Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতার ভয়ঙ্কর বিস্তার

| প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধ করতেও এরা কিছুমাত্র দ্বিধা করছেনা। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোর পাড়া-মহল্লায় এরা বিভিন্ন নামে সংঘ-সমিতি বা গ্যাং গড়ে তুলেছে। গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশই মাদকসেবী, অর্থললুপ ও ধর্ষকামী। এদের বেপরোয়াভাব, দৌরাত্ম্য ও অপরাধকর্মে পাড়া-মহল্লাবাসী যারপরনেই অতিষ্ঠ। উদ্বিগ্ন ও আতংকিত অবস্থায় তাদের সর্বক্ষণ থাকতে হচ্ছে। পুলিশের মতে, সম্প্রতিককালে কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বেড়েছে। শুধু শহরগুলোতেই নয়, গ্রামাঞ্চলেও এদের দ্বারা হরহামেশায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। গতকাল পত্রপত্রিকায় চট্টগ্রামের চার কিশোরের লোমহর্ষক অপরাধকর্মের খবর প্রকাশিত হয়েছে। তারা স্কুলছাত্র মেহেদী হাসান মিশকাতকে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে অপহরণ করে নার্সারির জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে গলায় রশি পেচিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে সে অচেতন হয়ে গেলে তারা মনে করে সে মরে গেছে। সেখানে তাকে ফেলে রেখে তারা তাদের অভিভাবকদের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করে ফোন করে। টাকা না দিলে ছেলের লাশ পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। পুলিশকে বিষয়টি জানানো হলে পুলিশ মুক্তিপণের টাকা দেয়ার ফাঁদ পাতে। সেই ফাঁদে পড়েই তারা শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে। ভাগ্যচক্রে মিশকাত তাদের আস্তানা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবিকারী চার কিশোর মহানগরীর বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্র। তাদের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে কিশোর অপরাধীদের অপতৎপরতা এটাই প্রথম নয়। বলা যায়, এ ঘটনা পূর্বের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহেরই অংশ। অভিযোগ রয়েছে, মহানগরীতে গড়ে ওঠা গ্যাংগুলো খুন-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি ষোল শহর ২নং গেইটে পুলিশ চেকপোস্টে গুলি করার ঘটনায় ছয় কিশোর ধরা পড়ে। জামালখান কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ধরা পড়ে পাঁচ কিশোর।
ঢাকা মহানগরী তো অনেক আগেই কিশোর অপরাধীদের নির্ভয় বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত এদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা, সন্ত্রাস, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের অসংখ্য তথ্য-বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার ও নানা এলাকায় বহু কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। এরা বেপরোয়া ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন। এদের হাতে একের পর হত্যা এবং অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হলেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধের ঘটনা দু-ই বাড়ছে। সম্প্রতি নগরীর ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে এক কিশোর ও যাত্রাবাড়িতে অপর এক কিশোর নিহত হয়েছে কিশোরদের হাতে। প্রথম ঘটনায় হোলি উৎসব দেখতে আসা এইচএসসি পরীক্ষার্থী কিশোর ২০-২৫ জনের একটি চক্রের বেদম প্রহার ও ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনায় সাত কিশোর সহপাঠি একসঙ্গে কাজলায় বেড়াতে গেলে ১০-১২ জনের অপর একটি কিশোরচক্র তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় এক কিশোর ছুরিকাঘাতে নিহত ও অপর একজন আহত হয়। হামলাকারী কিশোররা স্থানীয়দের ভাষায় বখাটে ও সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত। এরা এলাকায় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। কেবল চট্টগ্রাম বা ঢাকা মহনগরীতে নয়। দেশের অন্যান্য শহর, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। তারা অবলীলায় খুনসহ নানা অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে। বখাটে কিশোরদের খুন, সন্ত্রাস, ইভটিজিং রীতিমত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের ভয়ে কিশোরী শিক্ষার্থীরা সন্ত্রস্ত। অনেকেই অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। অনেকে লেখাপড়া পর্যন্ত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও ক্ষেত্র বিশেষে জান ও সম্ভ্রম বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সিলেটের প্রত্যন্ত বালাগঞ্জ উপজেলায় এক স্কুল ছাত্রী দুই কিশোরের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষকদের একজনের বয়স ১৯, অপরজনের ১৭। এলাকার লোকজন জানিয়েছে, ওই এলাকায় বখাটে-নেশাখোরদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যখন তখন তাদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে কিশোরী শিক্ষার্থীরা।
সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, আমরা আসলে কোন দেশে বাস করছি? এমনিতেই বিভিন্ন দুর্বৃত্তচক্রের কবলে পড়েছে দেশ। কোথাও নিয়ম-শৃংখলা নেই, নিরাপত্তা নেই, আইনের শাসন নেই, বিচারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই। দেশে সরকার আছে, আইনশৃংখলা বাহিনী আছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিচারালয় আছে। অথচ মানুষ তাদের জান, মাল ও সম্ভ্রম নিয়ে সর্বদা শংকা ও আতংকের মধ্যে দিনযাপন করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, দেশের ভবিষ্যত কিশোররা শেষ হয়ে যাচ্ছে। দৃর্বৃত্তাচারের সয়লাবে এরা ভেসে যাচ্ছে। এদের মধ্যেই মাদকাসক্তের সংখ্যা বেশী। অর্থাসক্তিও এদের মধ্যে প্রবল। এরা নীতি-নৈতিকতার কোনোরূপ ধার ধারছে না। এরা দুর্বৃত্তাচারী ও পাকা অপরাধী হয়ে উঠছে। এই যে অধ:পতন, তা থেকে এদের বের করে না আনতে পারলে জাতির ভবিষ্যত বলে কিছু থাকবে না। কেন কিশোররা এমন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে, সেটা আগে গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পরিবারে ও সমাজে নীতি-নৈতিককতার শোচনীয় অবক্ষয় ঘটেছে। কিশোরদের অধ:পতন তারই জের। শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি- নৈতিকতা শিক্ষার সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে এরা একটা বেদিশা অবস্থায় পতিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শাসন ও বিচারহীনতা। বলতে গেলে’ কিশোরদের কোনো রক্ষাকবচই আর নেই। এই বিষয়গুলো রাষ্ট্রপরিচালক ও সমাজ গবেষকদের খেয়ালে নিতে হবে। কীভাবে কিশোরদের সুপথে আনা যায়, তার বিধিব্যবস্থা ও পরিকল্পনা নিতে হবে। আইনশৃংখলাবাহিনীর একার পক্ষে কিশোর অপরাধ দমন সম্ভব নয়। এ জন্য প্রতিটি পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোররা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে কোন্ সংঘে মিশছে, এসব পরিবার ও সমাজকে নজরে রাখতে হবে। কিশোরমন অনুসন্ধিৎসু, এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় এবং উন্মুক্ত। ভালোমন্দ সবদিকেই তারা যেতে পারে। তাদের ভালোর দিকে, সৃজনশীলতার দিকে, কল্যাণের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিস্তার


আরও
আরও পড়ুন