Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ক্ষুদ্রঋণের কালো থাবা: বিকল্প হতে পারে করযে হাসানা

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? লোকেরা বলল, তিন দিনার রেখে গিয়েছে। তখন তিনি তার জানাযার নামায পড়ালেন। এরপর আরেকজন মাইয়িতকে উপস্থিত করা হলো, উপস্থিত সাহাবাগণ তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? লোকেরা বলল, জানি না। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো কি ঋণ আছে? লোকেরা বলল, তিন দিনার ঋণ আছে। তখন তিনি বললেন, তোমাদের সাথীর জানাযা তোমরাই পড়। এ কথা শুনে সাহাবী আবু কাতাদা রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তার জানাযার নামায পড়িয়ে দিন, তার ঋণ আমার জিম্মায় নিলাম। আমি তা আদায় করে দিব। তখন তিনি জানাযার নামায পড়ালেন। [বুখারী, হাদীস: ২২৮৯] কেউ মারা গেলে তার জানায় অংশ গ্রহণ করাটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল ছিল। উম্মাহকেও এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ তাকিদ দিয়েছেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে কোনো জানাযা হয়ে থাকলে দাফনের পরও তিনি তার জানাযা আদায় করেছেন। [মুসলিম, হাদীস: ৯৫৬; আহমাদ, হাদীস: ৯০৩৭] এতদসত্তেও ঋণ পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা না করে যাওয়ার কারণে জানাযা উপস্থিত হওয়ার পরও তার জানাযা পড়াতে অসম্মতি জানিয়েছেন। মূলত এ অসম্মতির মধ্য দিয়ে তিনি উম্মতকে এ বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, করয বা ঋণের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কেউই যেন একান্ত ঠেকা ও পরিশোধের প্রবল ধারণা ছাড়া ঋণ না নেয়। নিতান্ত ঠেকায় পড়ে নিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা পরিশোধ করে ফেলবে। না পারলে মৃত্যুর আগে পরিশোধের ইন্তিজাম অবশ্যই করে যাবে। ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতারও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। নি¤েœ তা উল্লেখ করা হলো- ১. একান্ত ঠেকায় পড়ে কেউ করয চাইলে সামর্থ্য থাকলে ও মুনাসিব মনে হলে করয দিবে। কারণ ঋণ দেওয়া মূলত হাজতমান্দ ও মুখাপেক্ষীকে সাহায্য করা। টাকার অভাবে তার উপর যে বিপদ নেমে আসতো ঋণ দিয়ে সে বিপদ দূর করা। এ জন্য কুরআন-হাদীসে মুখাপেক্ষী ও বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করার যে সওয়াব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তা এখানেও প্রযোজ্য হবে। ২. সময়মতো ঋণ পরিশোধে ঋণগ্রহীতা অক্ষম হলে সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া বা মাফ করে দেওয়া অনেক বড় সওয়াবের কাজ। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, যদি খাতক অভাবগ্রস্থ হয়, তবে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া উচিত। আর যদি ঋণ মাফ করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। [বাকারা: ২৮০] সাহাবী আবূ মাসউদ রা. এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জনৈক ব্যক্তির মৃত্যুর পর হিসাব নেওয়া হলে, তার কোনো নেক আমল পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে মানুষের সাথে লেনদেন করত এবং সে ছিল বিত্তবান। কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ ছিল, দেনা আদায়ে অক্ষমদের যেন মাফ করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বললেন, অক্ষমকে মাফ করার সক্ষমতা তো তার চেয়ে আমার বেশি। এরপর তিনি ফেরেশতাদেরকে তাকে মাফ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। [মুসলিম, হাদীস: ১৫৬১] সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি অক্ষমকে সুযোগ দেয় বা আংশিক ঋণ কমিয়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়াতলে জায়গা দিবেন, যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। [তিরমিযী, হাদীস: ১৩০৬] সাহাবী আবু কাতাদা রা. বলেন, আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যার পছন্দ যে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের কঠিন বিপদসমূহ থেকে মুক্তি দিন, সে যেন অসচ্ছল ঋণগ্রহীতাকে সুযোগ দেয় বা মাফ করে দেয়। [মুসলিম, হাদীস: ১৫৬৩] উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো প্রমাণ করে অক্ষম ঋণদারকে সুযোগ দেওয়া বা পারলে একেবারে মাফ করে দেওয়া অত্যন্ত পূণ্যের কাজ ও পরকালে মুক্তির উসীলা। তাই সকল ঋণদাতার উচিত এ দিকে লক্ষ্য রাখা। ৩. নির্ধারিত সময়ের পওে তো বটেই, প্রয়োজনে সময়ের আগেও পরিশোধ তলব করা যাবে। তবে সর্বাবস্থায় ন¤্রতা ও ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া কর্তব্য। কঠোরতা, গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত। সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর রহমত নাযিল করুন, যে সহৃদয় যখন বিক্রি করে, যখন ক্রয় করে এবং যখন নিজের হক তরব করে। [বুখারী, হাদীস: ২০৭৬] আব্দুল্লাহ ইবেন উমর ও আয়েশা রা. বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের প্রাপ্য হক তলব করে, সে যেন পবিত্রতার সঙ্গে তলব করে। [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস: ৫০৮০] ৪. ভোগ্য ঋণ হোক বা ব্যবসায়ী ঋণ, মূলধনের অতিরিক্ত কোনো কিছুর শর্ত করা যাবে না। কারণ এটা সুদ। সুদের ভয়াবহতার কথা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। এরুপ কেউ করে ফেললে যথা নিয়মে তওবা করে কেবল মূলধনই গ্রহণ করবে। বাড়তিটা গ্রহণ করবে না। ৫. খোটা দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে ঋণগ্রহীতাকে কষ্ট না দেওয়া। কারণ এতে ঋণদানের যে সওয়াব তা নষ্ট হয়ে যায়। এ জাতীয় অভ্যাস কারো থাকলে তা পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ তোমরা খোটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদকাকে সে ব্যক্তির মতো নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ^াস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এ রকম- যেমন একটি মসৃণ পাথরের উপর মাটি জমে আছে। অতপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং সেটিকে পুনরায় মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরুপ লোক যা উপার্জন করে তার কিছুই তাদের হস্তগত হয় না। আর আল্লাহ কাফেরদেরকে হেদায়াত দান করেন না। [বাকারা: ২৬৪] আমাদের এ দেশে এখন পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে করযে হাসানা চালু থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু নেই। এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করা গেলে দেশ ও জাতির কল্পনাতীত উপকার হবে। মানব ও মানবতা মুক্তি পাবে ক্ষুদ্রঋণের কালো থাবা থেকে। বিত্তবান দীনদার শ্রেণী উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো মেনে করযে হাসানার অশেষ ফযীলতের দিকে তাকিয়ে একক বা যৌথ উদ্যোগে করযে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার জন্য এর প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে পারেন। এটা করতে হবে কেবল বর্ণিত ফযীলত ও সওয়াবের আশায়। দুনিয়াবী কোনো উপকার বা লাভ-লোকসানের কথা মাথার বাইরে রাখতে হবে। সেই প্রতিষ্ঠানে ফযীলত ও সওয়াবের আশা নিয়ে অংশ নিতে যারা আসবে, মুনাসিব মনে করলে তাদেরকেও শরীক করবে। ঋণপ্রার্থীর অবস্থাভেদে ঋণের পরিমাণ ও মেয়াদ কম বেশি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য দুই বা দুইয়ের অধিক সাক্ষি রাখবে। সম্ভব হলে জামানত হিসাবে ঋণের সমমূল্যের কোনো কিছু বন্ধক রাখবে। তবে সে বন্ধকী বস্তু ব্যবহার করতে পারবে না। এসব দেখাশুনা ও তদারকী করার জন্য আলাদাভাবে কিছু লোক নিয়োগ দিবে। যাদের বেতন-ভাতার জন্য আলাদা ফান্ড থাকবে। সে ফান্ড থেকেই তাদের বেতন-ভাতা নির্বাহ করা হবে। ঋণ বিতরণ-আদায় ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে সরকারের সহযোগিতা নিবে। সরকারকেও এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। এ ছাড়াও কুরআন-হাদীস সমর্থিত আরও কোনো আইডিয়া থাকলে সেগুলোও কাজে লাগানো যেতে পারে। করযে হাসানার এ ধারা চালু করা গেলে জাতি মুক্ত হবে সুদভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণের রাহুগ্রাস থেকে। দারিদ্রবিমোচন হবে আবশ্যিকরুপে ইনশাআল্লাহ। উম্মাহ মুক্ত হোক সুদভিত্তিক ক্ষদ্রঋণের কালো থাবা থেকে। সুদমুক্ত ঋণের এ আগুন ছড়িয়ে পড়ৃক সবখানে। করযে হাসানা বিকল্প হয়ে উঠুক উম্মাহর জীবনে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ