Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পানি নিরাপত্তায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ নিরাপদ পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পানি নিরাপত্তা সূচকের বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় তা জানে না পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পানি নিরাপত্তা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা সূচক তাই তিনটি সাব সূচকের উপর নির্ভর করে। এগুলো হলো- খাদ্য উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা, শিল্পপণ্য উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা এবং শক্তি উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা। এই তিনটির মধ্যে একটিতেও নেই বাংলাদেশের নাম। অথচ খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও পানি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
২০২০ সালের মধ্যে সকলের জন্য সরাসরি নিরাপদ খাবার পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পানিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্যানেলের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। আগামী ২২ মার্চ জাতিসংঘ হাই-লেবেল প্যানেল অন ওয়াটার (এইচএলপিডবিøউ) এর ফলাফল ডকুমেন্টের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকার পক্ষ থেকে পানি সরবরাহের একটি সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিন আগামী ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন।
পানি জীবনের একটি মৌলিক উপাদন। জীবন এবং জীবিকার জন্য পানির সঠিক ব্যবহার ও টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বরোপ করে ১৯৯৩ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতি বছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ প্রণীত ২০১৬-২০৩০ মেয়াদী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে জাতিসংঘ প্রণীত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পানিকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি না দিয়ে পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান করে ২০১৩ পানি আইন পাস করা হয়েছে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সার্বিক পানি উন্নয়ন সূচকের অবস্থানের মধ্যে মোট ৪৯ টি দেশ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনোটিই সর্বোচ্চ পানি নিরাপত্তা সূচক (৫) অর্জন করতে পারেনি। মাত্র দু’টি দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মান (৪) অর্জন করতে পেরেছে। মাঝারি অবস্থানে (৩) রয়েছে ১০টি দেশ। এগুলো হলো, আর্মেনিয়া, ব্রæনাই, দারুসসালাম, হংকং, জাপান, কাজাকাস্তান, মালয়েশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইপে ও তাজিকিস্তান। নিরাপত্তা সূচক ২ অর্জন করেছে সর্বোচ্চ ২৯ টি দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ মোট ১০ টি দেশ ন্যূনতম ১ নিরাপত্তা সূচক অর্জন করেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বের ৭৮৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ নিরাপদ বা পানযোগ্য পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। ২৫ লাখ মানুষ এখনো ন্যূনতম স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সুবিধা বঞ্চিত। ২০৪০ সাল নাগাদ প্রায় ৬০ কোটি শিশুর বসবাসের এলাকায় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিবে। এতে করে জীবনধারণ ও সুস্থতা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে। পৃথিবীতে মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক জনশক্তিই পানি সংক্রান্ত এবং পানিকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সারা বিশ্বে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত সে সংখ্যা প্রায় দেড় বিলিয়ন। পৃথিবীপৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগই পানি। শতকরা হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ। এত পানি থাকার পরও চারদিকে শুধু পানির অভাব। আর সেই অভাবটি হলো বিশুদ্ধ পানির। কারণ ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ পানির মধ্যে ৯৭ শতাংশ পানিই লবণাক্ত পানি, ২ শতাংশ বরফ এবং বাকি মাত্র ১ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি। পানির রাসায়নিক গুণাবলির মধ্যে রয়েছে, এর কোনো অ¤øত্ব কিংবা ক্ষারকত্ব নেই। অর্থাৎ পানির পিএইচ মান হলো সাত (৭)। মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে পানি রয়েছে। পানি আইনের প্রথমেই বলা হয়েছে, পানিসম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিধান প্রণয়ন করা। যা এখনো করা হয়নি।
জানা গেছে, গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পানিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্যানেলের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের পক্ষে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হল তা সরকার ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের এসডিজি বাস্তবায়ন এবং সকলের জন্য ‘পানি-নিরাপদ’ পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে পানিসংক্রান্ত অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণে পথ দেখাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে বাংলাদেশ সকলের জন্য নিরাপদ খাবার পানি ও নিরাপদ পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ১৬০ মিলিয়নেরও অধিক মানুষের বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি মানুষের জন্যই নিরাপদ খাবার পানির সংস্থান করা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে সকলের জন্য সরাসরি নিরাপদ খাবার পানির সংস্থান নিশ্চিত হবে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান ইনকিলাবকে বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য পানির গুরুত্বপূর্ণ পানি। আমরা পানির নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছি। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সকলের জন্য সরাসরি নিরাপদ খাবার পানির সংস্থান নিশ্চিত করবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও পানি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। তিনি বলেন, পানি বিদ্যুতে হাই লেভেল প্যানেলের ফলাফল ডকুমেন্টের সুপারিশের ভিত্তিতে, একটি সমন্বিত (জাতীয়) পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে- যা পানির জন্য তৈরি করা হবে। সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী। পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত বলেন, নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারা দেশ জুড়ে খালখনন এবং পুনরায় খনন করতে হবে।
জানা গেছে, ২০১৬ থেকে মার্চ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদি প্রতিষ্ঠিত, এইচএলপিউএ›র দুই সহ-সভাপতি মরিশাস অ্যামিনহর প্রেসিডেন্ট গিরিব-ফকিম এবং মেক্সিকো এনরিক পেন ন্যাটোর প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যানেলের সদস্য ছিলেন, অন্য প্যানেল সদস্য হলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল, হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট জনস অ্যাডার, জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী হানি আল মুলকি, নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রোকস রকেট, পেরুর প্রেসিডেন্ট পাবলো কুইজিনস্কি গর্ডার্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা,সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সল, তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমমালি রাহমোন এবং কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডাঃ হান সেং- সো। জাতিসংঘের পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন (ইউএনসিইডি)-এর ১৯৯২ সালের মিটিংয়ে বিশ্ব পরিবেশে পানির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৩ সাল থেকে সর্বপ্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালন করে আসছে।
পানিসঙ্কটের মানচিত্রে ভবিষ্যতের ৬০ কোটি শিশু
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দুই দশকে সুপেয় পানি সঙ্কট এতোটাই প্রকট হয়ে উঠবে। ২০৪০ সাল নাগাদ প্রতি চারজন শিশুর একজনকে সঙ্কট পড়তে হবে। বিশ্বের ৩৬টি দেশে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব দেশে পানির চাহিদার তুলনায় সরবরাহের পরিমাণ খুবই কম। উষ্ণ আবহাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা এবং বরফ গলে যওয়ার মত ঘটনায় সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, মান ও পয়ঃনিস্কাশনে প্রভাব। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পানির নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার এবং শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রæত নেমে যাওয়ার কারণ বলে মনে করে বিশেষজ্ঞরা। ইউনিসেফ প্রতিবেদনে বলা হয়, সুপেয় পানির উৎস এখনো বিশ্বের ৬৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষের নাগালের বাইরে। খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করে এখনো প্রায় ৯৪ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। সুপেয় পানি সংগ্রহে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ২০ কোটি ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশুদের। পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকার গুলোর কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি করেছে তারা।



 

Show all comments
  • রোমান ১৯ মার্চ, ২০১৮, ৫:১৭ এএম says : 0
    অনেক সুন্দর একটি নিউজ। রিপোর্টারকে ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পানি

২৫ অক্টোবর, ২০২২
২১ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ