Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রূপগঞ্জে দখল ও দূষণে জর্জরিত শীতলক্ষ্যা

ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে ডকইয়ার্ড

| প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মো : খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝে জাহাজ ও ড্রেজার রাখার কারণে রাস্তা ঘাটের মতো পানিপথেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। নদীর মাঝে জাহাজ রাখার কারণে ঘটছে নিত্য নৈমিত্তিক দুর্ঘটনা। বিভিন্ন কোম্পানীর জাহাজগুলো নদীর মাঝে রাখার ফলে নদীর বেশিরভাগ অংশই দখল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া শীতলক্ষ্যা নদের তীর দখল করে প্রায় ৩০-৩৫টি ডকইয়ার্ড কারখানা গড়ে উঠেছে। সূত্র জানায়, এর মধ্যে কয়েকটির অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কোন অনুমোদন নেই বলে জানা গেছে। নদ দখলের পাশাপাশি দূষণেরও অভিযোগ রয়েছে বিআইডবিøউটি এর সনদ নবায়ন ও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই ব্যবসা করা এসব ডকইয়ার্ডের বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিআইডবিøউটি এর কিছু কর্মকর্তা অনুমোদনহীন ডকইয়ার্ড মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের মাসোয়ারা নিয়ে থাকে। এর কারণে শীতলক্ষ্যা নদে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও অনুমোদনহীন ডকইয়ার্ড গুলো উচ্ছেদ করা হয়নি। বেশকিছুদিন আগে, বিআইডবিøউটি এর কর্মকর্তারা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। ২ দিনের উচ্ছেদ অভিযানে তারা নামে মাত্র কয়েকটি ডকইয়ার্ড উচ্ছেদ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। যে সকল ডকইয়ার্ডগুলো বিআইডবিøউটি এর কর্মকর্তাদের মাসোয়ারা দেন তাদের ডকইয়ার্ড উচ্ছেদ করা হয়নি। যারা তাদেরকে মোটা অংকের মাসোয়ারা দেয় না তাদের ডকইয়ার্ড উচ্ছেদ ও জরিমানা করা হচ্ছে। উচ্ছেদ শত বছরের পুরনো মসজিদ ভেঙ্গে ফেলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব কথা বলেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শীতলক্ষ্যার পূর্বগ্রাম থেকে মুড়াপাড়া পর্যন্ত শামস ডকইয়ার্ড, তানহা ডকইয়ার্ড, আবুল কাশেম ডকইয়ার্ড, আলআমীন ডকইয়ার্ড, শাহজাহান ডকইয়ার্ড, জাকের ডকইয়ার্ড, মালেক ডকইয়ার্ড, মিজান ডকইয়ার্ড, কেএসবি ডকইয়ার্ড, রয়েল ডকইয়ার্ড, ফটিক ডকইয়ার্ড, মনির ডকইয়ার্ড ও আমির ডকইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। নদী দখল হয়ে যাওয়ায় নদী দিয়ে অন্যান্য জাহাজ, নৌকা, স্টিমার, ভলগেট, চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় ঘটছে বিভিন্ন ধরনের মারাত্বক দুর্ঘটনা। চলতি বছরের ২৩ মার্চ রাতে রূপসী কাজীপাড়া এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে বাল্ক হেডের ধাক্কায় নৌকাডুবিতে ৫ জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনার বেশকিছুদিন পরই বিআইডবিøউটিএ কর্মকর্তারা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছিল। এসময় তারা বেশকিছু অবৈধ স্থাপনা, ডকইয়ার্ড ও কয়েকটি পাকা ভবন ভেঙ্গে ফেলা হয়। এ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার কয়েকদিন পরই দখলবাজরা আবার দখল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যায়। সূত্র জানায়, সিটি গ্রæপসহ অন্যান্য কোম্পানীগুলো মালামাল উঠানো নামানোর জন্য নদীর কিনারে জেটি বানিয়ে নদীর ভাগ দখল করে রেখেছে। রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪০-৫০ টি স্থানে ড্রেজিং প্রকল্প গড়ে উঠেছে। সরকার দলীয় কয়েকটি প্রভাবশালী সংগঠন নদীতে এ ড্রেজার ব্যবসা গড়ে তুলেছে। ড্রেজার মালিকদের নদীর কিনারা থেকে বালু তুলার নিয়ম থাকলেও ড্রেজার মালিকরা নদীর মাঝ থেকে বালু তুলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসকল কোম্পানীগুলোর নদীর কিনারায় জাহাজ রাখার অনুমোদন থাকলেও তারা নিয়ম না মেনে নদীর মাঝে জাহাজ রাখছে। শুধু তাই নয়, এসকল শিল্পকারখার বর্জ্য পানিতে মিশে গিয়ে পানিকে দূষিত করছে। বর্তমানে ভয়াবহ দূষণ আর দখলের কবলে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী শীতলক্ষ্যা নদী। এক সময় এ নদীর পানি বোতলজাত হয়ে বিদেশে পাঠানো হতো। অথচ বর্তমান সময়ে এ নদীর পানি বিদেশে পাঠানো তো দূরের কথা এ নদীর পানি এখন ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা দূষণের জন্য দায়ী শিল্প-কারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নেই। বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ইটিপি থাকলেও অনেক সময়ই তা বন্ধ থাকে বলে জানা গেছে। পরিশোধন ছাড়াই শিল্পবর্জ্যগুলো গিয়ে মিশে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যার পানিতে। নদীটি ঘিরে এমন অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর পরিবেশের কোন ধরনের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। আবার যেসব কারখানার অবস্থান নদী থেকে দূরে, বর্জ্যনিষ্কাশন কাজে তারা ব্যবহার করছে বিভিন্ন ধরনের সরকারি খাল-বিল। ফলে এসকল প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যও এসে মিশে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যায়।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে উঠা সিটি গ্রæপসহ বেশকয়েকটি শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নদীকে দূষিত করছে। নদীর পানির রং বদলে গেছে। বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা, বালু নদীর পানি ব্যবহারকারী মানুষ। দূষিত বর্জ্যে নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। বালু, শীতলক্ষ্যা নদীতে আর আগের মতো মাছ নেই। দূষিত পানির কারণে দুর্গন্ধময়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এডিবির এক সমীক্ষা রিপোর্টে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিকে ব্যবহারের অযোগ্য বলা হয়েছে। পানিতে নূন্যতম দশমিক শূন্য ছয় ভাগ অক্সিজেন থাকার কথা। অথচ শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ দশমিক শূন্য চার ভাগের কম। ক্ষতিকারক পদার্থের অস্তিত্ব কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গুণ পাওয়া গেছে।
এসব নদীতে মিঠা পানিতে অনেক জাতের মাছ পাওয়া যেত। এখন জেলেরা আগের মতো মাছ পাচ্ছে না। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ প্রতিদিন রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছে বলে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে। দূষিত বর্জ্য জমে বালু, শীতলক্ষ্যা নদী নাব্য হারাচ্ছে। যার ফলে জমির উৎপাদন বন্ধের উপক্রম হয়েছে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কৃষকরা।
রূপগঞ্জের চনপাড়া এলাকার জেলে আজাহার আলী বলেন, বংশানুক্রমে আমরা নদী থেকে মাছ ধরে আসছি। গত ২-৩ বছর ধরে নদীতে আর তেমন মাছ পাচ্ছি না। বালু, শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষিত হয়ে মাছ বিলুপ্তি হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতিদিন তাদেরকে নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। পারাপার হওয়া সময় নদীর পানির পচাঁ দূর্গন্ধে তাদের স্কুলে যাওয়া আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন শিল্প কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলার কারইেই পানি থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে। এতে করে পরিবেশ মারাত্বকভাবে দূষিত হচ্ছে। কৃষকেরা বলেন, শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পানিতে মিশে গিয়ে নদীর পানিকে দূষিত করছে। নদীর এই দূষিত পানি ফসলি জমিতে গিয়ে মাঠের ফসল ও জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রূপগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগই পরিবারই কৃষি নির্ভর। এ সকল কল-কারখানার বর্জ্য ফেলার করনে যদি মাটির উর্বরতা কমে যায় তাহলে তাদের মতো অনেক কৃষককে না খেয়ে মরতে হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শীতলক্ষ্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ