Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উড়াউড়ি বেড়েছে অতিথি পাখির

সাইবেরীয়া ও হিমালয় অঞ্চলে স্মরণকালের প্রচন্ড শীত

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

একটু উষ্ণতার খোঁজে হাজার মাইল উড়ে বাংলাদেশে
শফিউল আলম : উত্তরের হিমশীতল সাইবেরীয়া এবং হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলে এবার স্মরণকালের প্রচন্ডতম শীত পড়ছে। অধিকাংশ সময়েই মাইনাস ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকছে তাপমাত্রা। যা মানুষের সাথে সাথে পাখীদের রাজ্যকেও করে তুলেছে কাবু ও যারপরনাই অস্থির। অসহনীয় শৈত্যপ্রবাহের ধকল সইতে না পেরে একটু উষ্ণতার খোঁজে হাজার হাজার মাইল উড়ে বাংলাদেশে এসে ঠাঁই নিয়েছে হরেক বিচিত্র জাত-প্রজাতির পাখ-পাখালী। এবার গত কয়েকদিনে অতিথি পাখির আগমন¯্রােত অনেক বেশী বলেই জানান পক্ষী বিশারদগণ। বন্দরনগরীসহ সমগ্র বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্র সৈকতে, উপকূলজুড়ে বিচিত্র জাতের অতিথি পাখির উড়াউড়ি বেড়েই চলেছে। তাছাড়া পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির কর্ণফুলী হ্রদজুড়েও হরেক প্রজাতির অতিথি পাখি প্রতিদিনই ভিড় করছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের সর্বত্র লাখো অতিথি পাখির বসেছে মিলনমেলা। ভোর থেকে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত সবখানে কিচিরমিচির কলকাকলীতে উপকূলে প্রকৃতি যেন সেজেছে ভিন্নরূপে। মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রার দেশগুলো ছেড়ে ছুটে আসা পরিযায়ী বা অতিথি পাখিদের জন্য বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বর্তমান আবহাওয়া যথেষ্ট উষ্ণ। গতকাল (শুক্রবার) চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ও সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ছিলো ২০.৮ ও ১১.৬ ডিগ্রি সে. , কক্সবাজারে ২৩.০৫ ও ১২.০৩ ডিগ্রি সে. , খুলনায় ২২.৫ ও ৯ ডিগ্রি সে.।
বর্তমান সময়টা পর্যটনের ভরা মওসুম। অনুকূল আবহাওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ‘হাওয়া বদল’ তথা অবকাশ বিনোদনের জন্য ছুটছেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা প্রান্তে। অনেকে রয়েছেন বিদেশী পর্যটকও। এ মুহূর্তে পর্যটকদের জন্য বাড়তি আনন্দের খোরাক হয়েছে হরেক বিচিত্র প্রজাতির অতিথি ভিনদেশী পাখ-পাখালীর উড়াউড়ির দৃশ্য। প্রতিবছর তা দৃষ্টিগোচর হলেও এবার শীতের দাপটে টিকতে না পারা পরিযায়ী বা অতিথি পাখিদের আগমন অনেক বেশিই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হোসেন জামাল জানান, এ সময়ে অতিথি পাখিদের সমুদ্র উপকূলে ব্যাপকহারে আগমন ঘটে। তবে এবার উত্তরের সাইবেরীয়া ও হিমালয় অঞ্চলে শীতের তীব্রতার কারণে অনেক বেশিহারে অতিথি পাখিরা ছুটে আসছে। তারা আসছে জীবন বাঁচাতে এবং খাবারের সন্ধানে। বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল হওয়ার সুবাদে এখানে শীতের তীব্রতা তুলনামূলক কম। তবে আমাদেরকে অতিথি পাখিদের প্রতি সদয় হতে হবে। চোরা শিকারিদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। তাদের নিরাপদ বিচরণ, বসবাস, খাবার সংগ্রহ যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে সবাইকে সযতœ থাকতে হবে। কেননা অতিথি পাখিরা আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতির সৌন্দর্য অনেকটাই বাড়িয়ে তোলে। ওরা পর্যটন-বিনোদনের অপরূপ অনুষঙ্গ। ওরা প্রকৃতির দান।
সুবিশাল বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। নাতিশীতোষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলে এদেশের অপূর্ব এক ভৌগোলিক অবস্থান। শীতঋতুর শুরুতেই দেশের সমগ্র দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্র উপকূলভাগ জুড়ে এখন অপরূপ সাজে নির্জন প্রকৃতি। সুদূর সাইবেরিয়া, মেরু অঞ্চল, হিামালয় পাদদেশ ছাড়াও শীতপ্রধান দেশগুলোতে এখন চলছে হিমশীতল মওসুম। এবার তার মাত্রা একটু বেশিই। কেননা উত্তুরের হিমশীতল বায়ুমালা এবং ঊর্ধ্বাকাশের জেটবায়ু মিলে গিয়ে গত ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশে ৬৮ বছরে শীতলতম দিনের রেকর্ড অতিক্রম করে তাপমাপক পারদ নেমে আসে সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এখন অবশ্য তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কিছুটা বেড়েছে। যদিও দেশের অনেক মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের এলাকায় শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল (শুক্রবার) দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহী বিভাগের বাদলগাছিতে ৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সে.।
তবে তাও সাইবেরীয়া, হিমালয় পাদদেশ অঞ্চলের তুলনায় যথেষ্ট উষ্ণ। সেসব অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ যেমন মাইনাস ডিগ্রির দিকে, তেমনি হিমশীতল বায়ু প্রবাহে কাবু হয়ে আছে মানুষ, প্রাণিকুল। তেমনটি শীত মানুষ ও অন্যসব প্রাণিকুলের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সাইবেরিয়া, হিমালয় ও মেরু অঞ্চলের থরথর করে কাঁপতে থাকা মানুষের পক্ষে ভিনদেশে পাড়ি জমানো সম্ভব নয়। তবে আল্লাহতায়ালার অপার বিস্ময়কর দান দু’টি ছোটখাট পাখার উপর ভর করেই হাজার মাইল আকাশপথ উড়াল দিয়ে ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে হরেক প্রজাতির পাখি। যাদেরকে বলা হয় অতিথি পাখি বা পারিযায়ী পাখি। শীতার্ত পাখির ঝাঁক নামছে আর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খাবার খুঁজছে দেশের বিশাল উপকূলভাগ, চর ও দ্বীপাঞ্চলে।
অগুণতি সেসব অতিথি পাখির কলকাকলিতে দেশের সুবিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চল মুখরিত হয়ে উঠেছে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য বর্তমান সময়ের বাড়তি আকর্ষণ পাখিদের এই চোখ জুড়ানো উড়াউড়ির অপরূপ মেলা। সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের ডাগায় জোয়ারের তালে তালে আনন্দে নেচে বেড়ায় হাজারো পাখ-পাখালি। সে এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। চোখে না দেখলে ভাষায় বোঝানোর মতো নয়।
বঙ্গোপসাগর উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলে কেন লাখো অতিথি পাখি এই মওসুমে ছুটে আসছে? এই প্রশ্নের জবাবে প্রাণি বিশেষজ্ঞরা জানান, উন্মুক্ত বঙ্গোপসাগরের বিশাল পানিরাশিতে দ্রবীভূত লোনা পানির হার অত্যধিক। মিঠা পানির চেয়ে সাগরের পানির ঘনত্বও বেশী। তাই দিনের বেলায় অধিক হারে তাপমাত্রা সঞ্চয়ণ করে। উষ্ণতাও ব্যাপকভাবে বিকিরণ হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক আপন নিয়মের ধারায় বৈজ্ঞানিক এই কারণেই সাগর ও উপকূলে পানিতে ও স্থলভাগে তাপমাত্রা শীত মওসুমেও অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশীই বজায় থাকে। শীতঋতুতে বেশীরভাগ সময়ই বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাপমাত্রা দেশের অন্যান্যস্থানের তুলনায় বেশীই রেকর্ড করা হয়ে থাকে। ফলে শীতপ্রধান দেশের পাখিরা একটু উষ্ণতার পরশ খুঁজে পেতেই এখানে প্রতিবছর এমনি মওসুমে ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসে। গ্রীষ্মকাল আসার আগেই আবার হাজার মাইল দূরের দেশে দেশে ফিরে যায়।
বাংলাদেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহির্নোঙ্গর, পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলী, সীতাকুÐ, স›দ্বীপ, মিরসরাই, কর্ণফুলী নদীর মোহনা, আনোয়ারা, কক্সবাজারের টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালী সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, বদরখালী, বৃহত্তর চট্টগ্রামের বাঁশখালী, স›দ্বীপ, উড়িরচর, নোয়াখালীর হাতিয়া নিঝুমদ্বীপ, ভোলা চরফ্যাসন, চরকুকরি-মুকরি হয়ে দক্ষিণে পাথরঘাটা, মহিপুর, দুবলার চর, সুন্দরবন, রায়মঙ্গল পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গোপসাগরের তটরেখা বরাবর বর্তমান সময়ে অতিথি পাখিদের মিলন মেলা জমজমাট। হরেক পাখ-পাখালির ঝাঁক সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণকে বাড়িয়ে তুলেছে। সাগর কৈতর (কবুতর), সী-গাল, হাঁসসহ অসংখ্য প্রজাতির দেশী ও বিদেশী পাখিদের রাজ্য সমগ্র উপকূলজুড়ে সৃষ্টি করেছে অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির মেলা।
সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহের হাওড়-বাওড়, বিল, বন-বাদাড়ে অজ¯্র অতিথি পাখি এখন ভিড় করেছে। উড়ে আসছে প্রতিদিনই। শীতের শেষেও আগমন অব্যাহত থাকবে।
সমুদ্র উপকূলভাগে, চর বা দ্বীপাঞ্চলে গাছ-গাছালির উপর বাসা বেঁধে ওরা থাকে। আবার খুব ভোর বেলায় হাজারো পাখি এখানকার স্বাস্থ্যোপযোগী আবহাওয়ায় সাগরবক্ষে কিংবা চরের ভেজা ও উষ্ণ মাটিতে গা এলিয়ে দেয়। আর দিনভর খাদ্যের অন্বেষণে চর, দ্বীপগুলোতে দল বেঁধে পাখিরা ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যা লগ্নেই নীড়ে ফেরে। উপকূলে নির্বিচারে প্যারাবন ধ্বংসের কারণে অতিথি পাখিদের বাসস্থান সংকট, সমুদ্র সৈকত বরাবর ভেসে আবর্জনা ও বর্জ্যতেলের বিষাক্ত আস্তর জমে ওঠা, চোরা পাখি-শিকারিদের অপতৎপরতা, জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত নিত্যনতুন সংকটের কারণে শীতের পাখিরাও এখন আর ভাল নেই। তাদের দূর্গতি ও ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
দেশী-বিদেশী জাহাজ, ট্যাংকার, ট্রলার, নৌযানবহর থেকে জ্বালানি তেলের বর্জ্য (গাদ) নিঃসরণের কারণে জোয়ারের সময় সেসব বর্জ্য সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি জমাট বাঁধছে। আঁঠালো বর্জ্যতেল অতিথি পাখীদের পা, ডানায়, গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। দূষিত ও পোড়া তেলের কার্বনে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে পাখিরা। অসংখ্য পাখি মারাও যাচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে উপকূলীয় এবং অতিথি পাখিদের বসবাসের পরিবেশ। শীতের এ সময়ে চর, উপকূল, দ্বীপাঞ্চল, বন-বাদাড়, জলাশয়ে চোরা শিকারিদের হাতে অবাধে হরেক প্রজাতির অতিথি পাখি শিকার তো চলছেই। প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে পাখিদের নিরাপদ আবাস। সেই সাথে আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় দেশীয় এবং অতিথি বা পরিযায়ী পাখ-পাখালির জীবনধারণ, বসতি, বংশবিস্তার, বিচরণের উপযোগী পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ