Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভেঙে পড়ছে চেইন অব কমান্ড

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কোথাও অসহায়ত্ব, কোথাও দাম্ভিকতা, কোথাও হতাশা, অধিকন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে আমলা ও তাদের প্রভূদের আধিপত্য এখন সর্বত্র। আমলারা এখন অপ্রতিরোধ্য। এর পিছনের কারণ, বর্তমান সরকার এখন আমলানির্ভর। এছাড়া সরকারের কোন উপায়ও নেই। কারণ সরকার জানে, সে অনির্বাচিত। জনগণের ভোটে যখন সরকার নির্বাচিত নয়, সেহেতু আস্থার প্রশ্নে সরকার ও জনগণ পারষ্পারিক বিরোধী অবস্থানে যেমন থাকার কথা তেমনি রয়েছে। গণতন্ত্র হত্যার জন্য বা গণতন্ত্রের পথ নিয়ন্ত্রণ বা রুদ্ধ করার জন্য আমলাদের বর্তমান কর্মকান্ডই যথেষ্ট, এর বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না। আমলারাও ‘গণতন্ত্রবিহীন’ সমাজ ব্যবস্থা পছন্দ করে। কারণ গণতন্ত্র থাকলে মানুষের মত প্রকাশসহ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দ্বারাই গুরুতর অপরাধ সংক্রামিত হওয়ার একমাত্র কারণ, তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। গত ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় পত্রিকান্তরে প্রকাশ ‘গত ১১ আগস্ট দুপুর ১২ ঘটিকায় ধুরাইল বাজারে সিরাজুল ইসলামের দোকানের সামনে থেকে ঝর্ণা বেগমকে ধরে নিয়ে যায় ওসি কামরুল ইসলাম মিয়া। থানায় নিয়ে তার নিকট ৫ লক্ষ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ঐদিন রাত ৩ ঘটিকার দিকে ঐ নারীকে ওসি’র রুমে নিয়ে আসে। এ সময় ধুরাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওরাবেস উদ্দিন সুমন ও ওসি তাকে উলঙ্গ করে শারীরিক নির্যাতন করে।’ চেয়ারম্যান ঘটনা অস্বীকার করে বলেন যে, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। হালুয়া ঘাট থানার ওসি বলেছেন যে, ‘চুরির মামলায় ঝর্ণা বেগমকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছিল।’ তবে তাকে থানায় রেখে নির্যাতনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
ঝর্ণা বেগম ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পরষ্পরবিরোধী বক্তব্য যদি আমরা এই মুহুর্তে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তা নির্ধারণে দ্বিধাগ্রস্ত হই তবে যুক্তির খাতিরে যে কথাটি প্রকাশ্যেই উপস্থাপিত হয় তাহলো, প্রথমত: পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন কোন বিষয় নয়, যা বারংবার সংগঠিত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত: একজন সাধারণ মাদরাসা শিক্ষকের কন্যা যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সে কেন প্রভাবশালী একজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে তাকে উলঙ্গ করে নির্যাতনের অভিযোগ আনবে? এর পিছনে স্বার্থ কী? এতো ক্ষমতা মেয়েটি পেলো কোথায়? বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বলেছিলেন যে, ‘মাছের রাজা ইলিশ ও দেশের রাজা পুলিশ’। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন বন্ধ করার জন্য ২০১৩ সালে একটি আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা পুলিশ করে না। তারা মনে করে, টিকে থাকার জন্য জনগণের চেয়ে পুলিশকেই সরকারের বেশি প্রয়োজন। এ ধারণা পুলিশ নিজেও পোষণ করে। সে কারণেই পুলিশ বর্তমানে সকল প্রকার জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকায় পুলিশের মধ্যে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে গেছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে একজন এ্যাডিশনাল পুলিশ সুপারের সাথে বেয়াদবী বা নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে। এ ধরনের অনেক ঘটনাই ঘটেছে যেখানে পুলিশের নি¤œপদস্থ কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডিঙ্গিয়ে চলছে। এর মূল কারণ পোস্ট-পজিশনের চেয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে কার কতটুকু সখ্য রয়েছে তার গুরুত্ব পাওয়া। পোস্ট-পজিশন নয়, বরং সখ্যের পরিমাপের উপর নির্ভর করছে ক্ষমতার মাপকাঠি। আমলারা প্রজাতন্ত্রের বা রাষ্ট্রের কর্মচারী। কর্মচারীরা তাদের কর্তব্য পালনে যেখানে নিরপেক্ষ থাকার কথা সেখানে দলবাজী করে একদিকে তারা নিজেদের অবৈধ বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাচ্ছে, অন্যদিকে জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। ফলে প্রতারিত ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারাই যারা সরকারের ব্রান্ডেড সমর্থক নয়।
প্রাথমিক শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে, ‘আমরা লুটপাট করেছি, তবে কাজও করেছি।’ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের এমপিরা টাকার বিনিময়ে কাজ করে, তবে এ টাকে আমি ঘুষ বলবো না।’ স্বভাবগতভাবেই রাবিশ বা ইডিয়েট বলা তার মজ্জাগত অভ্যাস। প্রাথমিক শিক্ষা বা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে দাম্ভিকতা ও মূর্খতা খুঁজে পাওয়া যায়। আমলারা দুর্নীতির মধ্যমনি। অথচ দুর্নীতিবাজ ধরার দায়িত্বও আমলাদের উপর। আমলাদের বিষয় সম্পত্তি, অর্থবিত্ত সব কিছুই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের প্রতি তারা যতটুকু না সচেতন তার চেয়ে তারা বেশি বাকপুটু।
আরো একটি ভোটবিহীন একতরফা জাতীয় নির্বাচন করার জন্য সরকারের প্রয়োজন আমলাদের। কারণ আমলারা একতরফা নির্বাচনের প্রধান হাতিয়ার। ভোটার উপস্থিত থাকবে না অথচ মিডিয়াতে ভোটের বাক্স ভর্তি হওয়ার প্রচার হতে থাকবে, এখানেই তো আমলাতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারসাজি, যাতে সত্যের সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না। সরকার মুখে যাই বলুক না কেন তারা আবারো একতরফা নির্বাচন চায়। কারণ তাদের ভিশন পুরা হওয়ার জন্য ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা দরকার। এ জন্যই মন্ত্রীরা লাগাতার বিএনপি বিদ্বেষী কথা বলে বেড়াচ্ছেন। কোথাও কোথাও কথা বলতে গিয়ে তাদের জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়। দেশের প্রবীণ ব্যক্তি অর্থমন্ত্রী গত ৩১ ডিসেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে বিএনপিকে একটি ইডিয়েট পার্টি এবং বিএনপি নেতাদের ইডিয়েট বলেছেন। ইডিয়ট (ওফরড়ঃ) একটি ইংরেজি শব্দ, গবফরপধষ উরপঃরড়হধৎু এবং বাংলা একাডেমী প্রণীত ঊহমষরংয ঃড় ইবহমধষব উরপঃরড়হধৎু-তে ইডিয়ট শব্দের যে শব্দার্থ করা হয়েছে, তাছাড়া লেখাপড়া জানা অজানা সকলেই ইডিয়ট শব্দার্থটি বোঝে। খধি উরপঃরড়হধৎু-তে ওফরড়ঃ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, ‘জড়বুদ্ধি। হিন্দু আইন অনুসারে জন্মসূত্রে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হন না। চুক্তি আইন অনুসারে জন্মসূত্রে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না।’ অর্থমন্ত্রী একটি রাজনৈতিক দল বা দলের নেতাদের ‘ইডিয়ট’ বলে সম্বোধন করতে পারেন কি? অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে তার মস্তিষ্কে ভারসাম্যহীনতার অভাব বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। তার তীব্র সমালোচনার পরও তিনি সংশোধিত হননি। বরং একই ধরনের বক্তব্যের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিএনপির বা জিয়া পরিবারের সমালোচনার সময় শব্দ চয়নে নিয়ন্ত্রীণহীন হয়ে পড়েন। বিএনপির প্রতি ব্যক্তি শেখ হাসিনা দুঃখ ক্ষোভ থাকা স্বত্তে¡ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বক্তব্য দেয়ার সময় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েন তবে তার অনুগত মন্ত্রীদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে আরেকটু বাড়িয়ে বলার জন্য। শ্লোক রয়েছে যে, ‘রাজা যা বলে পারিষদ বলেন তার বহুগুণ।’ বাংলাদেশের পারিষদরা সে নীতিমালা থেকে পিছিয়ে নেই। ফলে কলাকৌশল ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য যা সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। আবারো একতরফা নির্বাচনের জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার সরকারের প্রচেষ্টা থাকবে এবং এতে যদি ভিশন সফল হয় (!) কিন্তু সমালোচনার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরা যে দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন তার যদি পাল্টা জবাব আসে তার ব্যাখ্যা তারা কী দেবেন? অন্যের গায়ে থু থু ফেললে নিজের গায়ে চলে আসে প্রাকৃতিক নিয়মে। তবে দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে যে, একজন ইডিয়টই অন্যকে ইডিয়ট বলতে পারে। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ছাড়া অর্থ মন্ত্রীর বক্তব্যে জবাব আর কী হতে পারে? প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে গণতন্ত্রের ফানুস উড়িয়ে এখন তারা জাতির ঐক্যে, সম্প্রীতি ও জাতি সত্ত¡ার চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গতে ব্যস্ত। এর মূল কারণ তাদের দাম্ভিকতা ও মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। একাডেমিক ডিগ্রি থাকলেই কেউ সুশিক্ষিত হয় না, যদি না তার মনমগজ থেকে মূর্খতা বিলোপ হয়।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চেইন অব কমান্ড
আরও পড়ুন