Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বরিশালে নদ-নদীর নাব্য সঙ্কট নৌ নির্মাণ কারখানা অনিশ্চতায়

| প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে ব্যাংকসহ নৌযান মালিকদের
নাছিম উল আলম : এককালের ভয়াল মেঘনা, তেতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ, বিষখালী, পায়রা, বলেশ্বর ও কঁচা নদ-নদী ছাড়াও ‘বাংলার সুয়েজ খাল’ খ্যাত গাবখান চ্যানেলে নাব্যতা সংকটে ব্যয় সাশ্রয়ী নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা সহ নৌ নির্মান শিল্পে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্রমশ ঝ্্ুঁকির মুখে পড়ছে। বরিশালের উদীয়মান নৌ নির্মান কারখানাগুলো ইতোমধ্যে লাগসই প্রযুক্তিতে যথেষ্ঠ উৎর্ষতা অর্জন করলেও তার ভবিষ্যত পরিচ্ছন্ন নয়। হাজার-হাজার নৌ নির্মান শ্রমিক ও নৌযান কর্মীর ভবিষ্যতও অনিশ্চয়তার কবলে। বরিশালের নৌ নির্মান কারখানাগুলোতে দেশের সর্ববৃহত বিলাসবহুল যাত্রীবাহী নৌযান ছাড়াও উপক’লীয় নৌপথের বিভিন্ন ধরনের পণ্যবাহী ও গভীর সমুদ্র থেকে লাইটারেজ নৌযানও তৈরী হয়েছে। এখনো বেশ কিছু নৌযানের নির্মানকাজ চলমান। সদ্য নির্মিত বৃহত বিলাসবহুল যাত্রীবাহী নৌযান ‘এমভি কির্তনখোলাÑ১০’ এর পরিক্ষামূলক পরিচালন ইতোমধ্যে সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। খুব শিঘ্রই নৌযানটি বরিশালÑঢাকা নৌপথে যাত্রী পরিবহন শুরু করবে।
এখন পর্যন্ত নৌ নির্মান শিল্পে সরকারীÑবেসরকারী বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আগ্রহও খুব একটা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে না হলেও কয়েকটি ব্যাংকের প্রায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংক এখাতে সীমিত কিছু বিনিয়োগ করলেও তা নিয়েও চাপা উদ্বেগ রয়েছে। যদিও বছর তিনেক আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্ণর ড. আতিউর রহমান বরিশালের বেসরকারী নৌ নির্মান কারখানাগুলো পরিদর্শন করে যথেষ্ঠ উচ্ছসিত হয়েছিলেন। তিনি এখাতে বিনিয়োগে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অনানুষ্ঠানিক অনুরোধ করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এলক্ষ্যে কোন নীতিমালা প্রনয়ন বা দিক নির্দেশনাও প্রদান করা হয়নি। ফলে কোন ব্যাংকই এখাতে যথাযথ বিনিয়োগে খুব একটা আগ্রহী হয়নি।
কিন্তু সীমান্তের ওপারে দেশের সবগুলো প্রধান নদ-নদীর প্রবাহের প্রধান উৎসে অমানবিক নিয়ন্ত্রনের ফলে আমাদের নৌপথের দূর্গতি ক্রমশ বাড়ছে। সাথে উদ্বেগ উৎকন্ঠাও বাড়ছে নৌযান ব্যবসায়ী সহ নৌ নির্মান শিল্পেও। বরিশালের নৌ কারখানাগুলোতে ইতোমধ্যে দেশের সর্ববৃহত মাপের ও বিলাসবহুল যাত্রীবাহী নৌযান নির্মিত হয়েছে। যা অত্যন্ত সুনাম ও নির্ভরতার সাথেই রাজধানীর সাথে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী বন্দরের নৌযোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এছাড়াও একাধিক পণ্য ও জ্বালানীবাহী নৌযান ছাড়াও সমুদ্র বন্দরে পণ্য খালাশের জন্য লাইটারেজ জাহাজও নির্মিত হয়েছে বরিশালে।
বেসরকারী উদ্যোগে সম্পূর্ণ লাগসই প্রযুক্তিতে গড়ে ওঠা বরিশালের এসব নৌ নির্মান কারখানাগুলো ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের আর্থÑসামাজিক ব্যবস্থায়ও যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এসব কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহ¯্রাধীক দক্ষ, আধাদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক সহ বিপুল সংখ্যক নৌ-নির্মান কর্মীর জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনাময় এ খাতে সরকারী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ মোটেই আশাব্যঞ্জক না থাকার মধ্যেই নৌপথের নাব্যতা সংকট পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলছে। বেসরকারী ঢাকা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক সিমিত কয়েকটি নৌযান নির্মানে বিনিয়োগ করেছে। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় জনতা ব্যাংকও কয়েকটি নৌযান নির্মানে প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করলেও পরবর্তিতে সেসব ঋন গ্রহীতা অন্য বেসরকারী ব্যাংকে চলে যায়। তবে সদ্য নির্মিত ‘এমভি কীর্তনখোলাÑ১০’ নৌযানটিতে রাষ্ট্রীয় জনতা ব্যাংকের ঢাকার একটি শাখা সীমিত কিছু ঋন প্রদান করেছে।
কিন্তু এসব বিনিয়োগ নিয়েও ব্যাংকগুলোর কিছুটা দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে নৌ পথের নাব্যতা সংকটে। নদ-নদীর নাব্যতা সংকটে বরিশালÑচাঁদপুরÑঢাকা, বরিশালÑইলিশাÑচট্টগ্রাম,বরিশালÑঝালকাঠীÑগাবখানÑমোংলাÑখুলনা, বরিশালÑপায়রা, বরিশাল-পটুয়াখালী, বরিশালÑঝালকাঠীÑবরগুনা এবং বরিশালÑভোলা নৌপথগুলো ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এমনকি প্রায় ১৫কিলোমিটার দৈর্ঘের ‘গাবখান চ্যানেল’টি ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে প্রায় ১৫কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেজিং করে নাব্যতা উন্নয়ন সহ এর প্রসস্ততা বৃদ্ধি করে ডবল ট্রাফিকিং ব্যবস্থায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু প্রবাহ সংকটে তিন বছরের মাথায়ই চ্যানেলটির নাব্যতা ভয়াবহ ঝুকির কবলে পড়ে। এতেকরে পুনরায় চ্যানেলটিকে সিঙ্গেল ট্রাফিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। ফলে বরিশালÑমোংলাÑখুলনা নৌপথের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গাবখান চ্যানেলটির এক প্রান্ত থেকে কোন নৌযান প্রবেশ করলে বিপরীত প্রান্ত থেকে প্রবেশ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে সারা দেশের সাথে মোংলা সমুদ্র বন্দর ছাড়াও খুলনা ও নওয়াপাড়া নদী বন্দরের নৌযোগাযোগ এখন যথেষ্ঠ ঝুকির মুখে। ঐ নৌ পথের ‘মোংলাÑঘাশিয়াখালী চ্যানেল’টিও নাব্যতা সংকটে ২০১১সালে বন্ধ হয়ে যাবার প্রায় ৫ বছর পরে ২০১৬-এর শেষ দিকে চালু করা সম্ভব হয়েছে। তবে এজন্য প্রায় ২শ কোটি টাকা ব্যয়ে চ্যানেলটির ড্রেজিং করতে হয়েছে। দেড় বছর পর চ্যানেলটি পুনরায় চালু করা হলেও এখনো তার সংরক্ষন ও উন্নয়ন ড্রেজিং অব্যাহত রয়েছে। মোংলা সহ খুলনা ও নওয়াপাড়া নদী বন্দরের পন্য পরিবহনের অন্তত ৫০ভাগই এখনো নৌপথের ওপরই নির্ভরশীল।
নৌযান মালিকদের মতে, ‘যদি নদীই না থাকে তবে নৌযান বানিয়ে করব কি’? তাদের মতে আগের চেয়ে ড্রেজিং সহ নৌপথ খনন কাজে অনেক অগ্রগতি হলেও শুধু নদী খনন করেই নৌপথ সচল রাখা যাবেনা। যদি উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করা হয় তবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই নদী নাব্যতা হারাতে বাধ্য।
আর এসব কারনেই বরিশালের নৌ নির্মান শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন নৌযান মালিক সহ নতুন উদ্যোক্তাগনও। একই কারনে এখাতে বিনিয়োগে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোও যথেষ্ঠ রক্ষনশীল ও নেতিবাচক মনোভাব পোষন করতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। ফলে এ শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি এর সাথে জড়িত লক্ষাধিক মানুষের জীবনÑজীবিকা নিয়েও উৎকন্ঠা বাড়ছে।
এ ব্যাপারে বরিশাল চেম্বারের সভাপতি এবং সুন্দরবন নেভিগেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদুর রহমান রিন্টু জানান, শিল্প ক্ষেত্রে অনগ্রসর দক্ষিণাঞ্চলে জাহাজ নির্মান শিল্প দেশের যেকোন এলাকার একই ধরনের শিল্পের সাথে গুনগত মানে সমকক্ষ। কিন্তু দেশের নদ-নদীর নাব্যতা সংকট নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার মত নৌ নির্মান শিল্পের ভবিষ্যত নিয়েও উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে। তিনি দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের নাব্যতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষনে সরকারের সা¤প্রতিক পদক্ষেপের প্রশংসা করে এখাতে আরো গুরুত্ব প্রদানেরও আহবান জানান।
এ ব্যপারে সালমা শিপিং লাইন্স-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল আহসান ফেরদৌস জানান, আমরা চরম ঝুঁকি নিয়ে নৌ নির্মান শিল্পে বিনিয়োগ করেছি। তার মতে, নৌযান ব্যবসার সাথে শুধু আমাদের ও ব্যাংকের টাকাই নয়, এর সাথে হাজার-হাজার নৌযান শ্রমিক-কর্মচারীর রুটি রুজি সহ দক্ষিণাঞ্চলের আর্থÑসামাজিক ব্যবস্থাও জড়িত বলে দাবী করে তিনি বিজ্ঞান ভিত্তিক ও টেকসই ব্যবস্থায় নৌপথ উন্নয়ন ও সংরক্ষনেরও দাবী জানান।



 

Show all comments
  • Md. Emdadul Haque Badsha ১৮ মার্চ, ২০১৮, ৫:১১ এএম says : 0
    ধন্যবাদ ভ্যাই নাসিমুল আলম। আপনার ই-মেইল ফোন নম্বর দরকার--আরও তথ্যবহুল প্রতিবেদনের জন্য----
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বরিশাল

২৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ