Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের ভিত্তি সবর

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পরিপূর্ণ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা যাকে এই গুণ দেন; সেই এই গুণে সুসজ্জিত হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ গুণটির উপস্থিতি অপরিহার্য। মানুষের উন্নতি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের বড় উপায় হলো এই সবর বা ধৈর্য। মানুষ যত বেশি সবর করতে পারবে, তার গুনাহ তত বেশি মাফ হবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। মুমিনের সবর প্রয়োজন জীবনের নানান বিপদ-মুসিবত, কষ্ট ও জটিলতার সামনে। সে বিশ্বাস করে যত সংকটই আসুক না কেন সব আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে সে তা হালকা ভাবে মেনে নেয়। বিপদে পড়লেও খুশি থাকে। এ ক্ষেত্রে ক্ষোভ, হতাশা ও অস্থিরতা প্রকাশ করে না। নিজের ভাষা ও আচরণকে সংযত রাখে। কারণ, সে আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী। সে তাকদীরকে বিশ্বাস করে। তাকদীরকে বিশ্বাস করা ঈমানের ছয়টি রোকনের একটি। তাকদীরের উপর ঈমান রাখলে তার অনেক সুফল পাওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি হল, বিপদে ধৈর্য ধারণ। সুতরাং কোন ব্যক্তি বিপদে সবর না করলে তার অর্থ হল, তার কাছে ঈমানের এই গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিটি অনুপস্থিত। অথবা থাকলেও তা খুব নড়বড়ে। সেই বান্দার কোনো শক্তিই নেই, যার গুণাবলির মধ্যে সবর তথা ধৈর্য নেই। আর সেই বান্দা বিজয়ও ছিনিয়ে আনতে পারে না যে সবরকারী বা ধৈর্যশীল নয়। আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূল আলাইহিস সালামদের এই বিরল গুণে বিভূষিত করেছিলেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা নব্বই জায়গায় সবরের কথা বলেছেন।
সবরের আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া বা বিরত রাখা।
শরীয়তের ভাষায় সবর বলা হয়, অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহবা অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গাল চাপড়ানো ও বুকের কাপড় ছেড়া থেকে বিরত রাখা। কারো কারো মতে, এটি হলো মানুষের ভেতরগত একটি উত্তম স্বভাব, যার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের এক আত্মিক শক্তি যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে।
জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ আলাইহিকে সবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “হাসি মুখে তিক্ততার ঢোক গেলা।” কারও মতে, “সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদ মোকাবিলা করা।” আবার কারও মতে, “বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর।”
সবর তিন প্রকার। যথা :
প্রথম : আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদাত-বন্দেগী সম্পাদন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। দ্বিতীয় : আল্লাহ তা‘আলার নিষেধ এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অটুট ধৈর্য রাখা। এবং তৃতীয় : তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে ধৈর্য ধরা। এই তিন প্রকার সম্পর্কেই শায়খ আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহ আলাইহি তদীয় গ্রন্থ ‘ফুতুহুল গায়ব’ গ্রন্থে বলেন, “একজন বান্দাকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ে ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিতে হবে : কিছু আদেশ পালনে, কিছু নিষেধ থেকে বিরত থাকায় এবং তাকদীরের ওপর।” আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সব নবীকেই সবরের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ঈমানের পরীক্ষা দিয়েছেন। সবর বা ধৈর্য দ্বারা তিনি সব পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। তেমনিভাবে দুনিয়ায় যারাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়েছেন, তারাই ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। প্রত্যেক মুমিনের উচিত বিপদ-আপদে বিচলিত না হয়ে সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশা করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর শীষ্য ও সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন। এটি বেশি করা হয়েছে মক্কী জীবনে। খুবাইব বিন আরাত রাদিআাল্লাহু আনহু-এর হাদীসে আমরা এর চিত্র দেখতে পাই। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন কা’বার ছায়ায় বালিশে হেলান দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর কাছে অভিযোগ করলাম, কেন আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য চাইছেন না, আমাদের জন্য তাঁর কাছে দু‘আ করছেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে (এমন বিপদও এসেছে যে) কাউকে ধরা হতো। তারপর গর্ত খনন করে তাকে সেই গর্তে ফেলা হতো। এরপর করাত এনে তার মাথার ওপর রাখা হতো। অতঃপর তাকে দুই টুকরো করে লোহার চিরুনী দিয়ে তার শিরা-অস্থিসহ আচড়ানো হতো। তদুপরি তারা তাকে দ্বীন থেকে ফেরাতে পারতো না।
আল্লাহর শপথ! (এখন আমাদের পরীক্ষা চলছে) আল্লাহ এ দ্বীনকে পূর্ণতা দেবেন। একদিন এমন আসবে যখন আরোহীরা সানআ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত যাবে। চিতা আর ছাগল নিরাপদে থাকবে। এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতে হবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো। অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের আযাব অচিরেই দূর হয়ে যাবে। সুতরাং অতীতের উম্মতের মতো তোমরাও দ্বীনের বিপদে একটু ধৈর্য ধরো।” [সহীহ বুখারী : ৩৬১২]
ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, “বিপদ-মুসিবত হল নিয়ামত। কারণ এতে গুনাহ মাফ হয়। বিপদে ধৈর্য ধারণ করলে তার প্রতিদান পাওয়া যায়। বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে আরও বেশি রোনাজারি করতে হয়। তার নিকট আরও বেশি ধর্না দিতে হয়। আল্লাহর নিকট নিজের অভাব ও অসহায়ত্তের কথা তুলে ধরার প্রয়োজন হয়। সৃষ্টি জীব থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হয়। বিপদের মধ্যে এ রকম অনেক বড় বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। একদা সাহাবী সাদ বিন ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল, দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত কে? উত্তরে তিনি বলেন, “নবীগণ, অতঃপর যারা তাদের সাথে কাজকর্ম-বিশ্বাসে সামঞ্জস্যতা রাখে, অতঃপর যারা তাদের অনুসারীদের সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে। মানুষকে তার দ্বীন অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। দ্বীনি অবস্থান পাকাপোক্ত হলে পরীক্ষা কঠিন হয়। দ্বীনি অবস্থান দুর্বল হলে পরীক্ষাও শিথিল হয়। মুসিবত মুমিন ব্যক্তিকে পাপশূন্য করে দেয়, এক সময়ে দুনিয়াতে সে নিষ্পাপ বিচরণ করতে থাকে।” [তিরমিজি : ২৩২২] (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ