Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাড়ছে নৃশংস হত্যাকান্ড

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মাত্র ৩০ টাকার জন্য সন্টু (৩০) নামে এক রিকশাচালককে ছুরিকাঘাতে খুন করেছে জয়ন্ত কুমার জয় নামে এক যুবক। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় জয়পুরহাট শহরের কালিমন্দির এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রাজধানীতে ২ মেয়েকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যা, বগুড়ায় হাত-পা বাধা ধান ক্ষেত থেকে গলাকাটা চার জনের লাশ উদ্ধার, চট্টগ্রামে মেধাবী স্কুলছাত্রীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার মতো দেশে বেড়েছে বীভৎস ও রোমহর্ষক হত্যার ঘটনা। আপনজনরাও ঘটাচ্ছে অবিশ্বাস্য খুন-খারাবি। মা খুন করছে সন্তানকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায় ও ধান ক্ষেতে, বালুর ভেতর, বস্তার ভেতর, পানির ট্যাংকে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্ধই অধিকাংশ খুনের ঘটনার কারণ। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১ হাজার ১২ জন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অপরাধীদের ছাড় পাওয়া, মাদকাসক্ততা ও অর্থনৈতিক কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে বিচার বিলম্বিত সংস্কৃতিও নৃশংস হত্যাকান্ড বাড়ার নেপথ্যে কাজ করছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ ও ভীতি কমে গেছে। তারা (অপরাধীরা) মনে করে খুন করে পাড় পাওয়া যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের মুখোমুখি করতে না পারলে নৃশংস খুন কমবে না। এখন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও মানুষ খুনের মতো কঠিন কাজ করতে পারছে। তিনি বলেন, অপরাধীদের খুঁজে বের করে সঠিত তথ্য প্রমানে ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনতে হবে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আদালত যাতে অপরাধীর বিচার করতে পারে সে বিষয়টি কেয়াল করতে হবে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। তবেই মানুষ আইনের প্রতিশ্রদ্ধাশীল হবে এবং সমাজে নৃশংস ঘটনা কমে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নৃশংসভাবে মানুষ খুন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য মানুষ নৃশংস হয়ে উঠেছে। সকলের জন্য সমানভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের সকলকেই আইনের প্রতিশ্রদ্ধা ও আস্থা থাকতে হবে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভ’মিকা পালন করতে হবে। নৃশংস হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এন্টি টেররিজম ইউনিট প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশে মাদক সেবন ও সরবরাহ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। আর এ জন্য মানুষ নৃশংস আচরন করছে। প্রতিটি খুনের ঘটনা পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে। নৃশংস খুনের ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে সমাজের সকলকে মাদক প্রতিরোধসহ আইনের প্রতিশ্রদ্ধাশীল হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছেন ৩ হাজার ৫৪৯ জন। ২০১৬ সালে ৮৭৯ জন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫ জন, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন খুন হয়েছেন। এছাড়া গত ৫ বছরে রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২১৮ জন, ২০১৬ সালে ৪৮ জন, ২০১৫ সালে ২৩৯ জন, ২০১৪ সালে ২৬২ জন, ২০১৩ সালে ২৪৫ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকান্ডই নৃশংস।
গত ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যার পর রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন পাইকপাড়া সি টাইপ সরকারি কোয়ার্টারের ১৩৪ নং ভবনের চতুর্থ তলা থেকে মা ও দুই মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত মা জেসমিন আক্তার (৩৫) কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের কোষাধ্যক্ষ পদে চাকরিরত ছিলেন। স্বামী হাসিবুল ইসলাম জাতীয় সংসদের সহকারী লেজিসলেটিভ ড্রাফ্সম্যান হিসেবে কর্মরত। নিহত দুই মেয়ের নাম হাসিবা তাহসিন হিমি (৮) ও আদিবা তাহসিন হানি (৪)। হাসিবা মডেল একাডেমিতে ক্লাশ টুতে পড়ছিল। নিহত তিনজনের গলা কাটা ছিল। জেসমিনের গলার পাশাপাশি দুই হাতের কবজির কাছে কাটা ছিল। ডিএমপি’র মিরপুর বিভাগের দারুসসালাম জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিহত জেসমিন আক্তারের কর্মস্থল থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। চিরকুটটিতে লেখা আমি বেঁচে থাকার কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার সব দিকে অন্ধকার নেমে আসছে। তাই এ সিদ্ধান্ত নিতে হলো। আমার মৃত্যুর জন্য আমার নির্মম দুর্ভাগ্যই দায়ী। মৃত্যুর আসল কারণ জানতে ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গত ৮ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিকেতনের ৩ নম্বর সড়কে টিনসেল টাউন নামের বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিস থেকে ১৮ বছর বয়সী কর্মচারী শাকিলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে সময় শাকিলের গলা ও হাতে ধারাল অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ আরাফাত নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। ডিএমপির গুলশান থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, শাকিল ও আরাফাত নিয়মিত ইয়াবা সেবন করত। তাদের কাছ থেকে একজন ইয়াবার টাকা পেত। ওই টাকা শাকিলেরর দেয়ার কথা ছিল। সেই টাকা না দেয়ায় শাকিলকে হত্যা করে আরাফাত। আরাফাতকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ওসি বলেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিসে ঘটনার রাতে তারা দুজন বিয়ার ও ইয়াবা সেবন করে। শাকিল ঘুমিয়ে গেলে আরাফাত তাকে বেঁধে দড়ি দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে তার মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায়।
চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ফেনীর ফুলগাজীর জাহেদা খাতুনকে (২১) অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। দেড় মাস পর পুলিশ সেই তরুণীর কবর শনাক্ত করেছে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট এলাকা থেকে গ্রেফতারকৃত মো. হেলাল উদ্দিন(৫৩) ও বিবি কুলসুমা আকতার(২৬) দম্পতি গত ৮ মে মঙ্গলবার বিকালে ফেনীর আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে। নিহত জাহেদা খাতুনের ভাই গাড়ি চালক হুমায়ুন জানায়, গত ২৪ মার্চ ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন গাবতলা গ্রাম থেকে নিখোঁজ হন তার বোন জাহেদা খাতুন (২১)।
ফুলগাজী থানার ওসি মো. হুমায়ুন কবির জানান, আটককৃত নারী বিবি কুলসুমা আক্তার পুলিশ হেফাজতে বলেন, আমি তাকে (জাহেদা) নিয়ে নুর আলমের কাছে দিয়েছি। নুর আলম নিজে তার সঙ্গে খারাপ কাজ করেছে তারপর মানুষ দিয়ে করিয়েছে। সে তাকে খোকনের হাতে দিয়েছে। সেখানে সে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট সংক্রমণব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালের এন্ট্রি খাতায় তার স্বামী হেলাল উদ্দিন নিজের নাম জসিম উদ্দিন উল্লেখ করে বোন পরিচয় দিয়ে জাহেদা খাতুনের নাম সাহেদা আকতার লেখা হয়। হাসপতালে দুইদিন থাকার পর জাহেদা খাতুন মারা গেলে তার লাশ চট্টগ্রাম জেলার ফৌজদারহাটের ফকিরহাট এলাকার একটি পুকুর পাড়ে পুঁতে ফেলা হয়। এছাড়া গত ১ মে মঙ্গলবার বিকেল থেকে নিখোঁজ হন চট্টগ্রাম সানশাইন গ্রামার স্কুলে মেধাবী ছাত্রী তাসফিয়া (১৬)। পরের দিন বুধবার সকালে নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির অদূরে ১৮ নম্বর ঘাট এলাকায় চোখ, নাক-মুখ থ্যাতলানো তাসফিয়ার লাশ পায় পুলিশ।



 

Show all comments
  • নাহিদ ১০ মে, ২০১৮, ৩:২৫ এএম says : 0
    সকলের জন্য সমানভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যাকান্ড

২২ এপ্রিল, ২০২২
৯ ডিসেম্বর, ২০২১
৩ ডিসেম্বর, ২০২১
১৪ অক্টোবর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ