমছে না মুসলমানদের মধ্যে।
‘আসামের মুসলমান নেতারা বলছেন, নাগরিকদের বিতার্কিত তালিকাটি প্রকাশ করা হচ্ছে আসামের মুসলমানদের রোহিঙ্গাদের মত রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত করার জন্য। ১৯৫১ সালের পর আসামে প্রথমবারের মত পরিচালিত এক জনগণনার ভিত্তিতে এই ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন্স’ তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী দল গত বছর আসামে ক্ষমতায় আসার পর তাদের ভাষায় ‘রাজ্যের অবৈধ মুসলিম বাসিন্দাদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। বিজেপি নেতারা দাবী করেন, ভারতের আসাম রাজ্যে প্রায় বিশ লাখ মুসলমান রয়েছেন যাদের পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগ থেকেই যে তারা আসামে থাকতেন, এরকম দলিল-প্রমাণ হাজির করলেই কেবল তাদের ভারতের নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হবে।’
আসলে কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি আসামে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই আসামে বসবাসরত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হওয়ায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে এটা শাসক দলের সাম্প্রদায়িক নীতির কুপ্রভাবেই সংঘটিত হয়েছে। আসামে দীর্ঘদিন ধরে যারা বসবাস করছেন তাদের যদি অন্যায়ভাবে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তা হবে বাংলাদেশের প্রতি চরম অবিচার। আসাম সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেও চিড় ধরতে বাধ্য। কারণ আমরা ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করতে চাই এবং সে লক্ষ্যে ভারতের উপকার হয় এমন অনেক সুযোগ সুবিধা ভারতকে দেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের কোন রাজ্য বাংলাদেশের প্রতিবেশী হওয়ার সুযোগে যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলে অন্যায়ভাবে, তা আমরা বরদাস্ত করবো না এক দিনের জন্যও।
আন্ত:রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্ব কোন বিবেচনায়ই এক পক্ষীয় ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও ভারত বা ভারতের কোন রাজ্য কর্তৃপক্ষ যদি সে বন্ধুত্বের মূল্য না দিয়ে ক্রমাগত আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে, এবং সে রাজ্যের মুসলমান নাগরিকদের জন্মগত অধিকার অস্বীকার করে সাম্প্রদায়িক একদর্শিতার পরিচয় দান অব্যাহত রাখে, তা আমাদের কাছে কিছুতেই গ্রহণযোগ্য পাবে না। ভারতের বাংলাভাষা ভাষী নাগরিকদের মধ্যেও ধর্মীয় ভিত্তিতে কেন্দ্র করে যদি ভেদরেখা টানা হয় তা কোন ক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অথচ বিজেপি-শাসিত ভারতীয় রাজ্য আসামে এ ব্যাপারেও সাম্প্রদায়িক নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে অত্যন্ত উৎকটভাবে। বাংলা ভাষী মুসলমানদের পারত পক্ষে বাংলাদেশী ও অবৈধ নাগরিক ঘোষণা করে বাংলাদেশের তাড়িয়ে দিয়ে আসামকে মুসলমান শূণ্য করার পাশাপাশি বাংলাভাষী হিন্দুদেরকে বাংলাদেশে নিপীড়নের শিকার বলে চরম মিথ্যাচার করে আসামে আশ্রয় দেয়ার নামে তাদের ভারতীয় নাগরিক ঘোষণার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের অপবাদ দিতে চান তার মত জঘন্য মিথ্যাচার আর কিছু হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসাবে যে সুনাম অর্জন করেছে, তা একটি দেশের একটি রাজ্যের কতিপয় রাজনৈতিক মতলববাজের অপপ্রচারের কারণে অসত্য হয়ে যাবে না।
পরিশেষে আমরা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত আসামের বিজেপি নেতৃত্বকে আহ্বান জানাবো তাদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির নীতি পরিহার করে বাংলাদেশের মত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত হিসাবে আসামকে গড়ে তোলার আন্তরিক প্রয়াস চালাতে। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের মত আসাম ভারতীয় রাজ্য হওয়া সত্তে¡ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ব স্রস্টাকে আমার আল্লাহ, ভগবান বা গড যে নামেই ডাকি, হিন্দু-মুসলিম সকল মানুষই তাঁর কাছে সমান, কারণ তিনি সকল মানুষেরই স্রস্টা ও প্রতিপালক।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ