Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঐক্যের বিপরীতে বিভাজনের যুদ্ধনীতি পশ্চিমাদের

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের দু’ বছরের মাথায় বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের মোড় পরির্বতন বা নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। পশ্চিমা নয়া বিশ্বব্যবস্থার আলোকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমানবিক উত্তেজনার ভেতর থেকে বিশ্ব মানচিত্রে যে সব পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তার অনেকটাই এখন আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করলেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে ডিভাইডিং ফ্যাক্টরগুলো এখন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একটু গভীরভাবে অবলোকন করলে দেখা যাবে, বিশ্বের যে সব অঞ্চলে রাজনৈতিক বিভক্তি ঘুচিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে সে সব ক্ষেত্রে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের তেমন কোন ভ‚মিকা নেই বললেই চলে। ¯øায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ের প্রথম ধাক্কায় বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে দুই জার্মানী এক হয়ে যাওয়ার পেছনে বিশেষত দুই জার্মানীর জনগনের স্বাভাবিক, স্বতস্ফুর্ত, প্রবল ও ঐকান্তিক ইচ্ছাই কাজ করেছিল। এই ঐক্য প্রক্রিয়ার কারণে ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের জন্য তেমন কোন হুমকি বা ক্ষতির কারণ না থাকলেও দুই জার্মানীর ঐক্যের মধ্য দিয়ে ইউরোপে শক্তির ভারসাম্য তৈরী হয়েছে। তবে পশ্চিমাদের নীতি ইউরোপ এবং এশিয়ায় এক রকম নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যকার ¯œায়ুযুদ্ধের ফলাফল হিসেবে এবং পঞ্চাশের দশকে কোরীয় যুদ্ধে এই দুই পরাশক্তি কোরিয়ার দুই অংশের পক্ষাবলম্বনের ফলশ্রæতিতে জার্মানীর মত কোরিয়ান পেনিনসুলাও উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত হয়ে যায়। মার্কিনীদের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে ১৯৫০ সালের জুনমাসে শুরু হওয়া কোরীয় যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে একপাক্ষিক যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি হয়তো কোরীয় যুদ্ধকেও ছাড়িয়ে গেছে। কোরীয় যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি এবং যুদ্ধ ক্রমবর্ধমান হারে রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য নিহত হওয়ার পর ১৯৫১ সালের জুলাইয়ে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শান্তি আলোচনা শুরু হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বিজয়ের প্রত্যাশায় শান্তিচুক্তিকে প্রলম্বিত করে নিজেদের ক্ষতিই শুধু বাড়িয়ে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে একটি অস্ত্র বিরতি চুক্তি হলেও দুই কোরিয়ার যুদ্ধ কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়নি। অস্ত্রবিরতির পর থেকে তেমন কোন রক্তক্ষয়ী সংঘাত না ঘটলেও গত ৬৫ বছর ধরেই দুই কোরিয়ার সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি, বিষোদগার এবং প্রপাগান্ডায় লিপ্ত রয়েছে। ¯œায়ুযুদ্ধের পর যেভাবে দুই জার্মানী একীভ‚ত হয়েছিল, ঠিক একইভাবে দুই কোরিয়াও একীভ‚ত হওয়ার সব ধরনের আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা বিরাজমান থাকলেও বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার আগ্রহ যেন কারোই ছিলনা। দুই কোরিয়ার জনজনের মধ্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐক্য ও নিবিড় আত্মীয়তার বোধ অক্ষুন্ন থাকার পরও বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ‚-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থহানির আশঙ্কা থাকায় দুই কোরিয়ার ঐক্য প্রক্রিয়া সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক, ক‚টনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উত্তর কোরিয়াকে একঘরে করে ফেলার কারণে উত্তর কোরিয়ার নেতারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, একটি আঞ্চলিক সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার মানসে উত্তর কোরিয়ায় পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত করার প্রস্তুতি নেয় দীর্ঘদিন ধরে। অব্যাহত পশ্চিমা হুমকির মুখেই তারা একের পর এক পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালায় এবং সফলও হয়। এমনকি হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে বলেও উত্তর কোরিয়া দাবী করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর উত্তর কোরিয়ার উপর চাপবৃদ্ধি, অব্যাহত যুদ্ধের হুমকি এবং দক্ষিন কোরিয়ার সাথে সামরিক মহড়ার মধ্যে সব হুমকি ও চাপ উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া একের পর এক শুধু পারমানবিক পরীক্ষাই চালায়নি। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর পারমানবিক বোমা হামলারও হুমকি দিয়েছে। এমনি চরম উত্তেজনাকর মুহূর্তে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শান্তির বাতাবরণ দেখা দিয়েছে। কোরীয় শীর্ষনেতারা প্রথমবারের মত সীমান্ত অতিক্রম করে হাস্যজ্জ্বোল করমর্দন করে একসাথে বসে দুই কোরিয়া একীভ’ত করণের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন।
সিকি শতাব্দী আগেই দুই জার্মানী এক হয়ে গেছে। প্রায় দুৃই দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর উত্তর ও দক্ষিন ভিয়েতনাম একীভ‚ত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট দক্ষিন ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের পতনের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক উত্তর ভিয়েতনামের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর হোচিমিন সিটিকে রাজধানী করে একীভ’ত সমাজতাস্ত্রিক ভিয়েতনামের যাত্রা শুরু হয়। রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে দেশগুলো সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পরাশক্তিগুলোর ক্রীড়নকে পরিনত হয়েছে। এভাবে কোন জাতিই নিজেদের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং গৌরবকে রক্ষা করতে পারছেনা। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে ৬৫ বছর পেরিয়ে এসে দুই কোরিয়া একীভ‚ত হওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে। জার্মানী, ভিয়েতনাম, কোরিয়াসহ পুরনো রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব কাটিয়ে জাতিসমুহ যখন আবারো ঐক্যবদ্ধ হয়ে নয়াসা¤্রাজ্যবাদের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর শপথ নিচ্ছে ঠিক তখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নতুন করে বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শেষ সময়ে এসে ইরাণের পারমানবিক প্রকল্প নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে দ্বন্দের অবসানকল্পে যে ৬ জাতির পরমানু সমঝোতা হয়েছিল তা মধ্যপ্রাচ্যকে একটি সম্ভাব্য বড় সংঘাত থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হয়েছে বলে পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা কখনোই জায়নবাদি ইসরাইলের লক্ষ্য ছিলনা। তারা শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি, পারস্পরিক অনাস্থা ও অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রেখে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবায়নে বিশ্বসম্প্রদায়ের উদ্যোগকে বিলম্বিত ও ব্যর্থ করে দেয়ার পাশাপাশি আরবদের কাছ থেকে নতুন নতুন ভ’-খন্ড দখল করে তাদের কথিত প্রমিজড ল্যান্ড বা গ্রেটার ইসরাইল বাস্তবায়ন করতে চায়। এই মে মাসে ইসরাইল রাষ্ট্রের ৭০ বছর পূর্ণ হবে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বৃটিশ ইহুদি কমিউনিটি নেতা হাউজ অব কমন্সের জেষ্ঠ সদস্য লর্ড রথচাইল্ডের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বালফোর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আবাসভ’মি গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছিল। ফিলিস্তিনে শতকরা ১০ ভাগেরও কম জনসংখ্যার ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভ’মি গড়ে তোলা ছিল রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব ব্যাপার। শুধুমাত্র পশ্চিমা অস্ত্র, অর্থ এবং উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণকে পুঁজি করে শতকরা ৯০ ভাগ আরব ফিলিস্তিনীকে বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে সে রাষ্ট্রটিকে ক্রমে সম্প্রসারিত করার কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ করেনি ইসরাইল। পিতৃভ’মি থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত ও গণহত্যা চালানোর মধ্য দিয়ে জায়নবাদি ইহুদিরা মুসলমানদের সাথে সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে সমূলে ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের আগ্রাসী মনোভাব ও সম্প্রসারণবাদি নীতির কারণেই আরব-ইসরাইল যুদ্ধ ও সংঘাতের মূল কারণ। ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদি নীল নকশায় ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকে প্রতিটি আরব-ইসরাইল যুদ্ধেই পশ্চিমারা সরাসরি ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধবিরতি ও যুদ্ধের ফলাফল ইসরাইলের পক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব যুদ্ধে ইসরাইল আরবদের কাছ থেকে নতুন নতুন ভ‚মি দখল করে ইসরাইলের সীমানা বর্ধিত করেছে। এসব পুরনো ইতিহাস সবারই জানা। মধ্যপ্রাচ্যের পবিত্র ভ‚মির উপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার শত বছর পেরিয়ে এসে এখানকার জনগন সত্যিকার অর্থে নিজেদের স্বাধীন বাসভ‚মির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, লেবানন ও সিরিয়ার শাসকরা জনগনের সে প্রত্যাশার কথা বুঝেই একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। যেখানে জায়নবাদি ইসরাইল তার বিবলিক্যাল প্রমিজ্ড ল্যান্ড বা গ্রেটার ইসরাইল গড়ার স্বপ্নে বিভোর, এবং ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদিরা তাদের পোষ্য ইসরাইলের সব আব্দার ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে শর্তহীনভাবে অঙ্গিকারাবদ্ধ, তখন আরবদের স্বাধীনতার স্বপ্ন যেন ইসরাইলীদের কাছে নস্যি। ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, আফগান তালেবান মুজাহিদ, লিবিয়া তথা আফ্রিকার অবিসম্বাদিত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে পাতানো ষড়যন্ত্রের জালে ফেলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর যে ক’কজন আরব নেতা পথের কাঁটা হিসেবে অবশিষ্ট ছিলেন সিরিয়ার বাশার আল আসাদ তাদের অন্যতম। তবে ইরানের বিপ্লবী সরকারই হচ্ছেএসব পথের কাঁটা দূর করার প্রধান বা চ‚ড়ান্ত টার্গেট। সা¤্রাজ্যবাদি সংকট এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পুরনো বিভক্তি কাটিয়ে দেশগুলো যখন পুরনো রাজনৈতিক মানচিত্রে একীভুত হয়ে যাচ্ছে, তখন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নতুন বিভাজন রেখা টানা হচ্ছে শুধুমাত্র জায়নবাদি ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে।
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিদের পাতানো সাজানো গৃহযুদ্ধে গত পাঁচবছরে সিরিয়ায় যত সংখ্যক মানুষ হতাহত ও গৃহহীন হয়েছে তা ইসরাইলের জনসংখ্যার অনেক বেশী। তবে ইরান, রাশিয়া এবং তুরস্কের হস্তক্ষেপের কারণে সিরিয়ায় ইরাক বা লিবিয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি সম্ভব না হওয়ায় জায়নবাদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন বড় ধরনের হোঁচট খেলেও দাবার গুটি হিসেবে আবারো তারা ফল্স ফ্লাগ ও প্রোপাগান্ডার উপর ভর করে এগোচ্ছে। গণবিদ্ধংসী ক্ষেপনাস্ত্র থাকার মিথ্যা প্রচারনা চালানোর পর ইরাকের সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে ন্যাটো জোট যেভাবে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল সিরিয়ায় তারা ঠিক একই রকমভাবে ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাইছে। এবার তারা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সিরিয়ার বেসামরিক জনগনের উপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ তুলে কোন তথ্য-প্রমান ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং ফ্রান্স একযোগে সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা ও টিকে থাকা সিরীয় বিদ্রোহীরা কার্যত নির্মূল হয়ে পড়ার পর এখন ইসরাইল এবং মার্কিন সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধমঞ্চে হাজির হয়েছে। সব আন্তর্জাতিক কনভেনশন লঙ্ঘন করে ইসরাইল এবং আমেরিকা এখন সিরিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে। মূলত তাদের এই যুদ্ধ পরিকল্পনা কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় ভৌগলিক সীমান্তে সীমাবদ্ধ নয়। একদিকে সিরিয়া ও ইরানের সীমান্তে এবং বিভিন্ন দেশের এসব দেশের স্বার্থের উপর আঘাত হানতে শুরু করেছে। গত এপ্রিলের শেষদিকে মালয়েশিয়ায় একজন ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানীকে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্টরা। অবশ্য ফিলিস্তিনী ও আরবদের জমি দখলের পাশাপাশি ইসরাইলীদের টার্গেটেড কিলিংও দশক ধরেই অব্যাহত আছে। ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য গত ৭০ বছর ধরে পশ্চিমা ক‚টনৈতিক কোরসমুহ ইসরাইলের পক্ষে কাজ করছে সেই সাথে প্রতিবছর মার্কিন জনগনের ট্যাক্সের শত শত কোটি ডলার দেয়া হচ্ছে। এভাবে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি ক্যান্টনমেন্ট এবং অপরাজেয়-দানবীয় শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এতকিছুর পরও শেষরক্ষা হচ্ছেনা ইসরাইলের। বিগত দুইটি যুদ্ধে অপরাজেয় আইডিএফ হেজবুল্লাহ ও হামাসের হাতে মার খেয়ে ইসরাইলে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়ার পর এবার ইসরাইল রক্ষায় পৃষ্ঠপোষক মার্কিনীরা সরাসরি মাঠে নেমেছে। সিরিয়াকে বিভক্ত করে এবং ইরানে রিজিম চেঞ্জ করে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। গতমাসে হঠাৎ করেই দামেস্কের উপর ত্রিদেশীয় বিমান হামলার পর দামেস্কের উপকণ্ঠে ফোরাত নদীর পূর্ব তীরে মার্কিন সেনা উপস্থিতি জোরদার করা হচ্ছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেগের্ই লেভরভ দাবী করেছেন, সিরিয়াকে বিভক্ত করার উদ্দেশ্যেই সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি বজায় রাখতে চাইছে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের অবৈধ সন্তান ইসরাইলের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের নিরাপত্তার জন্যই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বশংবদ মিত্ররা সিরিয়া ও ইরাককে ভাগ করে ইরানকে ধ্বংসের ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবীন মার্কিন সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ পল ক্রেইগ রবার্টস-এর একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘ ইসরাইল ইস্যুড অ্যান আলটিমেটাম টু রাশিয়া’। মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদি স্বপ্ন পুরনের শেষ চেষ্টা হিসেবে ইসরাইল ও আমেরিকা এখন সিরিয়ায় সরাসরি সামরিক আগ্রাসন শুরু করেছে, এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থানের পাল্টা হুমকি দিচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিবারম্যান সম্প্রতি একটি রাশিয়ান পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সিরিয়ায় স্থাপিত রাশিয়ান এস-৩০০ ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি ইসরাইলী বিমানকে টার্গেট করে তাহলেও তারাও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। অর্থাৎ ইসরাইলকে নির্বিঘেœ সিরিয়ায় বিমান হামলা চালাতে দিতে হবে। এ বিষয়ে ইনভেস্টমেন্ট ওয়াচ বøগে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নিবন্ধকার ক্রিস বø্যাক বিষ্ময় প্রকাশ করে লিখেছেন, ইসরাইলের মত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র যেখানে কনভেনশনাল অস্ত্রেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, সে দেশটি কিনা বিশ্বের অন্যতম সামরিক পরাশক্তি রাশিয়াকে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়! তবে একে শুধুই ইসরাইলের হুমকি ভাবলে ভুল হবে। ঔদ্ধত্বের উৎসটি কোথায় তা সবারই জানা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নয়া বিশ্বব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে নয়া সামরিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ইসরাইল হচ্ছে তার ভ‚-রাজনৈতিক বাইপ্রোডাক্ট।এই সা¤্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার আওতায় যে বিশ্বব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে তা’ এখন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। অস্ত্র ও অর্থের বলে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হলেও এই রাষ্ট্রটিকে কখনো সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কোন উদ্যোগ নেয়নি পশ্চিমারা। উপরন্তু গত ৭০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তৎপরতার সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগই পরিচালিত হয়েছে ইসরাইলের অস্তিত্বকে নিষ্কণ্টক রাখার প্রয়াসে। বিশ্বব্যবস্থায় মূল শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য নির্ধারনে ইউরোপের দুই প্রধান প্রতিদ্ব›িদ্ব পক্ষ গ্রেট বৃটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা তৈরী হয়েছিল ১৯১৭ সালে সাইকস-পিকট চুক্তির মধ্য দিয়ে। প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমান সা¤্রাজ্যের পতন নিশ্চিত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারনে এক গোপন চুক্তি হয় ফ্রান্সের পক্ষে তৎকালীন ফরাসী ক‚টনীতিক ফ্রাঙ্কোস জর্জ পিকট এবং বৃটিশ পক্ষে স্যার মার্ক সাইকস। সম্ভাব্য চুক্তির আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৯১৫ সালে এবং তৃতীয় পক্ষ হিসেবে রাশিয়ার জার শাসকদের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা দ্বিপক্ষীয় সাইকস-পিকট চুক্তি হিসেবেই বলবৎ হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত নিয়ে পশ্চিমা দুই পরাশক্তির গোপণ চুক্তির মেয়াদ শত বছর পেরিয়ে আসলেও এখনো তা সেই চুক্তি অনুসারেই পরিচালিত হচ্ছে। তবে রাশিয়ার জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলিখিত অভিষেক ঘটেছে। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন ও দখলবাজি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক দামেস্কের উপকণ্ঠে বিমান হামলাসহ মধ্যপ্রাচের প্রতিটি ইস্যুতে এই তিনশক্তিকে একাট্টা হয়ে সামরিক আগ্রাসন চালাতে দেখা গেছে। মুক্ত বাণিজ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে গত শত বছরে বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটলেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাগ্য নিয়ে সা¤্রাজ্যবাদি চক্রান্তের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন এবং চীনে পুঁজিবাদি অর্থনীতির উচ্চাভিলাষি প্রকল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এক ধরনের অলিখিত বোঝাপড়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে ইরানের বিপ্লবী সরকার এবং ফিলিস্তিনে ইসরাইল বিরোধী গেরিলা গ্রæপগুলোর ক্রমবর্ধমান শক্তিবৃদ্ধির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদি ইসরাইলের ভবিষ্যৎ এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী রোডম্যাপ বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। এখন একদিকে হুমকি, অন্যদিকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক টোপ গিলিয়ে রাশিয়া এবং চীনকে ম্যানেজ করে সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে নতুন বিভাজন সৃষ্টির শেষ চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি গ্রহণের বিষয়টিও তাদের মাথায় রয়েছে। কোরীয় যুদ্ধ নিয়ে নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এতদিন ধরে যে সব প্রচারনা চালিয়ে আসছে এবং ইতিহাসের বইয়ে এ সম্পর্কে যে সব তথ্য লেখা হয়েছে তার সবই সত্যের অপলাপ। কোরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে গঠিত ট্রুথ কমিশনের রিপোর্টে এতদিনের প্রচারিত তথ্যের বিপরীত চিত্রই পাওয়া যায়। কোরীয় যুদ্ধের শুরু এবং যুদ্ধে বেসামসরিক মানুষের উপর নির্বিচার গণহত্যার পেছনে মার্কিন সেনাবাহিনীর ভ’মিকাই উঠে এসেছে রিপোর্টে। ৬৫ বছর ধরে কোরিয়ার দুই অংশের মধ্যে একটি কৃত্রিম সংকট জিইয়ে রাখা হয়েছে শুধুমাত্র পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে নানা ধরনের হুমকি দিয়ে যখন পাল্টা পারমানবিক হামলার হুমকি শুনতে হয়েছে ঠিক তখনি দুই কোরিয়ার মধ্যে ঐক্য ও শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়াকে ম্যানেজ করে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী নতুন যুদ্ধ পরিকল্পনার আওতায় সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক এবং ইরানের মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলার জোর প্রস্তুতি চলছে। সব কৃত্রিম বিভাজন ও সা¤্রাজ্যবাদী হুমকি সত্বেও মুসলমান দেশগুলোর মানুষের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ওআইসি সম্মেলনে নানা বিষয়ে ঐক্যমত্য এবং লেবাননের জাতীয় নির্বাচনে হেজবুল্লাহর বিজয় তার সর্ব সাম্প্রতিক উদাহরণ।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুদ্ধ


আরও
আরও পড়ুন