Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

৯০ শতাংশ রোহিঙ্গাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

| প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : মিয়ানমারের সহিংসতাপূর্ণ রাজ্য রাখাইনে বসবাসরত তিনটি শহরের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত ৯০ শতাংশকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ২৫ আগস্টের পর ওই অঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্লিয়ারেন্স অভিযান জোরদার করলে ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখন রাখাইনের তিনটি শহরে অবস্থানরত রোহিঙ্গার সংখ্যা মাত্র ৭৯ হাজার ৩৮ জন। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতি সরকারি ও আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
উদ্বাস্তু হওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বের করার জন্য ইরাবতি রাখাইনের তিনটি শহরের সরকারি প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছে। এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে রাখাইনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্ট (জিএডি)। এটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। জিএডি’র প্রতিবেদন ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়। সংবাদমাধ্যমটি জিএডি’র প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরের জাতিসংঘের মানবিক সহযোগিতা বিষয়ক সংস্থা ওসিএএইচএ’র তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে পর্যালোচনা করেছে। ওসিএইচএ’র তথ্যমতে, ২৫ আগস্ট থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ লাখ ৮৮ হাজার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত করা হয়েছে।
জিএডি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর নিপীড়ন শুরু হওয়ার আগে মংডু, বুথিডং ও রাথিডংয়ে ৭ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাস করত। মংডুর একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইরাবতিকে নিশ্চিত করেছেন, এই পরিসংখ্যান ২০১৬ সালে সংগ্রহ করা। এ তথ্যের সঙ্গে ওসিএইচএ’র আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধনের তথ্য পর্যালোচনা করে ইরাবতি জানায়, ওই সব এলাকা থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গাকেই দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। মাত্র ১০ শতাংশ এখনও সেখানে রয়েছে। তবে এই ৯০ শতাংশের মধ্যে যারা মারা গেছেন, নিখোঁজ হয়েছেন বা গ্রেফতার হয়েছে তাদের ধরা হয়নি।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, আক্রান্ত এলাকাগুলো থেকে যে ১০ শতাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসেননি তাদের সংখ্যা ৭৯ হাজারের মতো। ফলে বাকি প্রায় ৭ লাখ ৬৭ হাজারকেই জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
জিএডি’র প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাথিডংয়ের ৬ শতাংশ, বুথিডংয়ের ৮৪ শতাংশ ও মংডুর ৯৩ শতাংশ জনসংখ্যাই ছিল রোহিঙ্গা। প্রতিবেদনে অবশ্য তাদের ‘রোহিঙ্গা’ বলে উল্লেখ করা হয়নি। মিয়ানমার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এড়িয়ে চলে। এমনকি দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির চাপে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কফি আনান কমিশনও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত ছিল। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘বাঙালি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জিএডি’র প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা বোঝাতে ‘বাংলাদেশি’ লেখা হয়েছে। তবে জিএডি’র কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশি’ দিয়ে রোহিঙ্গাদেরই বোঝানো হয়েছে।
জিএডি’র প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি প্রতিটি শহরে রোহিঙ্গা ও রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর কতটি গ্রাম রয়েছে। এতে শুধু মোট গ্রামের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। মংডু ও বুথিডংয়ের জিএডি কর্মকর্তাদের মতে, মংডুর ৩৬৪টি গ্রামের মধ্যে ২৭২টি রোহিঙ্গাদের, যা ওই এলাকার মোট গ্রামের ৭৪ শতাংশ। সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অভিযানে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা অন্তত ৭০টি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে।
বুথিডংয়ের ৩৩৯টি গ্রামের মধ্যে ১৩৭টিই রোহিঙ্গাদের, যা শহরটির মোট গ্রামের ৫১ শতাংশ। শহরটির এক উচ্চপদস্থ জিএডি কর্মকর্তা বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এখানকার অন্তত ৩০টি গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে।
রাথিডংয়ে রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা সংখ্যাগুরু। আগস্টের সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে সেখানে ২২টি রোহিঙ্গা গ্রাম ছিল। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জানা গেছে, সেখানে এখন মাত্র দুই তিনটি গ্রাম টিকে আছে। বাকিগুলোকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে।
৯০ শতাংশ রোহিঙ্গাকে তাদের আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদের পর এখন তাদের প্রত্যাবসনের প্রক্রিয়া চলমান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে। তবে প্রত্যাবাসন নিয়ে এই তোড়জোড়ের মধ্যেই বাংলাদেশে অবস্থানরত ডক্টর্স উইদাউথ বর্ডার্স-এর জরুরি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমন্বয়ক কেট নোলার জানিয়েছেন, এখনও প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশে শতাধিক রোহিঙ্গা আসছেন। তিনি বলেন, আগের মতো বিশাল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের ঢল না নামলেও এখনও প্রতি সপ্তাহেই এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চলেছেন। তারা রাখাইনে নিজেদের বাড়িতে নিরাপদ বোধ করেন না। সেখানে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি আর ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স নিজস্ব অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছে নারকীয় হত্যাকাÐ ও নির্যাতনের ভয়াবহ বাস্তবতা। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাখাইনের সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, তারা জঙ্গি সংগঠন আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) দমনে অভিযান চালিয়েছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ