Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ন্যায়বিচার পাওয়ার নানা অন্তরায়

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

‘বিচার অন্ধ’, এ কথাটি সর্ব মহলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ কারণে বিচারের নামে অন্ধত্বের বাতাবরণে অনেক কিছুই ঘটে যায়, যা ন্যায়বিচারের অন্তরায় হয়ে পড়েছে। বিচার অন্ধ, কথাটি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রে একজন নারীমূর্তির চোখে কালো কাপড় বেঁধে, এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে দাড়িপাল্লা দিয়ে আদালতে সামনে স্থাপন করা হয়েছে। বিচারব্যবস্থার উৎপত্তি ঘটে শাসক গোষ্ঠি অর্থাৎ রাজা, বাদশা, স¤্রাটদের চিন্তা-চেতনা থেকে। তারা প্রজাদের যে পদ্ধতিতে বিচার করতে চাইতেন তাদের তৈরি করা সেই পদ্ধতিতেই বিচার হতো। বিচারব্যবস্থার পূর্বে কোন দায়বদ্ধতা ছিল না। স্বাভাবিক ধারণা থেকেই বিচারক দোষী ব্যক্তির সাজা নির্ধারণ করতে পারতেন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে আইন প্রণয়নের ধারাবাহিকতা শুরু হলে শাসকদের প্রণীত আইনের মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে বিচারকদের সাজা নির্ধারণ করতে হয়। তবে দোষী বা নির্দোষ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন আইন বিচারকের সীমারেখা বেঁধে দেয়নি। তবুও বিচারকে অন্ধ আখ্যা দিয়ে অন্ধত্বের বাতাবরণে বিচারব্যবস্থাকে ঢেকে দিয়ে পুরো ব্যবস্থাকেই অন্ধকারকূপে ফেলে দেয়া হয়েছে। বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম বিচারপতি পদে স্থায়ী হওয়ার পর সংবর্ধনার উত্তরে বলেছিলেন যে, ‘আইন অন্ধ, কিন্তু বিচারক অন্ধ নন’ (সূত্র: মীর জাফর যুগে যুগে পৃষ্ঠা-৫৯) (ডি.এল.আর-২০০৯)।
‘অন্ধ’ বিভিন্নভাবে হতে পারে। চোখের দৃষ্টি হারিয়ে অনেকে অন্ধ হয়ে পড়েন, আবার মানসিক দৃষ্টি হারিয়েও কেউ কেউ অন্ধত্ব বরণ করতে পারেন। আবার কেউ চোখে দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন। এমন অন্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও ধারণা দেয়া হয়েছে। পবিত্র আল-কোরানে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘তারা বধির, মুক, অন্ধ, তারা আর ফিরবে না’ (সূরা: বাক্কারাহ আয়াত-১৮)। এ আয়াতে যারা চোখে দেখে না তাদের না বুঝিয়ে বরং জ্ঞান ও ইন্দ্রীয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে না তাদের বুঝানো হয়েছে (সূত্র: তাফসীর আহসানুল বয়ান পৃষ্ঠা-৬)। জ্ঞান ও উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা থেকেও অন্ধত্বের সীমারেখা উঠানামা করে, যা থেকে মানসিক অন্ধত্বের সৃষ্টি হয়। ‘লোভে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়’ এ কথাটি নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে এ প্রবাদটি চলে আসছে। এছাড়াও ‘মানুষ ভয়ে অন্ধ হয়ে যায়’ অর্থাৎ যখন একজন মানুষ ভয় পায় তখন তার বিবেক নিজ থেকেই অন্ধত্ব বরণ করে। যে কোন অবস্থান থেকে লোভ ও ভয় যে অন্ধত্ব সৃষ্টি করে তা যে কোন অন্ধত্বের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর, বিশেষ করে বিচারবিভাগের ক্ষেত্রে।
সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা বা আইন এখনো প্রণীত হয়নি। তাছাড়া সাম্প্রতিককালে নি¤œ আদালতের নিয়োগ পদ্ধতি রাজনৈতিক বিবেচনার উপর নির্ভরশীল। বিচারক বা বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা যতই প্রকট হোক না কেন, তা শাসকদের কর্ণকুহরে পৌঁছেনি, এ কারণে যে, তারাও বিষয়টি নিয়ে অন্ধত্ববরণ করেছেন নিজেদের স্বার্থে। কারণ শাসকরা অপকর্ম যত বেশি করছে বিচারবিভাগকে করায়ত্ত করার জন্য মানসিকভাবে তারা ততই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শাসকদের যতই করায়ত্ত থাকুক না কেন বিচারবিভাগ হাতের মুঠোয় না থাকলে তাদের ভয় থেকেই যাচ্ছে। ফলে পছন্দের লোককে বিচারক নিয়োগ করাকে শাসকরা নিরাপদ মনে করছেন। তবে শাসক পরিবর্তন হলে তাদের নিয়োগকৃত বিচারকগণ নতুন শাসকদের অনুগত বা করায়ত্ত হবে না এর নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।
জ্ঞানের পরিসীমা থাকলেও অভ্যাসগতভাবে লোভ এবং ভয় যখন কারো সামনে থাকে তখন সে নীতিচ্যুত হয়ে পড়ে। বিচারবিভাগে ঘুষের লেনদেন নতুন কোন বিষয় নয়। পূর্বকাল থেকেই এ কলঙ্ক থেকে বিচারক সমাজ নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। তবে সৎ অনেক বিচারক সব সময়ই থাকেন যারা শত লোভের বশবর্তী হয়েও বিবেককে বিসর্জন দেন না।
বিচারক নিয়োগকর্তারাই আইন প্রণয়ন করেন। স্বাভাবিকভাবে প্রণীত আইন শাসকদের সুবিধামতই হয়। আইন প্রণয়নে শাসকগণ জনস্বার্থের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রণয়ন করেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতায় টিকে থাকাই শাসকদের প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। যদি আইনটি তাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারে তখন আবার সংশোধন করেন। পরবর্তীতে শুরু হয় আইন প্রয়োগ ক্ষেত্রে দ্বিমুখী নীতি। আইন প্রয়োগকারী তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শাসকদের ইচ্ছামাফিক আইনটি প্রয়োগ করে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। অর্থাৎ শাসকদল যা করলে হয় আইনী, অনুরূপ কাজটি বিরোধী দল করলে হয় বেআইনী। যেমন সরকারি দল কোন মিছিল/মিটিং করলে অনুমতি তো দূরের কথা বরং উল্টো পুলিশ পাহারা দেয়। রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তাদের এ দ্বিমুখী নীতির পিছনে লোভ ও ভয় কাজ করে। সুবিধা মতো পোস্টিং ও চাহিদা মতো প্রমোশন নামক ঘুষ বড় আমলাদেরও অন্ধত্বে নিয়ে গেছে। পিছনে উদ্দেশ্য, দেশে বিলাসবহুল জীবনধারণ ছাড়াও কানাডা-আমেরিকাতে বাড়ি-গাড়ির নিশ্চয়তা।
বাংলাদেশ এমন একটা রাষ্ট্র যা মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে, যে গৌরব অর্জন করার সুযোগ পৃথিবীর অন্য অনেক রাষ্ট্রেরই হয়নি। ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে, সে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন হয়েছে, যার জন্য অনেক মানুষকে জুলুম-নির্যাতনের পাশাপাশি জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। এটা ছিল একটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ট্রেনিংবিহীন মুক্তিকামী সাধারণ জনগণের যুদ্ধ। ২৪ বছরের ব্যবধানে একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন (১৯৪৭) এবং অন্যটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের (১৯৭১) মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, অর্থাৎ পুড়ে পুড়ে যে দেশের গোটা জনগোষ্ঠির সোনায় পরিণত হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি এবং এটাই জাতির চরম দুর্ভাগ্য। এর মূল কারণ সুবিধাভোগী ও সুবিধাসন্ধানীদের প্রভাব, যাদের ভাগ্য পরিবর্তনের হাত অনেক লম্বা। সুবিধাভোগী ও সুবিধাসন্ধানীদের প্রভাব আজ গোটা জনগোষ্ঠির ভাগ্য অক্টোপাসের মতো গিলে খাচ্ছে। এ শ্রেণির দ্বারা শাসকদল তাদের প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখেন। এদের প্রকোপ-অত্যাচার এবং নির্যাতন থেকে জাতিকে রক্ষা করায় দায়িত্ব যাদের উপর ন্যাস্ত অর্থাৎ বিচার বিভাগ; তাদের অনেকেই পক্ষপাতিত্বের দোষে চিহ্নিত। বাংলাদেশে জ্ঞান চর্চার ও মেধার বাজার নেই বলেই সুবিধাসন্ধানীরা বাজারটি কেড়ে নিয়েছে; ফলে জাতি আজ চরম নাজুক অবস্থার শিকার।
‘নির্বাচন’ বলতে যেমন একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ভোট গ্রহণকে বুঝায়, ঠিক অনুরূপ বিচার বলতে ‘ন্যায় বিচার’কে বুঝায়। ‘ন্যায়’ এমন একটি বিষয় যা আইনের ধরাবাঁধা মাপকাঠিতে পরিমাপ করা যায় না। বিবেকই এর একমাত্র মাপকাঠি। সে বিবেক হতে হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং পক্ষপাতিত্ববিহীন। ক্ষেত্র বিশেষ বিচারবিভাগের পক্ষ পাতিত্ব এখন দিনের আলোর মতো সত্য। ঝুঁকি নিয়ে শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলার পরিণাম বিচারপতি এস. কে. সিনহা। ‘লুটতো ভাÐার, মারো তো গÐার’ এ নীতি অবলম্বন করে অর্থাৎ ‘মাথা’কে জব্দ করেই বাকীদের জন্য একটি ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে। ফলে অনেকেই স্বেচ্ছা অন্ধত্ববরণ করেছেন। তবে ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে, সংখ্যা তাদের যাই হোকনা কেন।
বিবেক অন্ধ না হলে মানুষ পক্ষপাতিত্ব করে না। অন্ধ যেমন একটি অঙ্গহানি, এর চেয়ে বেশি দুষ্টক্ষত হলো বিবেকের অন্ধত্ব, যাদের সাধারণ দৃষ্টিতে ‘জ্ঞানপাপী’ বলা হয়ে থাকে। এ জ্ঞানপাপীরাও সুবিধাভোগী ও সুবিধা সন্ধানীদের তালিকাভুক্ত।
বিচারক পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত পেশা, যাদের নিকট মানুষ মাথা ঝুঁকায়। সম্মানিত বিচারকগণ দাড়ি পাল্লা খচিত বিচারকের আসনে বসেন, গোটা মানবজাতি তাদের সম্মান করে। ন্যায়ভিত্তিক বিচারই সভ্যতার মাপকাঠি। কিন্তু ভয়, লোভ বা অধিকতর সুবিধা পাওয়ার আকাক্সক্ষায় যে বিচারক বিচারকের আসনে বসেন বিবেক দ্বারা তাড়িত না হয়ে বরং পক্ষপাতিত্বমূলক বিচারিক সিদ্ধান্ত দেন, তার চক্ষুলজ্জা নেই বলে আমি দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করি এবং এ বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা একজন বিবেকমান মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টকর।
মৌলিক অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। শাসকগণ যুগ যুগে আইন প্রণয়ন করে সে অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ভুক্তভোগী মানুষ যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম-আন্দোলনের মাধ্যমে সে অধিকারকে পুনরুদ্ধার করলেও তা রক্ষা করতে পারেনি। তবে জবাবদিহিতা সৃষ্টি হয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে। কোন কোন রাষ্ট্রে (বাংলাদেশসহ) জবাবদিহিতার পাঠ চুকিয়ে দিয়েছে সুবিধাবাদী ও সুবিধাসন্ধানীরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটিই উপায় তা হলো, জনপ্রতিরোধ, যা জনগণের বিবেক থেকে উৎসারিত। মানুষ এখন আপোসকামী হতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ হয় রণক্লান্ত, নতুবা বিশ্রাম নিচ্ছে। নতুবা এতো অবিচার, এত অন্যায় সত্তে¡ও মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠছে না কেন? গণমানুষের অনেক অন্দোলন সফল হয়েছে, আবার সুবিধাভোগী ও সুবিধাসন্ধানীদের জন্য তা বিফলও হয়েছে অনেক বার, কিন্তু মূল চিন্তা-ধারণা থেকে মুক্তিকামী স্বাধীনচেতা মানুষ সরে আসেনি। শত অন্যায়, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণমানুষের উত্থান দেখার জন্য সময় লাগতে পারে, তবে উত্থান অনিবার্য।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ন্যায়বিচার

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন