Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মূল্যবোধের অবক্ষয়ই ধ্বংসের কারণ

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পবিত্র কোরআনে বহু প্রাচীন জাতির ধ্বংস কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর নাফরমানি বা অবাধ্যতার কারণে ঐ জাতিগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। এসব জাতির প্রতি আল্লাহ তা’লা যুগে যুগে বহু নবী রসুল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁরা যথার্থভাবে ওয়াজে তবলীগের মাধ্যমে তথা তওহীদের প্রচার-প্রসারে সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু বিভ্রান্ত, গোমরাহ জাতিগুলো নবী রসুলগণের দাওয়াতের প্রতি কর্ণপাত করেনি, বরং তাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে এবং আল্লাহ দ্রোহিতায় লিপ্ত থেকেছে। পরিণতিতে তাদের ওপর আল্লাহর কঠোর আজাব-শাস্তি নেমে এসেছে, যার বিস্তারিত বিবরণ আল-কোরআনের নানা স্থানে বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ সে প্রাচীন জাতিগুলোর ধ্বংস কাহিনী পরবর্তী মানব জাতিগুলোর শিক্ষা গ্রহণের জন্য এবং সৎ পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য বর্ণনা করেছেন। খোদায়ী আজাব-শাস্তি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়নি, নানা রূপে-আকারে সর্বদাই চলছে। কিন্তু আল্লাহদ্রোহীরা শয়তানের প্ররোচনায় তা বুঝতে পারে না। মানব ইতিহাসের এমন কোন যুগ অতিবাহিত হয়নি যাতে আল্লাহর আজাব-অভিশাপ অবতীর্ণ হয়নি এবং নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বালা-মুসিবতের কবলে পতিত হয়ে বিভিন্ন জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। তুফান, সামুদ্রিক প্লাবন, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতি আপদ-বিপদ সকল জাতির ওপর এবং সকল যুগেই এসেছিল। আল্লাহর এ পরীক্ষা হতে কোন জাতি নিস্তার লাভ করেনি। ফলে অনেক জাতিকেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে হয়েছে। পবিত্র কোরআনে স্বয়ং আল্লাহ তা’লা বিভিন্ন জাতির ধ্বংস বিবরণ উল্লেখ করেছেন। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানী ও জগতের বুকে অন্যায়-অবিচার এবং জুলুম-নির্যাতনের রাজত্ব কায়েম করা। প্রাচীন জাতিসমূহের ইতিহাস পাঠ করলে তাই জানা যায়। জাতীয় অধঃপতনের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেছেন, (হে লোক সকল) তোমদের ওপর বালা-মুসিবত যা কিছু নাজেল হয়ে থাক তা তোমাদেরই কর্মফলের দরূন। আল্লাহ তোমাদের অনেকের পাপ মার্জনা করে থাকেন (সূরা-শুরা)। বস্তুত নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় (সূরা-রাদ)।
সুতরাং প্রমাণিত হল যে, মানবতার উন্নতি, অগ্রগতি এবং অধঃপতন ও সর্বনাশের মূলেও রয়েছে মানুষের কৃতকর্ম বা আমল। মানুষ সৎপথে থাকতে চাইলে আল্লাহ তাকে সেজন্য সাহায্য করেন এবং বিপথে পরিচালিত হতে চাইলে তাও তার এখতিয়ারভুক্ত।
হযরত রাসুলে করীম (সা.) কেয়ামতের যে সকল পূর্ব লক্ষণের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেগুলির প্রতি লক্ষ করলে মুসলমান সমাজের বর্তমান অবস্থা সম্যকরূপে উপলব্ধি করা যেতে পারে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, হুজুর (সা.) বলেছেন, যখন লোকে গনিমতের (যুদ্ধলব্ধ) মালকে আল্লাহর দয়ার দানস্বরূপ নিজস্ব মাল বলে গণ্য করবে, গচ্ছিত মালের খেয়ানত করতে থাকবে, জাকাত আদায় করাকে কর্জ পরিশোধ বলে মনে করবে, দ্বীনের শিক্ষাকে বৈষয়িক উপকারের জন্য শিখবে, পুরুষগণ নিজেদের স্ত্রীগণের আদেশ মেনে চলবে, লোকে মায়ের আদেশ অমান্য করে চলবে। বন্ধু-বান্ধবদের নৈকট্য লাভ ও তাদের সম্মান বেশি করতে থাকবে ও পিতাকে দূর সম্পর্কীয় ব্যক্তি বলে মনে করবে, মসজিদসমূহে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও আত্মকলহ হতে থাকবে। ফাসেক বা পাপাসক্ত এবং হীন ও নীচ ব্যক্তিগণ জাত ও সম্পদে নেতৃত্ব করবে। কোন মানুষের সম্মান কেবল তার ভয়ে এবং তার অন্যায়-অবিচার হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য করা হবে, গায়িকাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বাদ্যযন্ত্রের প্রাচুর্য দেখা যাবে, মদ্য পান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে, পরবর্তী লোকেরা তাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি অভিশাপ দিতে থাকবে (অর্থাৎ তাদেরকে বোকা মনে করবে)। তখন তুমি অগ্নিবর্ণ ঝড়-তুফানের, প্রচন্ড ভূমিকম্পে জমিন বিধ্বস্তের, আসমান হতে পাথর বর্ষণের, সুরত পরিবর্তনের (বিকৃতির) এবং হাড় ভাঙানোর ন্যায় বহু অনল প্রবাহ লক্ষণের অপেক্ষা করো (তিরমিজি)।
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, একদা হযরত নবী করীম (সা.) কিছু বর্ণনা করছিলেন- এমন সময় একজন মূর্খ লোক এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লহর রসুল! কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে? হুজুর বললেন, যখন লোক গচ্ছিত ধন আত্মসাৎ করবে। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, গচ্ছিত ধন আত্মসাৎ করার অর্থ কী? হুজুর বললেন, যখন অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে শাসন কার্য দেওয়া হবে তখন তুমি কেয়ামতের প্রতীক্ষা করতে পারো। অন্যত্র হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, ঐ সময় খুব দূরে নয়, যখন প্রকৃত ধর্ম শিক্ষা উঠিয়ে নেয়া হবে। সেই সময় ফেতনা-হাঙ্গামা, অনিষ্ট ও বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি প্রকাশ পাবে এবং রক্তপাত ও খুন-খারাবী অধিক হবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, যে জাতি খেয়ানতে লিপ্ত হয়ে পড়ে আল্লাহ তাদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করে দেন, যে জাতি ব্যভিচার (জেনা) আরম্ভ করে তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে জাতি ওজন ও মাপে কম দেয় তাদের রেজেক, উপার্জন হ্রাস করে দেওয়া হয়। যে জাতি সত্যের বিরুদ্ধে রায় দান করে তাদের মধ্যে হত্যাকান্ড, রক্তপাত বেড়ে যায় এবং যে জাতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তাদেরকে শত্রæর অধীনস্থ করা হয় (মোয়াত্তা মালেক)।
হযরত উসমান (রা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে এমন এক সময় আসবে যখন ইমাম বা শাসকগণ তোমাদের রক্ষক হওয়ার পরিবর্তে কেবল তহ্সীলদার (কর আদায়কারী) হিসাবে গণ্য হবে। তখন হায়া-শরম (লাজ-লজ্জা), আমানত এবং ওয়াদাকারী বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের কুকর্ম ও পাপ কার্যের ফলে নানা প্রকার আসমানী বালা-মুসিবত অবতীর্ণ হয়ে থাকে এবং কেয়ামতের পূর্বে সেগুলি অধিক পরিমাণে দেখা দেবে বলে নবী করীম (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। লোক যখন প্রকৃত মোমেন মুসলমান, পরহেজগার, আল্লাহর ফরমাবরদার, এবাদত-বন্দেগিরত, খোদাভীরু, সত্যবাদী, ধৈর্যশীল, দাতা, রোজাদার, কুসংস্কারমুক্ত এবং যাবতীয় ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করে চলবে তখন আল্লাহর রহমত-মহিমা বর্ষিত হতে থাকবে এবং জগতে শান্তি বিরাজ করবে। আর তাদের মধ্যে উল্লেখিত গুণাবলির অবর্তমানে যদি তারা কাফের, মোশারেক, ফাসেক, ফাজের, পাপী, ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী, ব্যভিচারী, মদ্যপায়ী, চোর, ডাকু, অত্যাচারী, অহংকারী, অভিশপ্ত, অজ্ঞ, ধোঁকাবাজ, বিদ্রোহী, মিথ্যাবাদী এবং হত্যাকারী প্রভৃতি রূপে জীবনযাপন করে তবে আল্লাহর করুণা ও মহিমার সকল দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় এবং জগতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি এবং জান-মালের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘জাহারাল ফাসাদু ফিল বাররে ওয়াল বাহরে বিমা কাছাবাত আইদিন নাস’। অর্থাৎ জলে-স্থলে ফ্যাসাদ ভরপুর হয়ে গেছে লোকের কৃতকর্মের ফলে। জাতীয় অধঃপতনে এর চেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত আর কী হতে পারে?
মানবের জাতীয় অধঃপতনের মূল কারণ কোরআনের এ আয়াতে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষ তা ভাবে না বুঝে না। বিশেষত মুসলমানদেরকে চারিত্রিক ও নৈতিক গুণাবলীর দিক হতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করা হলেও তাদের আচার-আচরণ যেখানে অনুকরণীয়-অনুসরণীয় হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তাদের অনেকের মধ্যে তা অনুপস্থিত। ফলে মুসলিম জাতীয় চরিত্র এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। এ অধঃপতনের লক্ষণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরাজমান। এখান থেকে উদ্ধার পেতে হলে বিশ্ব মানবের মুক্তির মহাসনদ আল-কোরআনের দিকে ফিরে আসতে হবে। সকল ভেদাভেদ, কোন্দল, পরস্পর হানাহানি, খুনাখুনি প্রভৃতি দুষ্কর্ম পরিহার করে মুসলিম ঐক্যকে সুদৃঢ় করে কোরআনের অনুসরণ ব্যতীত গত্যন্তর নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মূল্যবোধ


আরও
আরও পড়ুন