Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ও মনস্তত্তে¡র যোগসূত্র

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মানুষ যে বস্তুটির উপর অধিকার অর্জন করেছে, সেটি ছেড়ে দিতে সে যত অর্থ দাবি করে, তা সেই একই বস্তু হস্তগত করার জন্য সে যে অর্থ খরচ করতে রাজি, তা থেকে বেশি। একেই বলা হয় এনডাওমেন্ট এফেক্ট। এই মানসিকতার উৎস নিয়ে হরেক রকম তাত্তি¡ক প্যাঁচ-পয়জার আছে, কিন্তু সেগুলো এ ক্ষেত্রে উপেক্ষণীয়। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মূল কারণটি হলো, অর্থনীতিতে সদ্য নোবেল-জয়ী পÐিত রিচার্ড থেলারের গবেষণার প্রারম্ভিক পর্বের সঙ্গে এই এনডাওমেন্ট এফেক্টের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
রিচার্ড থেলার তখন পিএইচডি করছেন। গবেষণার বিষয়টি হলো, মানুষের জীবন বাঁচানোর মূল্য। পরবর্তী সময়ে এই গবেষণার ফল ব্যবহার করেই নির্মিত হয় ‘ভ্যালু অফ স্ট্যাটিসটিক্যাল লাইফ’। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে যে ঝুঁকি নিতে হয়, তার জন্য নিয়োগকারী সংস্থা কর্মীদের কতটা অতিরিক্ত অর্থ দেবে? হঠাৎ কী যে খেয়াল হলো, থেলার জনে জনে দু’টি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। প্রথম প্রশ্নটি হলো, যদি কাজের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি একটি নিদিষ্ট শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়, তবে তার জন্য তিনি কত অর্থ খরচ করতে রাজি? দ্বিতীয়টি, কত অর্থ পেলে তিনি কাজের ক্ষেত্রে সেই একই শতাংশ ঝুঁকি বৃদ্ধি মেনে নেবেন? সাবেকি অর্থনৈতিক যুক্তি অনুযায়ী, দু’টির উত্তর একই হওয়া উচিত। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, দ্বিতীয়টির উত্তর প্রথমটির থেকে অনেক গুণ বেশি। কারণ ‘এনডাওমেন্ট এফেক্ট’। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত নিরাপত্তা পেতে যে আগ্রহ, তার থেকে অনেক বেশি অনাগ্রহ নিরাপত্তা অধিকারটুকু ত্যাগ করতে।
তাঁর গাইড শেরউইন রোজেন থেলারের এই পর্যবেক্ষণকে কোনও পাত্তাই দেননি। সেই সময় থেকেই থেলার একটি তালিকা বানাতে থাকেন। অর্থনীতির কেতাব-বাসী মানুষের তাত্তি¡ক আচরণ এবং রক্তমাংসের মানুষের বাস্তব অচরণের মধ্যে গরমিলের তালিকা গবেষণার জন্য নয়, নিজের খেয়ালেই। সেটা সাতের দশকের গোড়ার দিক। সে যুগে অর্থশাস্ত্রের বাধাঁধরা ছকের বাইরে এই ‘অযৌক্তিক’ আচার-আচরণের তালিকা কোনও অ্যাকাডেমিক জার্নালেই ঠাঁই পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতো না। তালিকাটি থেলারের ডায়রিতেই থেকে যেত, যদি না, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কনফারেন্সে তিনি খোঁজ পেতেন দুই ইসরাইলি মনস্তত্ববিদের, যাঁরা অর্থনীতির মহলে তখনও একেবারে অচেনা। ড্যার্নিয়েল ক্যাহনেম্যান ও অ্যামোস ভেরে¯িক। যে ভদ্রলোক খুঁজ দিয়েছিলেন, সেই বারুচ যিশফ থেলারকে একটি গবেষণাপত্র পড়তে দেন। তাতে ক্যাহনেম্যান ও ভেরস্কি বিভিন্ন উদাহরণ দিয়েছেন, যেখানে মানুষের বাস্তব আচরণ অর্থনৈতিক তত্তে¡র সঙ্গে খাপ খায় না। অতঃপর থেলারের প্রতিত্রিয়া- ‘শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পেপারটা পড়তে আমার মাত্র তিরিশ মিনিট লেগেছিল, কিন্তু সেই মুহুর্তে আমার জীবন চিরদিনের মতো পাল্টে গেল।
ক্যাহনেম্যান এবং ভেরস্কি ছাড়া রিচার্ড থেলারের আখ্যানটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অর্থশাস্ত্রের যে শাখায় তাঁর নোবেল, সেই ‘বিহেভিয়ারাল ইকোনমিকস’ নিয়ে তাঁর প্রথম পেপারটির ভিত্তিই দুই ইসরাইলি মনস্তত্ববিদের গবেষণা এবং যেটি প্রথমে প্রায় কোনও জার্নালই ছাপাতে রাজি হয়নি। অথচ এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। ১৭৫৯ সালে অ্যাডাম স্মিথের ‘দ্য থিওরি অফ মরাল সেন্টিমেন্টস’ প্রকাশিত হয়। মানুষের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সামাজিক আচরণের হদিস পেতে গেলে যে তার মনস্তত্তে¡র খুঁটিনাটি অনুধাবন করাটা জরুরি, সেই বোধটি অষ্টাদশ শতকের বিরল হয়ে ওঠেনি। যাকে আমরা ‘হেমো স্যাপিয়ে¯œ’ হিসেবে চিনি, সেই পূর্ণাঙ্গ মানুষের আদলটি পাওয়া যেত সে যুগের অর্থনীতিবিদদের লেখাপত্রে।
একটি সমস্যা ছিল যদিও। অর্থশাস্ত্রের কারবার যেহেতু গড়পড়তা মানুষের আচরণ নিয়ে, বিধাতার সঙ্গে সাপ-লুডো খেলা পাগলকে দিয়ে বাকি মনুষ্যসমাজকে চেনা যায় না, অতএব প্রশ্ন হলো, সেই গড়পড়তা মানুষের চেহারাটি কেমন হবে। সেটি কিছুটা বিমূর্ত হতে বাধ্য, নতুবা ‘কোনও’ ধরনের সার্বিক বিশ্লেষণই সম্ভব নয়। বিমূর্ত না হয়- হলো, কিন্তু কতটা বিমূর্ত? কালে কালে অবস্থাটি এমন দাঁড়াল, অর্থনীতির বইয়ের সেই কাল্পনিক মানুষটির সঙ্গে নিরেট একটি যন্ত্রগণকের কোনও তফাতই রইল না। তার ভাই-বোন, জামাই-বোনাই, জগাই-মাধাই কিছুই নেই, সে দিনরাত মাথা গুঁজে অংক কষে আর হিসাব করে, কী করলে তার স্বার্থ চরিতার্থ (সর্বাদিক উপযোগিতা) হবে। সেই হিসাবে কখনও কোনও ভুলচুক নেই, কোনও বেচাল বা খামখেয়ালিপনা অনুপস্থিত। এই কল্পমানবটির নাম হলো ‘হেমো ইকোনমিকস’। এই জীবটির একটি সুবিধে আছে। তার গড়নটি গাণিতিকভাবে বেশ নিটোল, জড়জগতের মতো, যদিও বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ যৎসামান্য। এরই আর এক জ্ঞাতিভাই হলো ‘হেমো র‌্যাশনালিম’।
র‌্যাশনালিশ বা ইকোনমিকাস, এদের দিয়ে যে কাজ চলবে না, সেটি আরও অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন। যথা অমর্ত্য সেন, তাঁর বিখ্যাত ‘র‌্যাশনাল ফুলস, আ ক্রিটিক অফ দ্য বিহেভিয়ারাল ফাউন্ডেশনস অফ ইকোনমিক থিয়োরি’ প্রবন্ধে। সেই সমালোচনা ছিল তাত্তি¡ক। ক্যাহনেম্যান, ভেরস্কি এবং তাঁদেরই পথ অনুসরণ করে থেলার বাস্তব আচরণকে পর্যবেক্ষণ করলেন, এবং সেই পর্যবেক্ষণ পেশ করলেন মূল ধারার অর্থনীতির আঙিনায়। চালু হলো ‘বিহেভিয়ারাল ইকোনমিকস’।
এতো গেল অর্থনীতির অন্দরমহলের কথা। রিচার্ড থেলার এটিকে আরও সম্প্রসারিত করলেন, দেখালেন আর্থিক ও সামাজিক নীতি প্রণয়নে কীভাবে তাঁদের গবেষণা কাজে লাগতে পারে। তিনি এবং তাঁর সহ-লেখক ক্যাস সানস্টাইন পেশ করলেন একটি নতুন শব্দবন্ধ, লিবারটেরিয়ান পেটারনালিজম।
শব্দটি খটোমটো হলেও অর্থটি দুর্বোধ্য নয়। মোদ্দা বক্তব্যটি হলো, মানুষ সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় না। বুড়ো বয়সের জন্য টাকা না-জমিয়ে দু’হাতে ওড়ায়, ফলে অর্থনীতিতে সঞ্চয়ের হার কমে, কিংবা স্বাস্থ্যকর শাকসবজি ছেড়ে মবিল-পোড়া তেলেভাজায় তার আগ্রহ বেশি, ফলে জনস্বাস্থ্যের দফারফা। তারা যেন সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারে, তার জন্য কিছু পদক্ষেপ দরকার। এটি হলো পেটারনালিজম, অর্থাৎ রাষ্ট্রের পিতৃসুলভ দৃষ্টিকোণ। কিন্তু তার মানে এই নয়, তেলেভাজা খেলেই পেয়াদা এসে ফাটকে পুরে দেবে। তেলেভাজা ও পালংশাক, উভয়ই থাকবে, শুধু এমনভাবে থাকবে যেন উপভোক্তা পালংশাকই বেশি খায়। বাধানিষেধের এই অভাবটিই হলো লিবারটেরিয়ান।
দর্শনটি অনেকেরই না-পছন্দ। জুলিয়ান আসাঞ্জ থেলারের নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদ পেয়ে টুইট করলেন ‘থেলার রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের এক বিপদ প্রবক্তা, যিনি চান রাষ্ট্রীয় নজরদারি ছাড়া কোনও অর্থনৈতিক লেনদেন হবে না।’ এটি বোধহয় রজ্জুতে সর্পভ্রম, কারণ থেলার চান, রাষ্ট্র প্রার্থিত পরিণামের জন্য নাগরিকদের ঠেলা দেবে মাত্র। এই নীতিটি বহু দেশই অতঃপর গ্রহণ করেছে। ব্রিটেনে ডেভিড ক্যামেরন যখন প্রধানমন্ত্রী, তৈরি হয় ‘বিহেভিয়ারাল ইনসাইটস টিম’।
একটিই দেশ গত তিন বছরে ঠিক তার উলটো পথে হেঁটেছে। তাদের মনে হয়েছে হালকা ঠেলাঠেলি নয়, যা করতে হবে গায়ের জোরে, ধাক্কা মেরে, ভয় দেখিয়ে, সাধারণ মানুষের জীবন কোনও না- কোনোভাবে অতিষ্ঠ করে তুলতে পারলেই মোক্ষপ্রাপ্তি। অতএব, ব্যাটা নগদ পয়সার কেনাকাটা করিস, দেখাচ্ছি মজা! কিংবা ‘আধার কার্ড’ করাসনি, কাল থেকে তোর ফোন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, সব কিছুতেই তালা পড়ল বলে।
থেলার ক্যামেরনের উপদেষ্টা হিসেবে একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। যদি কোন কিছু করতে কাউকে উৎসাহিত করতে চান, সেটিকে সহজসাধ্য করুন। কিন্তু উল্লেখিত দেশটি ঠিকই করে নিয়েছে, তারা উলটো পথে হাঁটবে। অতএব, জিএসটি নামক একটি কুন্ডীপাক, নাকাল ব্যবসায়ী মহলে, শুধু রাষ্ট্রের খুশি-খুশি মুখ, হুঁ হুঁ, কেমন প্যাঁচে ফেলেছি! ‘দেশটির কী নাম, সেটি আন্দাজ করার জন্য কোনও পুরুস্কার নেই অবশ্য। যৌক্তিক মানুষের মধ্যে বাস করে আর এক অযৌক্তিক মানুষ। অর্থশাস্ত্রে মানুষের যে অবাস্তব মডেলটি চালু ছিল, তাকে রক্তমাংসের চেহারা দিলেন রিচার্ড থেলার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন