Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অবহেলিত রফতানি বাজার

চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি নেপাল ভারত মিয়ানমার চীন ভুটানে হরেক পণ্যের চাহিদা

| প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বন্দর ব্যবহারে জোরালো আগ্রহ নেপালের : সমন্বিত উদ্যোগের অভাব
শফিউল আলম : অবহেলিত রয়েছে প্রতিবেশী দেশসমূহে বিশাল রফতানির বাজার। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি নেপাল, ভারতের বিশেষত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে, মিয়ানমার, চীন ও ভূটানে হরেক ধরনের নিত্যপণ্য, শিল্পজাত, ভোগ্য ও সেবাপণ্যের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের জন্য জোরালো আগ্রহ ব্যক্ত করেছে নেপাল। সম্প্রতি নেপালের সরকারি ও বাণিজ্য প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নেপাল চায় বাংলাদেশ থেকে অধিকহারে পণ্যসামগ্রী আমদানি। সেই সাথে চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে নেপালে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিভিন্ন দেশে রফতানিও করতে চায় নেপাল। এতে করে নেপালের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেতে পারে বিপুল অঙ্কের সার্ভিস চার্জ। অথচ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থাসহ ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি প্রতিবেশী দেশে পণ্য ব্যাপক পরিমানে রফতানি করা যাচ্ছে না।
সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চলটির তিন দিকজুড়েই রয়েছে বিশাল রফতানি বাজার সুবিধা। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের সাথেই সম্পৃক্ত হয়ে আছে ব্যাপক রফতানি বাজার প্রসারের বড় ধরনের সুযোগ ও সম্ভাবনা। তবে এরজন্য নেই সময়োচিত উদ্যোগ। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বলছেন, বার্ষিক হাজার কোটি টাকা মূল্যের কমপক্ষে ৫০ ধরণের ভোগ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী, সেবাজাত পণ্য রফতানির সুযোগ উপেক্ষিত রয়েছে। বাজার প্রসারের পরিবর্তে বরং দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আটকে আছে অবারিত বিশাল রফতানির পশ্চাদভূমি। নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোতে দীর্ঘ ঘুরপথে পণ্যসামগ্রী আমদানি ও রফতানি করা হচ্ছে সিঙ্গাপুর, কলম্বো, মালয়েশিয়ার সমুদ্রবন্দর দিয়েই। সরাসরি রফতানি বৃদ্ধি করা হলে ব্যয় ও মূল্য সাশ্রয় সম্ভব।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল, চীন, মিয়ানমার ও ভূটানে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর রফতানি বাজার চাহিদা তৈরি হয়ে রয়েছে। সহজপথে নিকটতম প্রতিবেশী দেশের মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রী ও সেবাপণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা ভোক্তাসাধারণের জন্য অনেক সহজ। এতে করে বাজার সম্ভাবনা ক্রমাগত খুলে যাবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। বিস্তৃত হবে চট্টগ্রাম বন্দরভিত্তিক কর্মকাÐ।
কিন্তু এখন সুদীর্ঘ ঘুরপথে পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করা বাবদ বাড়তি খরচ, জটিলতা ও সময়ের অপচয় ঘটছে। সময় ও অর্থ সাশ্রয় করার জন্য বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী আমদানির ব্যাপারে প্রতিবেশী অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে। বর্ডার হাট ও স্থল বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রীর রফতানি চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধ ও পেটেন্ট সামগ্রী, ভেষজ দ্রব্য, শাড়ী, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, আসবাবপত্র, কৃত্রিম অলংকার-গহনা, তথ্য-প্রযুক্তি সামগ্রী, আসবাবপত্র, হালকা ও মাঝারি আকৃতির কার্গো কোস্টার নৌযান, সিমেন্ট, হালকা যন্ত্রপাতি, কেবলস, লোহা ও স্টিলস সামগ্রী, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও বেকার্স খাদ্যদ্রব্য, খেলনা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পপণ্য, সৌখিন সামগ্রী প্রভৃতি পণ্যের ব্যাপক ভোক্তা চাহিদা প্রতিবেশী দেশসমূহে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য প্রসারের জন্য পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন অপরিহার্য। তবে এই দিকটি উপেক্ষা করা হচ্ছে। এরজন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের যুগোপযোগী আধুনিকায়ন, অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির সংযোজন, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণ, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার-ঘুনধুম পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন, নৌ-বন্দরের সাথে পণ্যসামগ্রী পরিবহন নেটওয়ার্কের উন্নয়নও অপরিহার্য।
চট্টগ্রামের পোর্ট-শিপিং বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, রফতানি বাণিজ্যে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘হাব’ বা সূতিকাগার হয়ে উঠতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলক্ড) এই বিশাল অঞ্চলে প্রাথমিক পর্যায়ে বাণিজ্যের সম্ভাব্য আকার-আয়তন হতে পারে পর্যায়ক্রমে বার্ষিক ৫শ’ জাহাজ এবং ১ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার। যার পরিমাণ ৫০ লাখ মেট্রিক টন থেকে ক্রমেই ১ কোটি মেট্রিক টন বা তার চেয়েও দ্বিগুণ মালামাল ডেলিভারী পরিবহন। সমুদ্রবন্দর ও বন্দরভিত্তিক কাস্টমসের ৮০ হাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সুযোগ থাকলেও উদ্যোগ সীমিত।
পোর্ট-শিপিং সূত্র মতে, বাংলাদেশের বন্দর সম্পদই সর্ববৃহৎ এক সম্পদ। সমুদ্র বন্দরের রয়েছে সুবিশাল হিন্টারল্যান্ড অর্থাৎ পশ্চাদভূমি। দেশ ও জাতির ভাগ্যেন্নয়নে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার ধারক এবং প্রবেশদ্বার হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দর-সম্পদের সম্ভাবনাগুলো সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করলে দেশ ও জাতি নিশ্চিতভাবে লাভবান হতে পারবে। এতে করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে নিশ্চিত। তাছাড়া বহুমুখী খাত-উপখাত বিকাশ লাভ করবে।
এদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দ্য সেভেন সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত ৭টি রাজ্য বিশেষত ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মনিপুর, নাগাল্যাান্ড এবং নেপাল ও ভূটান, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশসহ পশ্চিম-দক্ষিণ মিয়ানমার, কুনমিন প্রদেশসহ দক্ষিণ চীন মিলিয়ে বিরাট একটি অঞ্চলের জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ‘আঞ্চলিক হাব-পোর্ট’ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে। তবে এরজন্য সড়ক ও নৌপথ সংস্কারসহ অবকাঠামো সুবিধা প্রসারিত করা অপরিহার্য। প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা তথা দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর ভোক্তাসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে রফতানি বাজার স¤প্রসারণের অপার সুযোগ রয়ে গেছে। অথচ বর্তমানে ভারত, মিয়ানমার, ভূটান, চীন থেকে অবৈধ পথে আনীত পণ্যসামগ্রীর বেপরোয়া চোরাচালানেই দেশের বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। চিপস, আচার, জুতা-স্যান্ডেল, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, প্রসাধন সামগ্রীসহ হরেক পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে নি¤œমানের। তা সত্তে¡ও বাজারে অবাধে বিকিকিনি হচ্ছে চোরাচালানের সামগ্রী। দেশীয় শিল্পখাত মার খাচ্ছে। ঠেকানো যাচ্ছে না চোরাচালানের ঢল।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে উৎপাদিত শিল্প, কৃষিজ ও ভোগ্যপণ্য প্রতিবেশী দেশসমূহে রফতানি প্রসারের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। সরাসরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি করা সম্ভব। এরফলে রফতানি জটিলতা দূরীভূত হবে। দেশে কর্মসংস্থানের পথ আরও উন্মুক্ত হবে। এই লক্ষ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ