Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মতভেদ ও মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য-১

মুফতি মো. আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ভূমিকাঃ গুণীজন ছাড়াও সাধারণ শিক্ষিতজন এমনকি নিয়মিত ধর্মকর্ম পালন করেন এমন সাধারণ আলেম ও সৎ-মোত্তাকি নেককার মুসলমানগণও অনেক ক্ষেত্রে শিরোনামে উল্লিখিত বিভিন্ন মতভেদ-বিরোধের আপসের পার্থক্য বুঝে উঠতে পারেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে ধর্মকর্ম/ঈমান-আমল-ইবাদত সম্পর্কিত বিষয়ে যা একজন মুসলমান নিঃস্বার্থভাবে কেবল পরকালীন কল্যাণ সামনে রেখে যথাসাধ্য আমল করে থাকেন; তাতেও যখন বিরোধপূর্ণ বক্তব্য, বিতর্কপূর্ণ উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন অথবা তেমন কিছু বই-পুস্তকে পাঠ করেন তখন সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন হন, ক্ষেত্রবিশেষ ত্যাক্ত-বিরক্ত হন। যে-কারণে সংশ্লিষ্ট সকলের মানসিক সংশয় ও আত্মিক প্রশান্তির লক্ষ্যে এবং জ্ঞানচক্ষুর অধিক বিকাশের প্রয়োজনে লেখার এ প্রয়াস। 

প্রাসঙ্গিক শব্দগুলোর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা ঃ
(ক) ‘ইখতিলাফ’ আরবী শব্দটির শাব্দিক অর্থ: অমিল, ভিন্নতা, মতভেদ, মতানৈক্য ও বিতর্ক ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনের ৩নং সুরা ‘আলে-ইমরান’ এর ১৯০ নং আয়াতে শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘পরিবর্তন’-বিবর্তন (আরবী-বাংলা অভিধান: ইফা) সচরাচর বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা ‘বিরোধ’ বলতে বুঝে থাকি, শত্রæতা,ভ্রাতৃ-বিরোধ, অনৈক্য, পরস্পর বৈপরীত্য বা মত-বিরোধ (সংসদ বাঙ্গালা অভিধান) ‘মত’ মনোগত ভাব, অভিমত, ধারণা; ‘মতোবিরোধ’ বা ‘মতভেদ’ মানে মতানৈক্য বা মতের অমিল (প্রাগুক্ত)।
আর ‘গবেষণা বিরোধ’ বলতে বুঝি, গবেষণা করতে গিয়ে বা গবেষণার প্রয়োজনে, অনুসন্ধান কেন্দ্রিক অনিবার্য বিরোধ।
এছাড়া, ‘বিবাদ’ বলতে ‘বিরোধ’ হলেও তা এমন বিরোধ যাতে ‘কলহ’ ‘ঝগড়া’, তর্কাতর্কি ও মকদ্দমা-লড়াইও বোঝায়, বা অন্তভর্‚ক্ত (প্রাগুক্ত)
সাধারণ জ্ঞানে আমরা বুঝতে পারি যে, ‘বিরোধ’ মানে যদি শত্রæতা, কলহ, ঝগড়া, অশালীন বিতর্ক বা মামলা-লড়াই ইত্যাদি হয় তাহলে সেটা অবশ্যই ভালো নয়, মন্দ। আর যদি মতের অমিল বা ভেদ-রহস্য বা অনিবার্য কারণে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পেরে মতানৈক্য বা মতবিরোধ হয় এবং বাস্তবে সবাই মিলেমিশে, প্রেম-ভালোবাসা ও আদব-শ্রদ্ধা রক্ষা করেন তাহলে সেটাকে তেমন মন্দ ভাবার সুযোগ নেই। আবার এমন ধর্মীয় প্রয়োজনে বিরোধ বা গবেষণা বিরোধে জড়িয়ে পড়ায় কোনো দোষ হবে না মর্মে, এমনকি তাতে উভয় পক্ষ বা কোনো একপক্ষ বাস্তবে ভ‚ল করলেও নূন্যতম একগুণ সওয়াব এবং শুদ্ধ করলে দ্বিগুণ সওয়াবের কথা যেহেতু খোদ মহানবী (স) এর পবিত্র মুখে শোনানো হয়েছে( সহীহ বুখারী মূল আরবী, খ-২,পৃ-১০৯২, মাকতাবা মোস্তাফাঈ, দেওবন্দ, ভারত )।
তাই তেমন ধর্মীয় গবেষণা বা বিধি-বিধান নির্ণয়ের প্রয়োজনে যে দলিল-প্রমাণগত মত- বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠে সেটাকে একজন মুসলমান মন্দ ভাবতে পারে না। তবে হ্যাঁ, এটা সত্য কথা যে, বিরোধকারীগণকে যথাযোগ্য কুরআন-হাদীস বিশেষজ্ঞ হওয়া চাই এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর নিয়ম-বিধি পালনে অভ্যস্থ হওয়া চাই।
এবার এতদসংক্রান্ত আরবী ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলোকে একটু ব্যাখ্যাসহ লক্ষ্য করি। “কারও অবস্থা-পরিস্থিতি, উক্তি-বক্তব্য, চিন্তা-গবেষণা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করাকে ‘ইখতিলাফ’ বা ‘মতভেদ’ বা ‘মতবিরোধ’ বলে।” যখন কোনো বিষয়ে বিরোধ বৃদ্ধি পেতে পেতে বিবাদ পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন সেটাকে ‘মুজাদালা’ বলা হয়। আর যে- ক্ষেত্রে বিরোধে জড়ানো পক্ষদ্বয় বা পক্ষগুলোর পরস্পর বিরোধের প্রশস্ততা অনেক বৃদ্ধি পায় এবং পর্যালোচনা ও সমালোচনার লড়াই এতো তীক্ষè পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, প্রকৃত সত্য ও সঠিক বিষয়টি প্রকাশ বা উদঘাটনের পরিবর্তে একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর কেবল বিজয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং বোঝা-বোঝানোর মানসিকতা চাপা পড়ে, সেক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিকে আরবীতে ‘শিক্বাক্ব’ বলে। ইসলাম ধর্মে দু’জন মুসলমান ভাইয়ের মধ্যে প্রয়োজনে বিরোধ/‘মতানৈক্যে’র অবকাশ স্বীকৃত; কিন্তু ‘মুজাদালা’ (পরস্পর বিবাদ-ঝগড়া) ও ‘শিক্বাক্ব’ (শত্রæতা পর্যায়ে উপনীত বিবাদ-বিরোধ)- কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিরোধ সৃষ্টিগত ব্যাপার: মানুষের মতের পার্থক্য একটি সৃষ্টিগত বিষয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্’র কুদরতের নিদর্শনগুলোর অন্যতম নিদর্শন এটিকে বলা হয়েছে। যেমন “তোমাদের ভাষা ও রঙের বৈচিত্র-ভিন্নতা” (আল কুরআনুল কারীম: ৩০:২২)।
যে রকমভাবে ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা মহান আল্লাহর ইচ্ছের ফলাফল সেরকমভাবে মানুষের ‘বিবেক-বুদ্ধি’ ও ‘অনুভ‚তি’র পার্থক্যও সৃষ্টিগত কর্মের ফলাফল। ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র যদি সৃষ্টির ¯্রষ্টার অসীম ক্ষমতার নিদর্শন হয়ে থাকে তাহলে মানবজাতির জ্ঞান-বুদ্ধির পার্থক্য/তারতম্যও তাঁরই অসীম ক্ষমতার পরিচায়ক। যেভাবে সকল মানুষের বর্ণ-আকৃতি যদি এক সমান হয়ে যেত তাহলে জীবন-মান বে-খাপ্পা হয়ে যেত তেমনি সকল মানুষের বুদ্ধি-বিবেক যদি এক সমান হয়ে যেত তাহলে জীবনের ভালো-মন্দ মূল্যায়নের কোনো মাপকাঠিই থাকত না। মানব জাতি সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে সমান হয়ে গেলে জীবনের সৌন্দর্য ও সজিবতার মূল্যায়ন হতো কিভাবে?
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
“আপনার প্রতিপালক ইচ্ছে করলে সমস্ত মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন; কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে, তবে তারা নয় যাদেরকে আপনার প্রতিপালক দয়া করেন এবং তিনি তাদেরকে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন। (আল কুরআনুল কারীম: ১১:১১৮-১১৯।)
উক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যায় তাফসীর গ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে-
নিন্দনীয় ও প্রশংসনীয় মতবিরোধ:
“আল্লাহ তা’লা যদি ইচ্ছে করেন, তবে সকল মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে পারেন। তাহলে সকলে মুসলমান হয়ে যেত, কোনো মতভেদ থাকতো না। মানুষের মন-মানসিকতা বিভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের মত ও পথ ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। পক্ষান্তরে ওলামায়ে-দীন ও মুজতাহিদ ইমামগণের মধ্যে যে-মতভেদ সাহাবাকিরামের যুগ থেকে চলে আসছে তা আদৌ নিন্দনীয় নয় এবং আল্লাহর রহমতের পরিপন্থি নয়। বরং সেটি একান্ত অবশ্যম্ভাবী, সাধারণ মুসলমানের জন্য কল্যাণকর এবং আল্লাহর রহমতস্বরূপ। অত্র আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে, যারা মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণের মতভেদকে বিভ্রান্তিকর ও ক্ষতিকারক বলতে চান তারা অত্র আয়াত ও সাহাবা-তাবেয়ীগণের বাস্তব কর্মপন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন।”(তাফসীর মা’আরেফুল কুরআন, সৌদী ছাপা-পৃ-৬৫০)
মোটকথা, যেহেতু মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও যোগ্যতা-অভিজ্ঞতার পার্থক্য বিদ্যমান তাই কোনো একটি ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট লোকজনের ঐকমত্য হতেও পারে, আবার ভিন্নও হতে পারে। এই মতের ভিন্নতা বা বিরোধ যদি সীমালঙ্ঘন পর্যায়ে না পৌঁছে এবং বিরোধ-মতভেদ সংক্রান্ত গবেষণার নীতি-মূলনীতি ও আদব-শিষ্টাচার আবশ্যিকভাবে মেনে চলা হয় তাহলে তা সর্ব্বৈ রহমত-কল্যাণের নামান্তর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ