Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিবি এয়ারলাইন্সে স্বর্ণ চোরাচালান ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ড ময়ূরপঙ্খী বাজেয়াপ্ত

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

স্বর্ণ চোরাচালানের দায়ে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ড করেছে। সেই সাথে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ (এস২-এএইচভি) ময়ূরপঙ্খীকে বাজেয়াপ্ত করেছে ঢাকা কাস্টম বিভাগ।
তবে বিমানের তদন্ত প্রতিবেদনে কারোও বিরেুদ্ধে কোন অভিযোগ না করায় এবং অপরাধীকে সনাক্ত না করায় চোরাচালানের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বিমানবন্দরে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা। বিমান ও কাস্টম সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার প্রকাশ দেওয়ান স্বাক্ষরিত এক বিচার আদেশে (বিচার আদেশ নম্বর ১৭১/কাস/২০১৭) বিমানকে এ দন্ড দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়,স্বর্ণ চোরাচালানের দায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ড করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস। একই সঙ্গে চোরাচালানকৃত পণ্য বহনের দায়ে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ (এস২-এএইচভি) ময়ূরপঙ্খীকে বাজেয়াপ্ত করেছে কাস্টম। তবে ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড দিয়ে উড়োজাহাজটি অবমুক্তির সুযোগ দিয়েছে কাস্টম হাউস।
ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার প্রকাশ দেওয়ান বলেন, কাস্টম আইন অনুসারেই দন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। আইন অনুসারেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিমানের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১২ মে সন্ধ্যা ৬ টা ৩০ মিনিটের হজরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যাংকক থেকে আসা বিজি ০৮৯ ফ্লাইট থেকে ১০ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের সোনা চোরাচালানের ঘটনায় এ দন্ড দেওয়া হয়। সেই ফ্লাইটে উড়োজাহাজের টয়লেটের বিভিন্ন অংশ থেকে ১০ কেজি ৩০০ গ্রাম সোনা জব্দ করা হয় । এরমধ্যে ৯৯৮ গ্রাম ওজনের ৮টি, ১১৬ গ্রাম ওজনের ২০টি স্বর্ণের বার। আটককৃত সোনার মূল্য ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মে মামলা করা হয় (মামলা নম্বর ১২৩/২০১৬)। এ চোরাচালানের ঘটনায় বিমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশের পাশাপাশি ৪ দফা শুনানিতে অংশ নিতে চিঠি দেয় ঢাকা কাস্টম হাউস। সেই ফ্লাইটে দু’জন ককপিট ক্রু এবং ৪ জন কেবিন ক্রু ছিলেন। তারা হলেন,পাইলট তাসমিন দোজা, ফার্স্ট অফিসার মুনজেরিন রায়ান, জুনিয়র পার্সার ফ্লোরা নাসরিন, শফিকা নাসিম নিম্মি, ফ্লাইট স্টুয়ার্ড সালাউদ্দিন চৌধুরী, শামিমা নাসরিন মৌ। এ ঘটনায় মহাব্যবস্থাপক (সিএমআইএস) হাসান আহমেদ চৌধুরীকে আহŸায়ক ও প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স মো. শফিকুল আলমকে সদস্য করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একক কোনও যাত্রীর মাধ্যমে এ চোরাচালানের চেষ্টা হয়নি। একটি চক্র এ সোনা পাচারের চেষ্টা করতে পারে। এ পাচারের সহায়তাকারী হিসেবে কোনও ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা না হলে বিমানের ক্যাটারিং সার্ভিস ও প্রকৌশল বিভাগের কেউ জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।
মামলার বিবরণীতে বলা হয়, সোনার বারগুলো উড়োজাহাজের স্পর্শকাতর স্থানে লুকিয়ে আনা হয়েছে, প্রশিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া টয়লেটের বিভিন্ন স্থানের স্ক্রু খুলে সাধারণ যাত্রীদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এসব সোনার বার বিমানবন্দরে কর্মরত বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংঘবদ্ধ চক্র পাচার করতো। কোনও ব্যক্তি সোনার বারগুলোর দাবিদার হিসেবেও আবেদন করেননি। ফলে প্রতীয়মান হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী চোরাচালানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ ঘটনায় ১২ মে সোনার বারগুলো জব্দ করে শুল্ক গুদামে জমা রাখা হয়। একই সঙ্গে বাজেয়াপ্তযোগ্য পণ্যবহন কাজে ব্যবহৃত বিমান বাংলাদেশের উড়োজাহাজটিও কাস্টম আইন অনুসারে আটক করা হয়। আটককৃত উড়োজাহাজটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এর জিম্মায় ছাড় দেওয়া হয়।
কাস্টম হাউসের বিচার আদেশে বলা হয়, কাস্টম আইন অনুসারে আটককৃত ১০ কেজি ৩০০ গ্রাম সোনা রাষ্ট্রের অনুকূলে দাবিদারহীন হিসেবে বাজেয়াপ্ত করা হলো এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স চোরাচালানে সরাসরি জড়িত থাকায় ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ড আরোপ করা হলো। বিজি ০৮৯ ফ্লাইটে ব্যবহৃত উড়োজাহাজে চোরাচালানকৃত পণ্য বহনের দায়ে বাজেয়াপ্ত করা হলো। তবে ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড দিয়ে উড়োজাহাজটি অবমুক্তির সুযোগ দেয় কাস্টম হাউস।
কাস্টম হাউসের বিচার আদেশের পর্যালোচনায় বলা হয়, বিমানের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় কোনও যাত্রী উড়োজাহাজে ১০ কেজির বেশি মালামাল নিয়ে উড়োজাহাজে উঠতে পারবেন না। তারপরও যাত্রী শুধু ১০ কেজি ৩০০ গ্রাম সোনাবার ও হাত ব্যাগ নিয়ে কিভাবে উঠলেন তার ব্যাখ্যা নেই। ঘটনার দিন বিমানের টয়লেট খোলার জন্য প্রথমে যে টেকনিশিয়ান আসেন তিনি টয়লেট না খুলে জানান যে এ টয়লেট বিমান ক্রয়ের পর থেকে কেউ খুলেনি। পরবর্তীতে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের অনুমতি সাপেক্ষে ইঞ্জিনিয়াররা টয়লেট খোলেন ও সোনা উদ্ধার করেন। ফলে ১ম টেকনিশিয়ানের বক্তব্য মিথ্যা, অথচ তদন্ত প্রতিবেদনে তাকেও সন্দেহ করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে সন্দেহ করা হয় দুবাই, মাস্কট থেকে সোনাগুলো বিমানে উঠানো হতে পারে। এজন্য বিমানের প্রকৌশল বিভাগ ও বিএফসিসিকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হয়। বিমানের প্রকৌশল বিভাগের লাইন মেইন্টেনেন্স এবং বেস মেইন্টেনেন্সকেও সন্দেহ করা হয়। শুধু সন্দেহ পোষণ করে এবং সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখ না করে অসমাপ্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে যে কারণে ফাইন্ডিং শূন্য। বিমানের তদন্তকালে যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল তাদেরকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করে ন্যূনতম শাস্তি বা তাদের বিরুদ্ধে থানায় এজহার না দিয়ে বরং তাদের চিহ্নিত না করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। অথচ এটা নিশ্চিত হওয়া যায়, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় সোনার বারগুলো বিমানে উঠিয়ে দক্ষ টেকনিশিয়ানের মাধ্যমে টয়লেটে লুকানো হয়েছে। যাত্রীরা নেমে যাবার পর বিমানের লোকজন ছাড়া অন্য কারও উড়োজাহাজে ওঠার সুযোগ নেই। বরং উড়োজাহাজের টয়লেট থেকে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সোনা পাচার করতো। কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে বিমান জানায়, জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানের ওপর চোরাচালানের অভিযোগ আনা সঠিক নয়, এতে জাতীয় ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। অথচ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে চোরাচালানের মতো ঘৃণ্য কাজটি বিমানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সরাসরি সহযোগিতায় সংঘঠিত হয়েছে। কোনও দায়ী ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট করা না গেলে বিমান কর্তৃপক্ষ এর দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন না।
২০১৬ সালের ১৫ মে সোনা চোরাচালানের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেন্টিভ দল এ ফ্লাইটে অবতরণ করলে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। ফ্লাইটের যাত্রীদের ওপর নজরদারি রাখা হয়। যাত্রীরা উড়োজাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার পর উড়োজাহাজে বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতিতে তল্লাশি চালায় প্রিভেন্টিভ দল। তল্লাশি এক পর্যায়ে উড়োজাহাজের পেছনের টয়লেট থেকে বাদামি রঙয়ের একটি প্যাকেট উদ্ধার করা হয়। এরপর উড়োজাহাজের টয়লেটগুলোতে আরও নিখুঁতভাবে তল­াশির জন্য বিমানের প্রকৌশল বিভাগে টেকনিশিয়ান পাঠাতে অনুরোধ জানায় ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেন্টিভ দল। প্রায় ৩ ঘণ্টা পর একজন টেকনিশিয়ান প্রিভেন্টিভ দলকে জানান, উড়োজাহাজটি ক্রয়ের পর টয়লেটগুলোর বিভিন্ন অংশ কখনও খোলা হয়নি এবং খোলার জন্য কোনও যন্ত্রপাতি তাদের কাছে নেই। পরবর্তীতে বিমানের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের (তৎকালীন) অনুমতি নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় টয়লেটগুলোর বিভিন্ন অংশ খোলা হয়। উড়োজাহাজের সামনের অংশে ককপিট ক্রুদের পাশের টয়লেটের সারাউন্ড কভার খোলা হলে ভেতরে কালো রঙয়ের কাপড়ের একটি ছোট ব্যাগের মধ্যে অফ হোয়াইট রংয়ের স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো ৪টি প্যাকেট পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ৪টি প্যাকেট কাস্টমস আগমনী হলের ব্যাগেজ কাউন্টারি নিয়ে খোলা হলে ৯৯৮ গ্রাম ওজনের ৮টি স্বর্ণের বার এবং ১১৬ গ্রাম ওজনের ২০টি স্বর্ণের বার পাওয়া যায়।
মামলার বিবরণীতে বলা হয়, উড়োজাহাজ একটি স্পর্শকাতর যানবাহন। উড়োজাহাজ পরিচালনা, ব্যবহার, যাত্রী ওঠানো ও নামানোর নিয়মনীতি রয়েছে। যাত্রী উড়োজাহাজে ওঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের অনুমোদিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফ্লাইটে ওঠেন। উড়োজাহাজের যাত্রী ওঠানোর দরজা খোলা হলে নির্ধারিত সময়ে বোর্ডিংপাস প্রাপ্ত যাত্রীরা লাইনধরে উড়োজাহাজে উঠেন। এয়ারলাইন্সের ক্রুরা যাত্রীদের বোর্ডিং পাস অনুসারে সিটে বসার ব্যবস্থা করেন। ফলে ১০ কেজি ৩০০ গ্রাম সোনারবার এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অজ্ঞাতসারে কোনও যাত্রীর পক্ষে টয়লেটে গিয়ে স্ক্রু খুলে সেখানে রেখে ফের স্ক্রু লাগানো সম্ভব নয়। একইসঙ্গে কোনও যাত্রী সোনাগুলোর মালিক হলে উড়োজাহাজ থেকে নামার সময় সেগুলো নিয়ে নেমে যেতেন। কারণ, উড়োজাহাজের টয়লেটে সোনা ফেলে রেখে গেলে যাত্রীর পক্ষে সে সোনা পাওয়ার কোনও উপায় নেই।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর তদন্ত ১৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয় বিমান। তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যালোচনা করে কাস্টম হাউস বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সেই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল শুনানিতে অংশ নিতে ডাকা হলেও তারা আসেননি। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২২ মে পুনরায় শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হলে বিমান শুনানিতে অংশ না নিয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করে। সে আবেদনের পর সময় বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৯ জুলাই শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সেদিনও বিমানের কেউ আসেননি। পরবর্তীতে ২২ আগস্ট ফের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হলেও বিমানের কেউ উপস্থিত হননি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বর্ণ

১৬ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ