Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঢাকার উন্নয়ন : কিছু প্রস্তাব

| প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর : ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, দেশের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক শহর। অথচ যানজটের কারণে এই শহরের বর্তমান অবস্থা রীতিমত ভয়ংকর এবং দুঃখজনক। প্রতিদিনই রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট। যানজট এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। ঢাকা শহরের রাস্তায় যানজটের কারণে যানবাহনের যে দীর্ঘ লাইন, তা যেন জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। যানজট বিহীন ঢাকা শহর এখন কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। কোথাও যাবার জন্য বের হয়ে কেউ যানজটের কবলে পড়েননি এরকম কোন রেকর্ড নেই। মানুষের জীবনের মূল্যবান সময়গুলো প্রতিদিন রাস্তায় নষ্ট হচ্ছে। যানজটের কারণে নাগরিক জীবনের শান্তি আজ বিতাড়িত। বিশ^ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, যানজটে বছরে ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা আর প্রতিদিনই নষ্ট হচ্ছে ৩২ লক্ষ কর্মদিবস। সংস্থাটির মতে, তীব্র যানজটের কারণে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় গড়ে ৭ কিলোমিটার এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার। এভাবে যানজট নিয়ে কোন শহর টিকে থাকতে পারে না। এভাবে চললে এই শহর অচিরেই পরিত্যাক্ত হবে। ঢাকা শহরের আজকের এই সমস্যা কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দিনের পর দিন সমস্যা বেড়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যার পাহাড়ে ঢাকা শহর এখন ধ্বংসের মুখোমুখি এবং ঢাকা আজ সত্যিই এক বিপন্ন নগরী। সুতরাং বিপন্ন এই ঢাকা শহরকে বাচাঁতে হবে এবং তার জন্য এই মুহুর্তেই বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা শহরকে যানজটের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রকৌশলী এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের সকল নাগরিককে সচেতন এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। একই সাথে আইন ভঙ্গকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
অতিরিক্ত জনসংখ্যাই ঢাকা শহরের প্রধান সমস্যা। বিশ^ব্যাংকের হিসাব মতে, ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। আর ২০৩৫ সালে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি হবে। সুতরাং জনসংখ্যার কারণে ঢাকা একটি ওভার লোডেড শহরে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যান্য শহরে জনগণের নাগরিক সুবিধা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকার কারণে প্রতিদিনই স্রোতের মতো মানুষ ঢাকা শহরে বসবাসের জন্য প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৯,৪৯,৫৯০টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে। তম্মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছে ২,৬১,৭০৫টি ইউনিট। সংস্থাটির হিসাবে শিল্প কর্মসংস্থানের ৪৫ শতাংশই ঢাকায়। স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় জনসংখ্যা বেশি, আবাসিক সংকট বেশি এবং পরিবহন সংকটও বেশি। তা ছাড়া সবকিছুর হেড অফিস ঢাকায় হবার কারণে মানুষকে বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। ফলে ঢাকার জনসংখ্যা কেবল বাড়ছেই। এই কারণেও ঢাকা শহরে সৃষ্টি হয়েছে যানজট মানুষের চলাচলের জন্য যে পরিমাণ যানবাহনের প্রয়োজন এবং সেই যানবাহনসমূহ সুষ্ঠুভাবে চলাচলের জন্য যে ধরনের রাস্তা দরকার তাও ঢাকা শহরে নেই। যার ফলে নিয়মিতভাবেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যানজটের কারণে ঢাকা শহরের প্রতিটি কর্মজীবী মানুষের জীবন থেকে প্রতিটি দিন কমপক্ষে দুই/তিন ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। একদিকে যেমন মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে মানুষের কর্মক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। যানজটের কবলে পড়ে মানুষ তার জীবনীশক্তিকে হারিয়ে ফেলছে। ফলে সে হয়ে পড়ছে দুর্বল এবং ক্লান্ত। এভাবে প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে আমরা কেবল পিছিয়ে পড়ছি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমেই ঢাকা শহরের ওপর থেকে মানুষের অব্যাহত চাপ কমাতে হবে। ছোট্ট একটি শহরে এতগুলো মানুষের সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে বসবাস কখনো সম্ভব নয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে ঢাকার জনসংখ্যা কমাতেই হবে। তার জন্য ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ঢাকার মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। ঢাকা শহরে অবস্থিত শিল্প-কারখানা বিশেষ করে গার্মেন্টস কারখানাসমূহ শহরের বাইরে স্থাপন করতে হবে। ঢাকার আশে পাশের জেলা গুলোতে গার্মেন্টস পল্ল­ী স্থাপন করে সেখানে যদি ঢাকা শহরের গার্মেন্টসগুলোকে সরিয়ে নেয়া হয়, তাহলেও ঢাকা শহরের জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ কমে যাবে। এটা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। ঢাকার বাইরে কতগুলো নির্দিষ্ট স্থানে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির সরবরাহ নিশ্চিত করে সেখানে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন করতে হবে এবং সেখানেই ঢাকা শহরের শিল্পকারখানাসমূহ সরিয়ে নিতে হবে এবং নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে। এর ফলে ঢাকা শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ যেমন কমে যাবে, ঠিক তেমনি কারখানায় লোকজনের যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহনের জন্য যে সমস্ত গাড়ি ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে চলাচল করে তাও বন্ধ হবে। ঢাকা শহরের গার্মেন্টসমূহ ঢাকার বাইরে স্থাপিত হলে গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরাও লাভবান হবে। কারণ এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিকে শ্রমিক পাওয়া যাবে। বর্তমানে পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা যে বেতন পায় তাতে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া করে জীবন ধারণ করাটা খুবই কষ্টকর। এজন্য তাদের জীবনে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ঢাকার বাইরে পল্ল­ী অঞ্চলে গার্মেন্টস স্থাপিত হলে গ্রামের মেয়েরা নিজ বাসায় থেকেই চাকরি করতে পারবে। এতে গ্রাম উন্নত হবে এবং গ্রামে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ফলে বেকার মানুষেরা কাজের সন্ধানে আর ঢাকা আসবে না। একই সাথে ঢাকার বাইরে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। মোট কথা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এভাবে ঢাকামুখী জন¯্রােত কমে আসবে। শিল্প কারখানাসমূহকে ঢাকার বাইরে স্থাপন করার পাশাপাশি ঢাকার অদূরে নতুন করে প্রশাসনিক রাজধানী স্থাপন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের অফিস এবং বাসভবন থেকে শুরু করে সচিবালয় সেখানে স্থাপন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সকল সংস্থার হেড অফিসও সেখানে স্থাপন করতে হবে। সেন্ট্রাল ব্যাংকসহ ব্যাংকসমূহের হেড অফিস, সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টের অফিসও সেখানে সরিয়ে নিতে হবে। এতে প্রশাসনেও গতি আসবে। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের বর্তমান রাজধানীর বাইরে নতুন আরেকটি প্রশাসনিক রাজধানী গড়ে তুলছে। মালয়েশিয়ার পুত্রজায়া তার উদাহরণ। কুয়ালালামপুর সে দেশের রাজধানী হলেও, প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়া। মিয়ানমারও রাজধানী ইয়াংগুনের বাইরে নতুন একটি প্রশাসনিক রাজধানী গড়ে তুলছে। ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে, ঢাকার অদূরে প্রশাসনিক রাজধানী স্থাপন করতেই হবে এবং এর কোন বিকল্প নেই। আর ঢাকা শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে যাতায়াত করে অফিস করাটা খুব কষ্টের কিছু নয়। রাস্তাঘাট যদি উন্নত হয় এবং যানজটমুক্ত হয়, তাহলে তা সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার পথ। ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষেরা এর চেয়েও বেশি দূরত্বের পথ যাতায়াত করে অফিস করে। এমনকি ভারতের মানুষেরাও এরকম দূরত্ব অতিক্রম করে অফিস করছে। সুতরাং এটা অসম্ভব কিছু নয়। ঢাকা শহরের দশ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে যেখানে যানজটের কবলে পড়ে দুর্ভোগের মধ্যে এক ঘণ্টার বেশি সময় প্রতিদিনই ব্যয় হয়, সেখানে যানজটমুক্ত পরিবেশে এক ঘণ্টা সময়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে গিয়ে অফিস করাটা অযৌক্তিক এবং অসম্ভব কিছু নয়। বর্তমানে অনেকগুলো বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঢাকা শহরে অবস্থিত এবং এসব বিশ^বিদ্যালয়ে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। এসব বিশ^বিদ্যালয়কে অবশ্যই স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে যেতে হবে এবং সেখানে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আর এই ক্যাম্পাস হতে হবে অবশ্যই ঢাকা শহরের বাইরে। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়সমূহ ঢাকার বাইরে স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে গেলে এবং সেখানে ছাত্রদের জন্য আবাসিক হোস্টেলের ব্যবস্থা করলে সেক্ষেত্রে ঢাকার ওপর চাপ কমবে এবং এটা যানজট কমাতে ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
যানজটের নগরী ঢাকা’র আরেক সমস্যার নাম জলাবদ্ধতা। একটুখানি বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তখন যানজট আরো বেড়ে যায় এবং নাগরিক জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সুতরাং ঢাকাকে যানজট মুক্ত করার পাশাপাশি জলাবদ্ধতা থেকেও মুক্ত করতে হবে। তার জন্য ঢাকা শহরে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ও পয়ঃনিস্কাশন সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে হবে। নগরীর খালসমূহ চিহ্নিত করে এগুলোকে পুনঃখনন করতে হবে। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় পুকুর, লেক এবং জলাশয়কে ভরাট করার যে প্রতিযোগিতা চলছে তা এখনই বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পিত ড্রেনেজ এবং পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করেই ঘর বাড়ি এবং হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। হাউজিং কোম্পানিসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন করতে হবে এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বুড়িগঙ্গা দখল বন্ধ করতে হবে এবং শীতলক্ষ্যা খনন করতে হবে। কারণ ভরাট হয়ে যাবার কারণে শীতলক্ষ্যা আর আগের মতো পানি বহন করতে পারছে না। ঢাকার মাঝখানে যেসব খাল ছিল সেগুলোকে চিহ্নিত করে পুনঃখনন করতে হবে। সরকারি হিসাব মতে, ঢাকা শহরের ২৩টি খালের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। কাগজে-কলমে এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে এগুলো ভরাট হয়ে গেছে বহু আগেই। সুতরাং এসব খাল খনন করতে হবে এবং নগরীর ড্রেনগুলোর সাথে এসব খালের সংযোগ ঘটাতে হবে, যাতে করে অতি সহজেই ড্রেন থেকে পানি খালে আসতে পারে। আর এই খালসমূহের সাথে নদীর সংযোগ ঘটাতে হবে। এভাবেই পরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এজন্য রাজউককে স্পেশাল পরিকল্পনা নিতে হবে। এছাড়া ঢাকা শহরের আশে-পাশের নি¤œাাঞ্চলসমূহ ভরাট করে হাউজিং কোম্পানি কর্তৃক আবাসিক এলাকা তৈরির কারণে ঢাকা শহরের পানি আর আগের মতো নামতে পারছে না। এসব সমস্যার সমাধান করে পরিকল্পিত ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনে একটি বিশেষ মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। এভাবে ঢাকাকে বাচাঁতে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে না এলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হবে, যা দেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক



 

Show all comments
  • রাফি ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৬:১৯ এএম says : 0
    প্রাথমিক প্রর্যায় গার্মেন্টস সরিয়ে নিলেই ভাল ফল পাওয়া যাবে
    Total Reply(0) Reply
  • Dewan Ekramul Haque ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১০:৪১ এএম says : 0
    Dear Sir/ Madam I would like to inform you that, I have a better plan jam free Dhaka city without any cost. Thanking you Ekram Managing Director Diadem Dairy Limited Diadem Trading Co.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন