Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

গীবত বা পরনিন্দা : সমাজের উপর প্রভাব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গীবত বা পরনিন্দা সামাজিক শান্তি বিধ্বংসী একটি ঘৃণ্য অপরাধ। আল-কুরআনে গীবতকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর হাদীসে একে ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ আজকাল অপরের দোষ চর্চা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরের দোষ চর্চা না করলে মনে হয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কি যেন প্রয়োজনীয় কাজটি বাদ পড়ে গেছে। গীবত এত গোনাহের কাজ হওয়া সত্তে¡ও আমরা গীবত পরিত্যাগ করিতে পারছি না, গীবত বর্জনের কোন প্রচেষ্টাও করছি না। এর জন্য অবশ্য আমাদের অজ্ঞানতা, আমাদের অসচেনতা, অবহেলা ইত্যাদিই মূলত দায়ী। আলোচ্য প্রবন্ধে এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
গীবত এর পরিচয় ঃ গীবত আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ অন্যের দোষ-ত্রæটি প্রকাশ করা, অসাক্ষাতে দুর্নাম করা, কুৎসা রটনা করা ইত্যাদি। গীবতের পরিচয় প্রসঙ্গে রাসূল (সা:) বলেছেন, তোমরা ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে এমন কিছু উল্লেখ করা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে তাই গীবত। রাসূল (সা:) আরো বলেছেন, গীবত হচ্ছে, তুমি অপর ব্যক্তির এমন দোষ ত্রæটি বর্ণনা করছ যা প্রকৃত পক্ষেই তার মধ্যে বিদ্যমান আছে। ইমাম গাযালী বলেন, গীবত হচ্ছে তুমি তোমার ভাইয়ের দোষ ত্রæটি এমনভাবে উল্লেখ করলে যে, তা যদি তার কানে পৌছে তবে সে তা অপছন্দ করবে। ইবনুল আছীরের মতে, কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দুর্নাম করা, যদিও তার মধ্যে সেই দোষ থেকে থাকে তাই গীবত। ইমাম নববীর মতে, কোন ব্যক্তিকে এমনভাবে উল্লেখ করা যা সে অপছন্দ করে তা প্রকাশে হোক বা ইশারা ইঙ্গিতে হোক, তাই গীবত। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর মতে, গীবত হচ্ছে কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে চিন্তান্বিত হবে। তা সত্য হলেও। আর সে কথা মিথ্যা হলে তার নাম অপবাদ। আল্লামা রাগিব ইস্পাহানীর মতে, নি®প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির দোষ প্রকাশ করা হচ্ছে গীবত।
বস্তুত কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষ-ত্রæটি বর্ণনা করা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়, তাকে গীবত বা পরনিন্দা বলে। গীবত বাচনিক অথবা লেখনীর মাধ্যমে অথবা অঙ্গ-প্রতঙ্গের ইশারা ইঙ্গিতে কিংবা অন্য যে কোন উপায়েই বর্ণনা করা হোক এবং সে ব্যক্তি মুসলমান অথবা অমুসলিম হোক সর্বাবস্থায় গীবত ঘৃণ্য কাজ। যদি এমন দোষ-ত্রæটি করা হয়, যা ঐ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় না, তবে তা মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে। যাকে কুরআনের পরিভাষায় বুহতান ‘‘বুহতান ঃ হযরত আবূ হুরাইয়া (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! গীবত কি? তিনি বললেন, তোমার ভাই সম্পর্কে তোমার এমন আলোচনা যা সে অপছন্দ করে। প্রশ্নকারী বলল, আমি যা বলি তা যদি বাস্তবিকই তার মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার কি মত? তিনি বললেন, তুমি যা বল তা যদি বাস্তবিকই তার মধ্যে থেকে থাকে তবেই তা তার গীবত করলে। তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে না থেকে থাকে তবে তুমি তাকে মিথ্যা অপবাদ (বুহতান) দিলে [দ. তিরমিযী, বিরর ওয়াসসিলাহক অধ্যায়] বলে।
বর্তমানকালে এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে কম-বেশী গীবত বা পরচর্চা হয় না। অবশ্য যারা এই পরচর্চায় জড়িত তাদের কাছে গীবতের সংজ্ঞা একটু ভিন্নতর। যেমন তাদের মতে কারো এমন কোন দোষ বর্ণনা করাকে গীবত বলে- যা তার সামনে বলা সম্ভব নয়। অতএব, সামনে বর্ণনা করা যায় এমন দোষ- ত্রæটি বলাবলি করলে গীবত হবে না। অথচ রাসূলের হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, কারো সামনে বলার মত দোষ হোক কিংবা নাই হোক উভয় প্রকার দোষ-ত্রæটির চর্চাই গীবতের শামিল। সমাজের কিছু লোক একথাও বলে যে, কারো মধ্যে যে দোষ নেই তাকে সেই দোষে দোষী করাকে গীবত বলে। কিন্তু যে দোষ প্রকৃতপক্ষে তার মধ্যে আছে তা বর্ণনা করলে গীবত হবে না। তাদের এ ধারণাটিও অমূলক। কেননা উপরের সংজ্ঞা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, দোষ বর্ণনা করা হচ্ছে তা যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে না থাকে তবে তা বুহতান (অপবাদ) আর তা গীবতের চেয়েও জঘন্য অপরাধ। আজকের সমাজের অন্য এক শ্রেণীর লোকের মতে যে দোষটি অন্যের জানা নেই, সে ধরণের দোষ ত্রæটি বর্ণনা করা গীবত। কিন্তু যা সকলে জানে তা বর্ণনা করা গীবত হবে না। তাদেরকে গীবত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলে, এটা গীবত নয়। কেননা আমি যা বলছি, তা সবাই জানে। এটা গীবত হয় কি করে? আসলে এটাও তাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা। কেননা দোষ প্রকাশিত হোক বা গোপন হোক সব ধরণের দোষ বর্ণনা করাই গীবত। আর কারো গোপন দোষ বলে বেড়ালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দু’টো গুণাহ হবে। একটি গীবত করার গুনাহ, আর অন্যটি দোষ প্রচার ও প্রকাশ করার গুনাহ। গীবত বা পরনিন্দা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান। দৈনন্দিন জীবনে গীবতকে আমরা বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করি যেমন-
১। মুসলমানের গীবত : এক মুসলমান অপর মুসলমানের গীবত করা সম্পূর্ণ হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন; তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমরা কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ কর? আসলে তোমরা তা ঘৃণা করা। ২। অমুসলিম নাগরিকের গীবত ঃ ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিকের গীবত করাও হারাম। কেননা অমুসলিম নাগরিক ইসলামী রাষ্ট্রে মান-মর্যাদা ও ইজ্জত আবরু রক্ষার ক্ষেত্রে সমমর্যাদা সম্পন্ন। তাই এদের মান-সম্মানে আঘাত লাগে এরূপ গীবত করা হারাম। ৩। যুদ্ধরত অমুসলিম শত্রæর গীবত ঃ ইসলামী আইন শাস্ত্রের গ্রন্থাবলী থেকে জানা যায় যে, অমুসলিম শত্রæর গীবত করা জায়েয। তাফসীরে কাবীরে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী সূরা হুজুরাতের ১২নং আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, কাফিরের গীবত করা জায়েয। সম্ভবত তিনি কাফির বলতে যুদ্ধরত শত্রæ কাফিরদেরকেই বুঝিয়েছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক পরিজ্ঞাত। ৪। জীবিত ব্যক্তির গীবত ঃ জীবিত ব্যক্তির গীবত করা হারাম। যা উপরোক্ত তিন প্রকার বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। ৫। মৃত ব্যক্তির গীবত ঃ মৃত ব্যক্তির গীবত করার হারাম। তদ্রæপ মৃত ব্যক্তিকে গালি দেয়া, মন্দ বলা, তার দুর্নাম-বদনাম করাও হারাম। যদিও সে জীবদ্দশায় পাপকর্মে লিপ্ত থাকে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা:) বলেছেন, তোমাদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে তাকে ছেড়ে দাও এবং তার গীবত করো না। আর তিনি গালি গালাজ প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ তোমরা মৃতদেরকে গালি দিও না, কারণ তারা তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান পাওয়ার স্থলে পৌছে গেছে।
(চলবে)



 

Show all comments
  • আবছারউদ্দিন ১৬ জুন, ২০২২, ৮:৫৭ পিএম says : 0
    অনেক ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ