Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকদের উদ্বেগ যৌক্তিক আইনমন্ত্রী

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬টি ধারা সংশোধনের দাবি সম্পাদক পরিষদের

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ছয়টি ধারাসহ কয়েটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। তারা বলেছেন, এই ধারাগুলো বাকস্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এ জন্য তারা এ ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। এই উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ঠিক করেছে, তাদের হাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য থাকা ওই আইনের খসড়া চ‚ড়ান্ত করার আগে স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকে সম্পাদক পরিষদকে ডাকা হবে। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এডিটর’স কাউন্সিল যে উদ্বেগ জানিয়েছে, তার অনেকাংশই যৌক্তিক বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে এক বৈঠকে ১২টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।
বৈঠক শেষ আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সম্পাদক পরিষদ যে আপত্তিগুলো তুলে ধরেছে, সেগুলো অনেকাংশে যৌক্তিক। তবে আইনটি এখন সংসদীয় কমিটিতে আছে। সম্পাদকদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেন, তারা যে আপত্তিগুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলো ‘অনেকাংশে যৌক্তিক’ মনে করায় আগামী ২২ এপ্রিল সংসদীয় কমিটির সভায় এডিটর’স কাউন্সিলকে রাখার প্রস্তাব করা হবে। ওই সভার পর সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো লিখিতভাবে স্থায়ী কমিটিকে দেবে। সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে। আনিসুল হক বলেন, এটা ফ্রিডম অব প্রেস বা ফ্রিডম অব স্পিচ বন্ধ করার জন্য না। সে ক্ষেত্রে এই আইনের মধ্যে যদি কোনো ত্রæটি থেকে থাকে, তাহলে পরে সেগুলো যেন অপসারণ করা যায়, সেভাবে যেন আইনটি সংধোশন করা হয়; সেই আলোকে এডিটর’স কাউন্সিলের সাথে স্থায়ী কমিটির সেই আলোচনা হবে এবং এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা দু’পক্ষই আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারি, তাদের যে কনসার্ন, আমরা দূর করতে পারব। টিভি চ্যানেলের সম্পাদকদেরও স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে ডাকা হবে কি নাÑ সে প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করব, তারা সিদ্ধান্ত নেবেন ডাকবেন কি ডাকবেন না। এমন একটা আইন করতে চাই যেটা গ্রহণযোগ্য না যুগপোযোগী হবে। সংসদীয় কমিটির সভা হবে ২২ এপ্রিল। সেখানে তিনি প্রস্তাব করবেন সম্পাদক পরিষদকে যেন আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হবে। এরপর তারিখ ঠিক করে আমন্ত্রণ গ্রহণের পর সম্পাদক পরিষদ যেন তাদের আপত্তি বা উদ্বেগের বিষয়গুলো লিখিত আকারে দেন। মন্ত্রী আশা করে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য। তারা আশা করছেন, আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদক পরিষদ যে উদ্বেগগুলো তুলে ধরেছে তা দূর করতে পারবেন।
সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, তাদের উদ্বেগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ নম্বর ধারা নিয়ে। তারা মনে করেন, এ ধারাগুলো বাকস্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। তিনি বলেন স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে যেটা আমরা বাংলাদেশে গর্ববোধ করি, সেটা গভীরভাবে ব্যাহত করবে। এসব কথা উনাদের (সরকারের মন্ত্রী) বলেছি। উনারাও সানন্দে গ্রহণ করেছেন। মাহ্ফুজ আনাম বলেন, তারা আশা করেন আইনটি সত্যিকার অর্থে সাইবার অপরাধ প্রতিহত করবে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কোনোরকম খর্ব হবে না। মাহফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, সম্পাদক পরিষদের অনুরোধে এই সভা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বলতে চাই, উনাদের (তিন মন্ত্রী) যে স্পিরিট আমরা দেখলাম, উনাদের যে সহযোগিতার স্পিরিট এবং আমাদের কনসার্নগুলো উনারা যেভাবে গ্রহণ করলেন এবং যে প্রস্তাব উনারা দিয়েছেন স্থায়ী কমিটিতে যে আলোচনা হবে সেখানে উনারাই প্রস্তাব করবেন সম্পাদক পরিষদকে যেন ডাকা হয় এবং সেখানে যেসব কনসার্ন আছে আমরা তা তুলে ধরব এবং এটা আমাদের যে স্বাধীন সাংবাদিকতা, যেটা নিয়ে বাংলাদেশে আমরা খুবই গর্ববোধ করি, সেটা খুব গভীরভাবে ব্যাহত হবে এবং এ কথাগুলো উনাদের বলেছি, উনারা খুবই সানন্দে গ্রহণ করেছেন। মাহফুজ আনাম আশা প্রকাশ করেন, যে আইনটি হবে, তা সত্যিকার অর্থেই সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে ব্যবহার করা হবে, তাতে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব হবে না। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছয়টি ধারা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও সম্পাদক পরিষদ এ আইন প্রণয়নের পক্ষে বলে জানান সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক। আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে, সত্যিকার অর্থে একটা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাংলাদেশে প্রয়োজন, কেননা এখন যে ধরনের সাইবার ক্রাইম হচ্ছে এবং আমরা দেখছি অনেক ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন মিডিয়া অনেকভাবে তারা উদ্যোগ নিচ্ছেন, যেটা আমাদের কনসার্ন বাড়ায়। আইনটা হোক, সুষ্ঠু আইন, যে আইনটি আসলে তার পারপাস সার্ভ করবে এবং স্বাধীন সাংবাদিকতাকে কোনোভাবেই তারা ব্যাহত করবে না, এটাই আমাদের বিশ্বাস।
জানা গেছে, গত ২৯ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর খসড়া চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। বহুল আলোচিত এই আইনের খসড়া আইনসভার অনুমোদনের জন্য গত ৯ এপ্রিল সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। খসড়া আইনটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে সরিয়ে সেগুলো আরো বিশদ আকারে যুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। এ আইন পাস হলে হ্যাকিং, ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে বা ভয়ভীতি সৃষ্টির জন্য কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং ডিজিটাল উপায়ে গুপ্তচরবৃত্তির মতো অপরাধে ১৪ বছরের কারাদাÐের পাশাপাশি কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদÐ বা উভয় দÐ দেয়া যাবে। আর ইন্টারনেটে কোনো প্রচার বা প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভ‚তি বা মূল্যবোধে আঘাত করার শাস্তি হবে ১০ বছরের জেল, ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দÐ। খসড়া আইনটির মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর থেকে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে। সাংবাদিকরাও প্রস্তাবিত আইনটির ৩২ ধারায় সমালোচনা করছেন। এই আইনের ফলে প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে বলে মনে করছেন তাদের অনেকে। ওই ধারায় সরকারি, আধা সরকারি, সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদÐ ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দÐের বিধান রাখা হয়েছে। খসড়া আইনটির মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে বলে ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। ২০০৬ সালে হওয়া আইসিটি আইন ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনে সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর কারাদÐ করা হয়। আর ৫৭ ধারার অপরাধকে করা হয় জামিনঅযোগ্য। ওই ধারাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী দাবি করে সেটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মীরা। ৫৭ ধারায় বলা হয়েছেÑ কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা স¤প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। আইনমন্ত্রী ও সম্পাদকদের মধ্যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবীর, নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মনিরুজ্জামান, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নইম নিজাম, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সম্পাদক

২৭ জানুয়ারি, ২০২৩
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ