Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিশ্ব ইস্তেমা : দা’ওয়াত ও তাবলীগ

মুফতী মো: আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তাবলীগ-এর বিভিন্ন বিভাগ: যে-রকমভাবে পৃথিবির রাষ্ট্রসমূহের নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয় ও জরুরী কর্মকান্ডসমূহ সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদন ও ব্যবস্থাপনার স্বার্থে মৌলিক ও সহায়ক কার্যাদি বিভিন্নভাগে বন্টন করে এক-একটি বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। কোন বিভাগ শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের, কোনটি মন্ত্রী-পরিষদ ও বিচার বিভাগ, কোনটি যোগাযোগ বিভাগ; আবার কোনটি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগ-ইত্যাদি। এগুলোর অধীনে আবার বিভিন্ন শাখা-সেলসমূহ হয়ে থাকে। তেমনিভাবে ‘ইসলাম’ ধর্মের শিক্ষা-দীক্ষা, আমল, ইসলাহ্-সংশোধন, হিফাযত-সংরক্ষণ, স্থায়িত্ব ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্তে ধর্মীয়-কাজ ও সেবাসমূহকে বিভিন্ন বিভাগে বন্টনের বিকল্প নেই। কোন বিভাগ শিক্ষা ও শিক্ষাদানের, কোনটি ফাতওয়া ও বিধি-বিধান গবেষণার, কোনটি ফাতওয়া শিক্ষাদান ও তা অনুশীলনের, কোনটি ইসলাহ্-সংশোধনের লক্ষ্যে হাতে-কলমে অনুশীলনের, কোনটি সর্ব-সাধারণের মাঝে ওয়ায-উপদেশদান ও ‘তাবলীগ’ করার জন্য, কোনটি অস্ত্র-হাতিয়ারের দ্বারা যুদ্ধ-জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার, আবার কোনটি কলম-লেখা,রচনা-গ্রন্থনা-গবেষণার মাধ্যমে প্রচার-প্রসারের জিহাদ ও তাবলীগ চালিয়ে যাওয়া এবং ধর্মের সবরকম বিরোধিতাকে প্রতিহত করে তা সুষ্ঠু-সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা। আবার এসব বিভাগের আওতায়ও বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা হয়ে থাকে।
যেভাবে জাগতিক জীবনের উক্ত বিভিন্ন বিভাগকে বিলুপ্ত করে শুধু একটি বিভাগ বহাল রাখার পরামর্শদান যেমন-“কেবল ‘শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্য বিভাগ’ বহাল রেখে বাকী সকল বিভাগ বিলুপ্ত করে, ওইসব বিভাগে কর্মরত সবাইকে এই একই বিভাগে কাজে লাগানো হোক”- এমন দাবী করা,মারাত্মক বোকামী ও যুক্তিবিরুদ্ধ। তেমনিভাবে ইসলাম ধর্মের বহুমুখী কর্মকান্ডের বিভিন্ন বিভাগের সকলকে সবকিছু ছেড়ে ‘তাবলীগ’-এর কাজে অংশগ্রহণ করতে বলাও, ধর্ম বিষয়ে সার্বিক জ্ঞানের অনুপস্থিতির পরিচায়ক এবং নিরেট বোকামীর নামান্তর। বরং বাস্তবতা হচ্ছে ধর্মের উক্তসবগুলো বিভাগই ‘তাবলীগ’ এর এক-একটি বিভাগের নামান্তর। পার্থক্য শুধু এ টুকু যে, ধর্ম প্রচারের পরিচিত এই ‘তাবলীগ’ বিভাগটি সাধারণ জনগণের ময়দানে কাজ করে; আর বাকী বিভাগগুলো বিশেষ বিশেষ ময়দানে কাজ করে। ‘তাবলীগ’-এর এই বিশেষ বিভাগগুলো হচ্ছে, শিক্ষাদান বিভাগ, ধর্মীয় গ্রন্থাদি প্রকাশনা, রচনা, গবেষণা, অনুবাদ-ব্যাখ্যা-ফাতওয়া বিভাগসমূহ্ এবং আতি্মক-আধ্যাতি্মক সাধনা ও সংশোধন তথা পীর-মুরীদী বিভাগ,মসজিদ-মাদরাসা পরিচালনা বিভাগ, ইত্যাদি। তাবলীগ-এর এই বিশেষ বিভাগগুলো কয়েকটি কারণে সর্ব-সাধারণের ময়দানে পরিচিত ও প্রচলিত ‘তাবলীগ’-এর চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণগুলো নিন্মরূপ:-
এ সব মৌলিক ও ‘বিশেষ শ্রেণি’র তাবলীগ-এর মাধ্যমে ধর্মের মৌলিক সেবাসমূহ্ সম্পাদন করা হয়। উদাহরণত, পবিত্র কুরআন ও হাদীসের সহীহ-সঠিক ভাব-ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও নির্ধারণ করা হয়। মহান আল্লাহ্ ও রাসূল (স) থেকে বর্ণিত হুকুম-আহকাম,বিধি-বিধানসমূহ্রে স্পষ্টকরণ ও নির্ধারণ,ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে উথ্থাপিত, দৃষ্টিভঙ্গিগত সমালোচনা-অপবাদের ফিতনাসমূহের শিকড় উপড়ে ফেলে ইসলামের দূর্গসমূহের হিফাযত ও দৃঢ়করণ ইত্যাদি
এসব ক্ষেত্রে সেসব লোকদের তাবলীগ করা হয় যারা দুর-দূরান্ত থেকে পিপাসা নিয়ে আসে। আর এটা জানা কথা যে, যারা দ্বীন শেখা ও জানার পিপাসা নিয়ে উপস্থিত হয়, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া বা অন্যদের পিছনে মেহনত বা প্রাধান্যদান জায়েয নয়। যেমনটি সূরা ‘আবাসা’, অন্ধ সাহাবী ইবন উম্মে মাকত’মসহ কুরআন-হাদীসের অনেক আয়াত ও ঘটনা থেকেই প্রমাণিত।
এ সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মের মৌলিক সেবাসমূহ্ সম্পাদনের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে থাকে। ধর্মের এসব মৌলিক সেবার গুরুত্ব ক্রমিক-১ এ বলা হয়েছে।
উক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, যেসব আলেমকে আল্লাহ্ তা‘আলা ইসলামের উক্তসব জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়াদির তাবলীগ ও হিফাযত করার যোগ্যতা নসীব করেছেন, তাদের পক্ষে তা ছেড়ে ‘সাধারণ তাবলীগ’-এর জন্য বেরিয়ে পড়া মোটেও জায়েয নেই। একইভাবে সেসব শিক্ষার্থীদের পক্ষেও বেরিয়ে পড়া জায়েয নেই যাদের মধ্যে তেমন যোগ্যতা অর্জিত হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। তবে মাঠে-ময়দানে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে মাঝে-মধ্যে,ছুটির দিনগুলোতে ছাত্ররা তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া, যাদের বেলায় তেমন প্রত্যাশা করা যায় না, তাদের জন্য উক্ত সাধারণ তাবলীগে বেরিয়ে পড়া জরুরী। এদের পক্ষে মাদরাসায় পড়ে থেকে সময় নষ্ট করা জায়েয নয়। এ দায়িত্ব মাদরাসাগুলোর পরিচালকদের ওপর বর্তায়। তাঁদের জন্য ফরয, এমন অযোগ্য-অকর্মা ছাত্রদের মাদরাসায় ভর্তি করা ও আটকে রাখার পরিবর্তে, তাদের সাধারণ তাবলীগে বা অন্যকোন ধর্মীয় কাজে লাগিয়ে দেওয়া।
তাবলীগ ও আল-হাদীস: (১) হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (স)-কে বলতে শুনেছি,“তোমাদের মধ্যে কেউ মন্দ/অসৎকাজ দেখলে, তা যেন সে নিজ হাতে প্রতিরোধ করে। যদি তেমন শক্তি-সামর্থ না থাকে, তা হলে সে যেন তার মুখ দিয়ে তা প্রতিহত করে। যদি তা-ও না পারে তা হলে সে যেন তার অন্তর দিয়ে তা প্রতিরোধ/ প্রত্যাখ্যান/ঘৃণা করে। আর এটি হচ্ছে নিম্নতম ঈমানের স্তর।”(মুসলিম শরীফ)
‘অন্তর দিয়ে প্রতিরোধ’: “অন্তর দ্বারা অসৎকাজ প্রতিরোধ মানে হচ্ছে, অন্তরে এমন প্রতিজ্ঞা থাকা যে, এ মুহূর্তে যদিও অন্যায় কাজটি প্রতিরোধ করতে পারছি না; তবে ভবিষ্যতে যখনই তেমন সুযোগ পাবো তা প্রতিরোধ করবো। কেবল ‘মনে মনে অপকর্মটিকে ঘৃণা করা’- হাদীসটির এমন তরজমা সঠিক নয়। তার কারণ,(যদি হাত দ্বারাও মিটানোর ক্ষমতা না রাখে,তা হলে অন্তর দিয়ে মিটিয়ে দেবে)হাদীসটির মূল মতন এর দিকে লক্ষ করলে, বোঝা যাবে ‘ হাত দ্বারা প্রতিরোধ/মিটানো.. মুখ দ্বারা প্রতিরোধ.....অন্তর দ্বারা প্রতিরোধ/মিটানো(অন্তর দিয়ে মিটায় বা শেষ করে দেয় বা প্রতিহত করে)-এর মূলভাব ও ব্যাখ্যা ‘ঘৃণা’ শব্দে আদায় হয় না। মন দিয়ে ঘৃণা করা তো সহজ ব্যাপার। এতদসংক্রান্ত অপরাপর কঠোর বাণী ও আযাব-গযব সম্বলিত যেসব হাদীস বিদ্যমান তার নিরীখে, কেবল মনে মনে ঘৃণা দ্বারাই দায়িত্বমুক্তি ও শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। সুতরাং শরীয়তের আলোকে কেবল সৎকাজে আদেশের আংশিক দায়িত্ব পালন করে এবং অসৎ-অন্যায় কাজে শুধু ঘৃণা করে ইসলামের পরিপূর্ণ ‘দা‘য়ী ও ‘মুবাল্লিগ’ হওয়া যাবে না। এটি মনে রাখতে হবে যে, ‘নাহী ‘আনেল-মুনকার’ তথা অসৎকাজে নিষেধও অন্যতম একটি ফরয আমল,দায়িত্ব”। (আহসান:খ-৯,পৃ-৯৯)
‘শক্তি-সামর্থ’: তাফসীর ও ফাতওয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে,‘শক্তি-সামথর্’ মানে দৈহিক সামর্থ নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকে অসৎ কাজে নিষেধ করা হবে,তার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা থাকা এবং সে কোন ক্ষতি করবে না বলে প্রবল ধারণা হওয়া-তা হলে, ‘অসৎকাজে নিষেধ’-এর ‘তাবলীগ’ করাও ওয়াজিব বলে গন্য হবে। যদি তেমন প্রত্যাশা না থাকে এবং হিতে বিপরীতের সম্ভাবনা দেখা দেয়; তা হলে ওয়াজিব নয়।(প্রাগুক্ত: পৃ-৫১২)
(২) হযরত ইবন মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন,“বনী-ইসরাঈল জাতির অধঃপতন বা ধংসের সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, তারা যখন একে-অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হত তখন মন্দকাজ দেখে বলতো, হে অমুক! আল্লাহকে ভয় করো এবং যা করছো তা ছেড়ে দাও; তা তোমার জন্য বৈধ নয়। তারপর আবার পরেরদিন তার সঙ্গে তার অপকর্মরত অবস্থায় মিশতো এবং তাকে নিষেধ করতো না;অথচ একইসঙ্গে পানাহার, উঠাবসা করতে থাকতো। এক পর্যায়ে তাদের ভালো-মন্দ অন্তর পরস্পর সমান হয়ে গেল..........অতপর নবীজী (স) শপথ করে জোর তাকিদসহ বললেন, অবশ্য অবশ্য তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করবে এবং অবশ্যই তোমরা জালেমকে প্রতিহত করবে এবং তাকে সত্য ও ন্যায়ের ওপর উঠতে বাধ্য করবে।”(আবূ দাঊদ,তিরমিযী) অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ অব্যাহত না রাখায় এক সময় তারা ধংস হয়ে গেল।
(৩) হযরত জারীর ইবন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছি,“কোন সম্প্রদায় বা জাতির মধ্যে কোন ব্যক্তি যখন পাপকাজ করতে থাকে। আর ওই জাতির লোকজনের লোকটিকে প্রতিরোধ-প্রতিহত করার সামর্থ থাকে;অথচ তারপরও তাকে প্রতিহত করে না (নিষেধ করে না,বাধা দেয় না,পাপকর্ম বন্ধ করতে সচেষ্ট হয় না)। তা হলে মৃত্যুর পূর্বে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের ওপর আল্লাহ্র আযাব নাযিল হবে!”(আবূ দাউদ,ইবনে মাজা,ইবনে হিব্বান,তারগীব ইত্যাদি)
(৪) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী (স) আমার কাছে গৃহে প্রবেশ করলেন। তখন আমি তাঁর চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম, একটা কিছু ঘটেছে! তিনি উযূ করলেন, কারও সঙ্গে কথা বললেন না। আমি হুজরার সঙ্গে ঘেঁষে কান পেতে, তিনি কি বলেন, তা শোনার জন্য দাড়িয়ে রইলাম। তিনি মিম্বরে আরোহণ করে বসলেন,তারপর আল্লাহ্র প্রশংসা ও গুণগান করলেন এবং ইরশাদ করলেন,“ হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে বলছেন,‘তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকো, ওই পরিস্থিতির পূর্বে যে, তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা করবে, আমি তোমাদের দু‘আ কবূল করবো না ; তোমরা আমার কাছে চাইবে, আমি তোমাদের চাহিদা পূর্ণ করবো না;এবং তোমরা আমার কাছে(শত্রæর বিরুদ্ধে) সাহায্য চাইবে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো না। এর চেয়ে বেশি কিছু না বলে, নবীজী (স) মিম্বর থেকে নেমে গেলেন।”(প্রাগুক্ত)
(৫) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স) ইরশাদ করেছেন, “আমার উম্মত যখন দুনিয়াকে বড় করে দেখবে, তাদের অন্তর থেকে ইসলাম-এর প্রভাব ও বড়ত্ব তুলে নেওয়া হবে। তারা যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ ছেড়ে দেবে,তখন ওহীর বরকত থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে দেওয়া হবে। আর আমার উম্মত যখন পরস্পর গাল-মন্দে জড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি থেকে দুরে ছিটকে পড়বে।”(হাকিম,তিরমিযী)
তাবলীগ না করার পরিণাম: এ পর্যায়ে আমরা ‘তাবলীগ’ বিষয়ক পবিত্র কুরআন ও হাদীসের দলীল-প্রমাণের বিশাল ভান্ডারের দিকে দৃষ্টি না বুলিয়ে, কেবল ওপরে আলোচিত কুরআন-হাদীসের বাণীগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখি। মহান আল্লাহ্ ‘তাবলীগ ও দা‘ওয়াত’-এর কাজ না করলে কি কি ক্ষতির কথা বলেছেন:
(১) সূরা আলে-ইমরান এর উপর্যৃুক্ত ১১০ নং আয়াতটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমরা শ্রেষ্ঠউম্মত এ কারণে যে, আমরা তাবলীগ এর কাজ করবো। সুতরাং তাবলীগ না করলে, আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব থাকে কি করে!
(২) একই সূরার ১০৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, যারা তাবলীগ-এর দায়িত্ব পালন করবে, তারাই সফলকাম হবে। সুতরাং আমরা যদি তাবলীগ না করি, তা হলে প্রকৃত সফলকাম হতে পারবো না।
(৩) সূরা হা-মীম আসসিজদা-এর ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, জগতে যত রকম কথা/বাক্য/বাক্যালাপ রয়েছে, তার মধ্যে আল্লাহ্র দিকে আহবানকারীর ‘কথা’-ই সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। উক্ত সর্বোত্তম তাবলীগ-এর কাজ না করে, আমরা কিভাবে শ্রেষ্ঠ মানুষ ও শ্রেষ্ঠ উম্মত হতে পারি!
(৪) সূরা আয্যারিয়াত-এর ৫৫ নং আয়াতে বলা হযেছে, উপদেশ দিন, নসীহত করুন- যা কিনা তাবলীগ কমের্রই নামান্তর। আর তাতে বলা হয়েছে, মু’মিনদের উপকার ও কল্যাণ পৌঁছানো-এ তাবলীগ কর্মের মধ্যে নিহিত। সুতরাং কল্যাণকামী মানুষের কাজই হচ্ছে তাবলীগ করা।
(৫) সূরা ‘ত্বা-হা’-এর ১৩২নং আয়াতে বলা হয়েছে, নিজ পরিবার-পরিজনদের ‘সালাত’ এর নির্দেশ তথা তাবলীগ করতে থাকুন। তা না করলে, আমরা অবশ্যই খোদ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ অমান্যকারী সাব্যস্ত হবো।আর তাঁর নির্দেশ অমান্যকারীর পরিণতি কি হতে পারে, তা তো অনেকটা সকলেরই জানা!
এক নজরে উক্ত সবগুলো আয়াতের প্রতি তাকালে ইজমালীভাবে বোঝা যাচ্ছে, নিজে তাবলীগ করা, তাতে অটল থাকা যেমন জরুরী তেমনি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, আপন-পর, কাছে-দূরে, ব্যষ্টি-সমষ্টি, নারী-পুরূষ নির্বিষেশে সকলের, পরস্পরের ওপর তাবলীগের দায়িত্ব রয়েছে।
এ ছাড়া, উপরের আয়াতগুলো থেকে যদিও ‘তাবলীগ’ পরিহারকারীদের, কল্যাণ-বঞ্চিত হওয়া, শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে ফেলা, শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে না পারা, দায়িত্বহীন হওয়া এবং অসফল হওয়া- ইত্যাদি বোঝা যাচ্ছে; যা ইহকাল ও পরকাল উভয় জাহানেই হতে পারে । কিন্তু, তা থেকে জাগতিক জীবনের মারাত্মক পরিণতির বিষয়টি কম বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য উপরে আলোচিত হাদীসগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাবলীগ পরিহারের দরুন ইহকালেও মারাত্মক পরিণতি , আযাব-গযব ও লাঞ্চনা- বঞ্চনা রয়েছে। যেমন-
(৬) আলোচিত হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা)-এর প্রথম হাদীসটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাবলীগ-এর কাজটির ঈমানের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। কেননা,তা থেকে বোঝা যাচ্ছে -যারা পুরোপুরি শক্তি-সামর্থের ও যোগ্যতার সঙ্গে তাবলীগ করতে পারেন, তারা প্রথমশ্রেণির পাকা মুমিন। আর যারা মধ্যমস্তরের সময়-সামর্থ-যোগ্যতা ব্যয়ে তাবলীগ করেন তারা দ্বিতীয়শ্রেণির মুমিন। আর যারা ‘ভালো’র বেলায় কেবল অন্তরে মহব্বত পোষণ করেন এবং মন্দের ক্ষেত্রে ঘৃণা পোষণ করেন, তারা তৃতীয়শ্রেণির মুমিন। এ ক্ষেত্রে চিন্তার খোরাক হচ্ছে, যারা উক্ত তাবলীগ তো করেই না বরং উল্টো বিরোধিতা করে; তাদের ঈমানের স্তর-পর্যায় কোথায়?
তবে হ্যাঁ, এটা ভিন্ন কথা যে, কেউ যদি বলে, আমি অবশ্যই কুরআন-হাদীসের উক্ত তাবলীগ করাকে জরুরী মনে করি এবং তা অপরাপর বিভিন্ন পন্থায় করে থাকি; যদিও প্রচলিত ও পরিচিত ‘তাবলীগ’- জামাতে যাই না। তার কথা ভিন্ন। মোটকথা, তাবলীগ করতে হবে,অবশ্যই করতে হবে;কুরআন-সুন্নাহ্র ভিত্তিতে করতে হবে; হোক তা যে-কোন নামে-সাইনবোর্ডে।
(৭) হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) কর্তৃক বর্ণিত দ্বিতীয় হাদীসটি থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ তথা ‘তাবলীগ’ ছেড়ে দেওয়া মানে অনিবার্য ধংস ডেকে আনা। কেননা বনী-ইসরাঈল জাতিও এ তাবলীগ -এর কাজ ছেড়ে দেওয়াতে পর্যায়ক্রমে দুনিয়াতেই তারা অধঃপতিত ও ধংস হয়েছিল।
(৮) হযরত জারীর ইবন আবদুল্লাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত তৃতীয় হাদীসটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ‘দা‘ওয়াত ও তাবলীগ’-এর দায়িত্ব পালন না করলে, এ জগতেই সংশ্লিষ্টদের ওপর পরাক্রমশালী আল্লাহর আযাব এসে পড়বে!
(৯) আম্মাজান হযরত আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত চতুর্থ হাদীসটি থেকে পরিস্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে,‘তাবলীগ’-এর কাজ না করলে, মুসলমানদের দু‘আ-প্রার্থনা মহান আল্লাহ কবূল করবেন না; তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করবেন না; শত্রæর বিরুদ্ধে কাঙ্খিত সাহায্য তাদেরকে দেবেন না।সুতরাং মুসলিম জাতির অধঃপতন ও ধংসের জন্য তো এটুকুই যথেষ্ট যে, তারা তাবলীগ-এর কাজ ছেড়ে বসবে!
(১০) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত পঞ্চম হাদীসটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ যখন ‘তাবলীগ’-এর মেহনত ছেড়ে দেবে, তারা ‘ওহী’র বরকত-কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে! ‘ওহীর বরকত’ কি? এ প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি, খোদ মহান আল্লাহ ৩০ পারা পবিত্র কুরআন নাযিল করে, তাতেই ইরশাদ করেছেনÑ“আমি অবতীর্ণ করছি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত-”(১৭:৮২)। অর্থাৎ কুরআনের পঠন-পাঠন,শিক্ষা-দীক্ষা ও আমল-ওযীফা ইত্যাদির মধ্যে যেসব জাগতিক কল্যাণ-উপকারিতা অন্তর্নিহিত; এবং ফলাফল পাওয়ার ছিল। তাবলীগ-এর কাজ ছেড়ে বসলে, সেসব থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
তাবলীগরতদের জন্য শরীয়তের আবশ্যকীয় আইন: যারা প্রচলিত তাবলীগ ও ধর্মীয় অপরাপর কাজের তাবলীগে আতœনিয়োগ করবেন তাদেরকে অবশ্যই নি¤েœাক্ত আইন-বিধান মেনে চলতে হবে:
প্রথম আইন: কোন কল্যাণ-লক্ষ্যের যুক্তিতেই যে-কোন ছোট পাপের কাজেও জড়িয়ে পড়া জায়েয নেই। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ্র বিধান হচ্ছে, তোমরা আমার মনোনিত ধর্মের কাজ করো; কিন্তু ধর্মের সেবার দোহাই দিয়ে কোথাও আমার নির্ধারিত আইন-বিধানের সামান্যতম কাট-ছাটেরও অনুমতি নেই। উদাহরণত, এমন বক্তব্য বা যুক্তি যে, “তাবলীগ বা দাওয়াতের স্বার্থে আপাতত বিদআত কর্মে, পাপের অনুষ্ঠানে, সুদখোর বা ঘুষখোরের বাড়ীতে খেয়ে নাও; কল্যাণ চিন্তা মাথায় রেখে অনুরূপ কোন পাপ কাজে অংশগ্রহণ জায়েয; বরং তাতেও সওয়াব রয়েছে”!(নাঊযুবিল্লাহ্)
দ্বিতীয় আইন: ছোট-বড় যে-কোন পাপকর্ম দেখলে তা সামর্থ অনুযায়ী প্রতিহত বা প্রতিরোধ করা ফরয। এ বিধানটি তাবলীগ কর্মে জড়িত বা অন্য যে-কোন ধর্মীয় কাজে জড়িতদের মনে রাখতে হবে। একইভাবে তাবলীগ-এর দুটি ডানা ‘সৎকাজে আদেশ’ ও ‘অসৎকাজে নিষেধ’ বিষয়টি খোদ তাবলীগ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতগুলোতেই যেখানে বিদ্যমান সেখানেÑ‘অসৎকাজে নিষেধ’কে এড়িয়ে যাওয়া অথবা নিজের খেয়াল-খুশি মতে, প্রয়োজনে অসৎকাজে অংশগ্রহণও জায়েয বলা, মারাতœক শরীয়ত বিরোধী বক্তব্য।
তৃতীয় অইন: প্রয়োজনে যুদ্ধ-জিহাদের তাবলীগও ফরয। পূর্বে বলা হয়েছে যে, তাবলীগ-এর বিভিন্ন বিভাগ ও শাখা রয়েছে। যার অন্যতম এটিও যে, নিজ দেশের প্রয়োজনে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে, নিজ ঈমান ও ধর্মের স্বার্থে প্রয়োজন মুহূর্তে বিধি মোতাবেক যুদ্ধ-জিহাদের তাবলীগ করাও ফরযÑএটি সংশ্লিষ্ট সকলকে মনে রাখতে হবে।
চতুর্থ আইন: ধর্মের অপরাপর বিভাগ ও শাখায় কর্মরতদের হেয় বা ছোট মনে করা যাবে না। ধর্মের বহুমুখী ও বিভিন্ন বিভাগে জড়িতরা পরস্পর একে-অন্যকে হেয় করা হারাম ও কবীরা গুনাহ। যে-কারণে, শরীয়তের সীমার ভেতরে যারা আল্লাহ্র বিধান মোতাবেক মুসলমানদের সমাজ ও রাষ্ট্র পারচালিত হওয়ার লক্ষ্যে রাজনীতি করেন, তাদের এমন বক্তব্য বা দাবী যে,“আমরাই কেবল ইসলামের আসল ফরয আদায় করছি”! কিংবা যারা তাবলীগ করেন, তাদের এমন দাবী যে,“খাঁটি ইসলামের কাজ এবং সঠিক তাবলীগের কাজ আমরাই করছি‘! কিংবা মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের এমন কথা যে,“ আসল দীনীকাজ তো আমরাই করছি!”Ñএমনসব বক্তব্য/দাবী মোটেও জায়েয নেই।
পঞ্চম আইন: অন্যদের তুলনায় নিজের ও স্বীয় পুত্র-কন্যাদের ইসলাহ্-সংশোধনের চিন্তা-ফিকির অধিক জরুরী ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা,মহান আল্লাহ্র নির্দেশ,“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনদের অগ্নি হতে রক্ষা করোÑ(৬৬:০৬)
ষষ্ঠ আইন: যারা স্বেচ্ছায় দীন-ধর্ম শিখতে পিপাসা-আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হয়, অন্যদের চেয়ে তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। ধর্মের তাবলীগ ও শিক্ষা সবার কাছেই পৌঁছাতে হবে; সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ্ থাকুক বা না থাকুক। তারপরও, যারা আগ্রহী ও উপস্থিত তাদের হক অগ্রগন্য।
সপ্তম আইন: যিকির ও ফিকির-এর অধিক হারে অনুশীলন। কেননা, যে-ব্যক্তি অধিকহারে নিজের ইসলাহ্ ও পরিশুদ্ধির চিন্তা-চেতনা রাখবে এবং নির্জনে আমল-ইবাদত,যিকির-তাসবীহ, মুরাকাবা-মুহাসাবার প্রতি যত্মবান থাকবে; তার তাবলীগ, তা‘লীম ও পরিশুদ্ধির মেহনত অধিক কার্যকরী ও ফলদায়ক হবে।(প্রাগুক্ত;খ-৯,পৃ-১৪২-১৬২)
মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে শরীয়তের মাপকাঠি অনুযায়ী ‘দা’ওয়াত ও তাবলীগ’-এর কাজের গুরুত্ব বোঝার এবং সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ