Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

লবণাক্ততা ও পানিবদ্ধতা সহনশীল ধান চারুলতা

| প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাতক্ষীরা থেকে আবদুল ওয়াজেদ কচি : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় পানিবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সহনশীল নতুন এক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন কৃষক দিলীপ তরফদার। স্থানীয় খেজুরছড়ি ও কুটে পাটনাই জাতের ধান শঙ্করায়ণের মাধ্যমে এই জাত উদ্ভাবন করেছেন তিনি। দিলীপ তরফদার এই নতুন ধানের নাম দিয়েছেন তার মায়ের নামে ‘চারুলতা’। আপন মা মারা যাওয়ার পর এই চারুলতাই তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। কৃষক দিলীপ তরফদারের চারুলতা ধান খেজুরছড়ি ও কুটে পাটনাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদনে সক্ষম। এমনকি বিআর-২২ ধানের চেয়ে বেশি ফলন দেয়। এর উৎপাদন খরচও তুলনামূলক কম। গাছ তুলনামূলক শক্ত, তাই সহজেই হেলে পড়ে না।
শঙ্করায়ণের পর চলতি আমন মৌসুমে সাত বছর পেরিয়েছে চারুলতা ধান। এই ধান পানিবদ্ধ এলাকায় চাষ করে উপকার পেতে পারেন সাধারণ মানুষ। সরেজমিন শ্যামনগর উপজেলার মিঠা চন্ডিপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, চলতি মৌসুমে দিলীপ তরফদার এক বিঘা জমিতে চারুলতা ধানের (সপ্তম জেনারেশন) গবেষণা প্লট করেছেন। লম্বা শীষে শীষে ভরে উঠেছে তার ধানক্ষেত। আশপাশের প্লটের ধান ন্যূইয়ে পড়লেও চারুলতা রয়েছে শীষ উঁচিয়ে। দিলীপ তরফদার জানান, রোপা আমন মৌসুমে চাষাবাদের উপযোগী ধানের জাত চারুলতা। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজতলা তৈরির মাধ্যমে এর আবাদ শুরু হয়। আর শেষ হয় অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার মাধ্যমে। চাষাবাদের সময়কাল বিআর ২২ ও কুটে পাটনাইয়ের সমান হলেও খেজুরছড়ি থেকে ১৫ দিন কম।
খেজুরছড়ি, কুটে পাটনাই বা বিআর-২২ উৎপাদনে যে পরিমাণ সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, চারুলতা উৎপাদনে লাগে তার অর্ধেক। তাই খরচ কম হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, খেজুরছড়িতে যেখানে বিঘা প্রতি আট থেকে ১০ মণ, কুটে পাটনাইয়ে ১২ থেকে ১৩ মণ এবং বিআর-২২ ১৮ মণ ধান পাওয়া যায়, সেখানে চারুলতার উৎপাদন ২০ থেকে ২২ মণ। শঙ্করায়ণে মায়ের ভ‚মিকা পালনকারী খেজুরছড়ির গাছ বেশ বড় এবং বাবার ভ‚মিকা পালনকারী কুটে পাটনাই তার থেকে আকারে কিছুটা ছোট হলেও তাদের থেকে উদ্ভাবনকৃত নতুন জাত চারুলতার আকার আরো ছোট। এর গাছ বেশ শক্ত হওয়ায় সহজে হেলে পড়ে না। শীষের গাঁথুনি খুব ঘন, শীষ অনেক লম্বা, শীষে ধানও বেশি হয়। চারুলতা ধানের শেষাংশে কালো দাগ-ফোটা থাকে। যা দেখে বিআর-২২ থেকে সহজেই চারুলতাকে পার্থক্য করা যায়। এ ছাড়া শীষের বৈশিষ্ট্য বিআর-২২ সহ অন্যান্য যে কোনো জাতের চেয়ে আলাদা। স্থানীয় অনেকেই দিলীপ তরফদারের কাছ থেকে চারুলতার বীজ নিয়ে পানিবদ্ধ জমিতে চাষাবাদ করে পেয়েছেন সফলতা।
আর তার এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চায় বিশেষ অবদান রাখায় দিলীপ তরফদারকে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন দিয়েছে স্বাধীনতা সম্মাননা-২০১৬। ধান জাত উদ্ভাবন নিয়ে কৃষক দিলীপ তরফদার জানান, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) থেকে শঙ্করায়ণের প্রশিক্ষণ নেন তিন। এরপর ২০১০ সাল থেকেই শুরু করেন ধান জাত উদ্ভাবনের কাজ। এ জন্য বেছে নেন স্থানীয় জাতের ধান খেজুরছড়ি এবং কুটে পাটনাই। সংকরায়ণ পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, লবণাক্ত এলাকার জমিতে চাষ করা দুটি জাতের দু’গোছা ধান তুলে এনে মাটিসহ বালতির ভেতরে রাখি। এরপর মা গাছের শীষ তিন ভাগের একভাগ বের হওয়ার পর শীষটি পুরা বের করা হয়। পরে শীষের মাঝামাঝি স্থানের ১৫-২০টি ধানের ভেতর থেকে পুরুষ অংশ বের করি। এ কাজে ছোট কাচি ও সুঁচ ব্যবহার করা হয়। এরপর শীষটি কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে দেই। পরদিন পুরুষ জাতের শীষ নিয়ে আগের দিনের মা গাছের কাটা শীষের উপর ঝাঁকিয়ে পরাগায়ন করি। পরপর দুদিন একই কাজ করা হয়। পরাগায়নের পরই কাগজের প্যাকেট দিয়ে শীষটি ঢেকে দেই। এর ছয়-সাতদিন পর প্যাকেট খুলে দেখি ধানের মধ্যে সবুজ চাল হচ্ছে। এরপর আবারো কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে সাবধানতার সাথে রাখি।
চাল পুষ্ট হলে সাবধানে তা সংগ্রহ করে হালকা রোদে শুকিয়ে নেই এবং কৌটার মধ্য রেখে দেই। পরবর্তী মৌসুমে ভেজা টিস্যুপেপারের উপর রেখে ধান গঁজাই এবং প্লাস্ট্রিকের পাত্রে কাদামাটিতে চারা রোপণ করি। এ থেকে যে গাছ হয় এবং তা থেকে যে ধান সংগ্রহ করি তা পরের বছরের জন্য রেখে দেই।
পরের বছর ওই বীজের গাছ হলে দেখি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গাছ ও ধান হয়েছে। এর ভেতর থেকে বৈশিষ্ট্য দেখে পছন্দ অনুযায়ী গাছ থেকে বীজ বাছাই করি ও পরের মৌসুমে চাষের জন্য রেখে দেই। এভাবেই চারুলতার শঙ্করায়ণ সম্পন্ন হয়েছে। যার উৎপাদন আমন মৌসুমে চাষকৃত অন্যান্য ধানের চেয়ে বেশি, ইনিবান্ধব ও লবণাক্ততা সহনশীল। অন্যান্য কৃষকদের উদ্দেশ্যে দিলীপ তরফদার বলেন, আমরা বাজারের বীজ কিনে লাগাই। কিন্তু সেই বীজের মান ভালো না। বাজারের বীজ চাষে সার বিষ বেশি লাগে। দুই-তিন বছর চাষ করার পর বীজের মান ভালো থাকে না। এর চেয়ে নিজেরা বীজ তৈরি করে চাষ করলে প্রতি বছর ভালো বীজ পাওয়া সম্ভব। সার বিষ কম লাগে, এমন জাত তৈরি করতে পারলে অনেক লাভ হবে। এজন্য মাঠ দিবস করে কৃষকদের বীজ উদ্ভাবনে উদ্বুদ্ধ করার আহŸান জানান তিনি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের (বারসিক) কৃষিবিদ পার্থ সারথী পাল বলেন, চারুলতা ধান সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি জাত। তার উদ্ভাবন সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু আমাদের দেশে কৃষকপর্যায়ে এ ধরনের গবেষণার স্বীকৃতি দেয়ার রেওয়াজ নেই। অথচ দিলীপ তরফদারের কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া উচিত, যাতে দেশের কৃষকসমাজ নিজেদের জ্ঞান ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলী হোসেন বলেন, দিলীপ তরফদার একজন দক্ষ কৃষক। ইতোপূর্বে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ উপজেলা প্রশাসন তাকে সম্মাননা দিয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধান

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ