Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে মাহাথিরের উত্থান ও বিজয়

ড. আব্দুল হাই তালুকদার | প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গত ৯ তারিখে মালয়োশিয়ায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মালয়োশিয়ার কিংবদন্তী নেতা মাহাথির মোহাম্মদের চারদলীয় জোট পাকাতান হারাপান বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। ১০ তারিখেই রাত ১০টায় কুয়ালালামপুরের রাজপাসাদে রাজা সুলতান পঞ্চম মোহাম্মদের উপস্থিতিতে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। মাহাথির নিজ দল ত্যাগ করে বিরোধীদের নিয়ে জোট গঠন করেন। তিনি ১৯৮৩ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়োশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২২ বছর দোর্দান্ড প্রতাপে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে থেকে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যান। ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যাবার পর দেশটিতে দেখা দেয় পিছিয়ে পড়ার প্রবণতা, উন্নতি-অগ্রগতি থমকে যায়। বারিসান ন্যাশনাল নেতা নাজিব রাজাক দুর্নীতি, দুঃশাসন, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ ছিল না। ফলে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠেন নাজিব রাজাক। কালা কানুন জারি করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্তব্ধ করা হয়। বিরোধীদল দমন, অত্যাচার, নির্যাতন চলতে থাকে। বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা জেল, জুলুম, হুলিয়া প্রভৃতির ভয়ে সর্বদায় ভীত-সন্ত্রস্ত্র থাকেন। নাজিব রাজাক আজীবন ক্ষমতায় থাকার লিপ্সায় বিরোধীদল দমনে যাবতীয় কুটকৌশল অবলম্বন করেন। দেশের মানুষ তার এসব অপকর্ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি স্বচক্ষে দেখে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে পারছিল না। অর্থাৎ তারা বাধ্য হয়ে কালা কানুনের ভয়ে অনেকটা নিশ্চুপ থেকে সুযোগের অপেক্ষা করছিল।
নাজিব রাজাকের দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না। ৯২ বছর বয়সে মাহাথির মোহাম্মদকে সেকারণে এগিয়ে আসতে হয়। ভয় ছিল মাহাথিরের অনেক বয়স। এ বয়সে তিনি দেশের শাসনভার বহন করতে পারবেন কি না। মাহাথির অবশ্য নিজেও এ বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সেকারণে জোট গঠনের সময় তার দু’বছর ক্ষমতায় থাকার শর্তে তিনি রাজী হন। অর্থাৎ দু’বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর মাহাথির ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে যাবেন। আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী উপ-প্রধানমন্ত্রী হবেন। নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো জাতীয় নেতার অভাব মাহাথির মোহাম্মদ পূরণ করেছেন। তিনি তার শাসনামলে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে পরনির্ভরশীলতা বর্জন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। দীর্ঘ দুই দশকের অধিককাল ক্ষমতায় থেকে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশাল ভ‚মিকা রাখেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে মালয়বাসীদের অন্তরে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। সুযোগ পেয়ে মালয়বাসীরা নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছে। তারা নাজিবের বিরুদ্ধে না বলে তার দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। নাজিবের পরাজয়ের মূল কারণ হলো তার দুর্নীতি ও দুঃশাসন। তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান ও দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার পিতা তুন আব্দুর রাজাক ৪৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বারিসান ন্যাশনাল জোটের প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতা। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে দুর্নীতির যাঁতাকলে পিষ্ট করে দেশকে পেছনে ঠেলে দেন। তবে বিধাতার বিচার বড় নিষ্ঠুর। পাপ করে কেউ রেহাই পায় না। নাজিব রাজাক ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে ইতোমধ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পিতার ইতিহাসকে ¤øান করায় ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। মালোয়শিয়া একটি ফেডারেল স্টেট। ১৩টি রাষ্ট্র ও তিনটি ঐক্যবদ্ধ প্রদেশ নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। রাজধানী কুয়ালালামপুর, পুত্রজায়া হলো ফেডারেল সরকারের রাজধানী। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ মালয়েশিয়া। বিশাল আয়তনের দেশাটিতে অনুর্বর পতিত জমি অনেক। মাহাথির মোহাম্মদ সবেচেয় জনপ্রিয় নেতা। তিনি পেশায় একজন ডাক্তার। সরকারি চাকরি ছেড়ে ক্লিনিক খুলে সুনামের সাথে কাজ করেন। পরে রাজনীতিতে যোগদান করেন ও ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ২২ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার ক্ষমতা লাভের সময় দেশটির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা দুর্বল ছিল। ক্ষমতা লাভের পর তিনি সর্বক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন ও দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেন। বিশাল অনুর্বর এলাকাকে কাজে লাগিয়ে শিল্প কারখানা স্থাপন করতে থাকেন। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে তিনি মালয়বাসীদের কাছে অবিসংবাদী জাতীয় নেতার মর্যাদা লাভ করেন। একটি কৃষি নির্ভর দেশকে তার অসাধারণ মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সর্বোপরি সততা দিয়ে গড়ে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তিনি ছিলেন সময়ানুবর্তিতা, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার চরম আদর্শ। নিজে করে অপরকে সে পথে চলার অনুপ্রেরণাদাতা এই মানুষটি সকল দিক দিয়ে এক অনুসরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার বিশাল কর্মযজ্ঞ ও পরিকল্পনা মালয়েশিয়াকে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করে। শিল্প, কলকারখানা স্থাপনের সাথে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গণমানুষের জন্য নিশ্চিত করেন। ৯৫% শিক্ষা খরচ সরকারি তরফ থেকে নিশ্চিত করায় জনগণ শিক্ষালাভের অবারিত সুযোগ লাভ করে। প্রায় শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বেকারত্বের অভিশাপ মুক্ত করে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেন। শিক্ষিতের হার বাড়িয়ে বাহবা কুড়ানোর বদলে তিনি শিক্ষিত যুবকদের কাজের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। ৯৫ সালে দেশে একজনও বেকার ছিল না। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমিয়ে আনেন। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, আধুনিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির সফল ব্যবহার ও প্রয়োগ দরিদ্র মালয়েশিয়াকে পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রগুলোর সমপর্যায়ে উন্নীত করে। পশ্চিমা দুনিয়া মালয়েশিয়ার উন্নতি-অগ্রগতিতে অবাক ও বিস্মিত হয়। তার বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচার চলতে থাকে। বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ও হজ্জ প্রথার সংস্কারের কারণে তাকে দেশবিদেশের সমালোচনা হজম করতে হয়। তিনি আধুনিকতা বজায় রাখতে গিয়ে, ধর্মকে খাটো করার নীতি অবলম্বন করেননি। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকল্প নাই। তাই বলে ধর্মীয় শিক্ষা উন্নয়ন অগ্রগতির পথে বাধা হতে পারে না। ইসলামের চেতনা বুকে ধারণ করে মাহাথির মোহাম্মদ দেশকে নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার হাতে মালয়েশিয়াতে অল্প সময়ে চোখ বাঁধানো উন্নয়ন সম্ভব হয়। তিনি শুধু মানুষকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে নিজে বসে থাকেননি। টাইম মেগ্যাজিন একবার তার অফিসে আসার সময় রেকর্ড করে। পর পর পাঁচদিন তার অফিসে প্রবেশের সময় ছিল সকাল ৭.৫৭, ৭.৫৬, ৭.৫৭, ৭.৫৯ ও ৭.৫৭। নিজে সময়মত অফিসে আসেন ও নিজ কর্ম ঠিকমত করে উদাহরণ সৃষ্টি করেন। ক্ষমতালাভের পর তার একটা বড় অপারেশনের প্রয়োজন হয়। মন্ত্রী-মিনিস্টিারদের ও আমলাদের পরামর্শ ও অনুরোধ উপেক্ষা করে দেশেই অপরেশনটি সেরে ফেলেন। এতে দেশব্যাপী সাড়া পড়ে যায়। দেশের মানুষ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। তার নীতি ছিল নিজ আচারি ধর্ম পরকে শেখাও। নিজের জন্য যা ভালো, অপরের জন্যও তাই ভালো। নিজে কাজ করে অপরকে শিক্ষা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর অপারেশন দেখে মন্ত্রী-মিনিস্টার, আমলা ও ধনীদের বিদেশ যাবার হিড়িক থেমে যায়। দরিদ্র দেশের টাকা বিদেশে পাচার বন্ধ হয় ও সে টাকা খরচ করে আধুনিক মানসম্মত হাসপাতাল তৈরি করা হয়। মাহাথিরের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দেশটিকে স্বাবলম্বী করে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। এখন বাংলাদেশের মতো অনেক অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশের মানুষের টাকা খরচ করে মালয়োশিয়াতে চিকিৎসা নিতে যায়। মাহাথির মোহাম্মদ একজন চৌকস, মেধাবী, ভবিষ্যদ্রষ্টা, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক যিনি মালয়েশিয়ার জনগণকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার ধ্যানজ্ঞান ও পরিকল্পনা ছিল মানবকেন্দ্রিক। আধুনিকতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেও নিজের ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে যাননি। ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যাবার সময় তার ভাষণটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যা মুসলিম বিশে^র জন্য অনুসরণীয়। তার কথা ছিল, মুসলমানদের দুর্গতি-অনগ্রসরতার কারণ হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও ধারণ না করা। মুসলমানদের ধর্ম যেমন আবশ্যক, তেমনি আবশ্যক হলো পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা। দেশকে উন্নতির পথে নিতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা অত্যাবশ্যক। এটি ছিল তার হৃদয় নিংড়ানো অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা। তিনি শুধু কথা বলার রাজনীতি না করে বাস্তব ও প্রায়োগিক রাজনীতি করেন ও তার সুফল জনগণকে উপহার দেন। সেকারণে দেশের মানুষ তাকে ভুলতে পারেনি।
অবশ্য নাজিব ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত নানারকম প্রতিশ্রæতি দেন। পুনরায় নির্বাচিত হলে কালাকানুন বাতিল করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবেন। গণবিরোধী কর ও টোল তোলা বন্ধ করবেন ও ছাত্রঋণ পুনরায় চালু করবেন এবং দুর্নীতি রোধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। তিনি অবশ্য বিনিয়োগ তহবিলের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে জনগণ স্বচক্ষে দেখা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও দুঃশাসন ভুলতে পারেনি। তাই প্রবল ক্ষমতাধর নাজিবকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে মাহাথির মোহাম্মদকে আবার ক্ষমতায় মসনদে বসিয়েছে। পরীক্ষিত নেতার হাতে দেশের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ করে জনগণ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহাথিরের জোটের অঙ্গীকার ছিল তারা ক্ষমতায় গেলে বিরোধীদের দমন-পীড়নের সংস্কৃতি বন্ধ করবেন। মাহাথিরের পরিকল্পনা ছিল মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে যেসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, সেসব অস্বচ্ছ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী। তিনি এসব চুক্তি ও বিনিয়োগে স্বচ্ছতা আনার প্রতিশ্রæতি দেন। নাজিব রাজাক উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রচারণা চালিয়ে সফলতা পাননি। কারণ দেশের জনগণ বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। চীনা বিনিয়োগে দেশ লাভবান না হওয়ায় মানুষের রাগ-ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। দেশে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি জনমনে অস্বস্তি ও অসন্তোষ এনে দিয়েছিল।
মালয়েশিয়া পশ্চিমা অর্থনৈতিক শক্তির সাথে টেক্কা দেবার মতো একটি দেশ। কিন্তু নাজিব রাজাকের দমন-পীড়ন, ক্ষমতা লিপ্সা ও ধনলিপ্সা দেশটির যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। উদার গণতন্ত্রের বদলে তিনি সীমিত ও কন্ট্রোলড ডেমোক্রেসি প্রবর্তন করেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করতে কালা প্রণয়ন করেন। সরকারের বিরোধিতা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তার দুর্নীতি দুঃশাসনে মানুষ এতটাই বিতৃষ্ণ ও ক্ষুব্ধ ছিল যে, সকল রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেও মাহাথিরের বিজয়কে ঠেকানো যায়নি। নির্বাচনী প্রচারণা ৩০ দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যা আদালতের নির্দেশনায় উঠে যায়। অর্থাৎ নির্বাচনী প্রচারণা, বিরোধীদের দমন-পীড়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিতকরণ কোন কিছুই নাজিব রাজাকের ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন পূরণে কাজে লাগেনি। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার নানা কৌশল অবলম্বন করেও কোন লাভ হয়নি। জনগণ সকল রকম প্রতিরোধের জাল ছিন্ন করে ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদকে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রিত্ব দান করেছে। এত বেশি বয়সে তিনি দেশ চালাতে সক্ষম হবেন না জেনেও জনগণ কিন্তু তার প্রতি আস্থা রেখেছে। তিনি নিজেও এ বিষয়টি অবগত। তাইতো তিনি দু’বছরের বেশি ক্ষমতা ধরে রাখবেন না বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। তিনি দেশকে আবার স¦স্থানে ফিরিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নির্বাচনে পরাজিত হবার সংশয় ও আশংকা ছিল পুরোমাত্রায়। স্বৈরাচারী কৃর্তত্ববাদী সরকারের অপচেষ্টা ও অপকৌশল মাহাথিরের জানা ছিল। বিশেষ করে কালা আইনের অপপ্রয়োগ জেনেও তিনি জোটের শরীকদের প্রস্তাবে রাজী হয়ে জোট গঠন করেন। জনগণের উপর তার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা ৯২ বছর বয়সে তাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছিল। এ বিজয় তার নীতি ও আদর্শের বিজয়। মাহাথির মুসলিম নেতা হিসেবে ইসলামকে প্রাধান্য দিয়ে ধর্ম শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন। এতে পশ্চিমা বিশ্ব তাকে মৌলবাদী বা অন্য যেকোন নামে সমালোচনা করুক না কেন, তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোন কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। তিনি কর্ম করেছেন যুক্তির নিরিখে, কর্তব্য পালন করেছেন মানুষকে সামনে রেখে, শাসিত হয়েছেন বিবেকের শাসনে। কোনরকম সমলোচনায় ভ্রুক্ষেপ না করে ঔচিত্যবোধকে চালিকা শক্তি করে তিনি অবলীলায় পথ চলেছেন ও মালয়েশিয়ার জন্য নানামুখি সংস্কারমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন করে অগ্রসর হয়েছেন। ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হয়নি। মুসলিমদের জন্য পরিবার প্রতি একজনকে হজ্জ পালনের সুযোগ দিয়ে তিনি কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়লেও পিছু হটেননি। তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও গন্তব্য ছিল মালয়বাসীদের সত্যিকার ভাগ্যোন্নয়ন। তিনি ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য নিরসনে কার্যকর ও বাস্তব পদক্ষেপ নেন। তিনি ৯৫ সালে নিজ দেশের বেকারত্ব লোপ করে অতিরিক্ত ৮ লক্ষ বিদেশি নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে বলে যত ঢাক ঢোল পেটানো হোক না কেন বাস্তবে অবস্থা ভিন্ন। শহরগুলো ও রাজধানীর রাস্তাঘাট ও বস্তির দিকে তাকালে বোঝা যায় দেশের মানুষের দুরবস্থা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সত্যিই বলেছেন- মেগা প্রজেক্ট, মেগা দুর্নীতি চলছে দেশে। সরকার দুর্নীতি বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে মানুষকে বোকা বানাতে পারবে না। কারণ নাজিব রাজাকও তার বিরুদ্ধে আনিত দুর্নীতির অভিযোগকে ভীত্তিহীন অপপ্রচার বলে চালানোর সকল রকম প্রচেষ্টা নিলেও সফল হননি। দেশের মানুষ নাজিব রাজাকের চালাকি, চাতুর্য ও অপপ্রচার অনুধাবন করে মাহাথির মোহাম্মদের মতো মেধাবী, বিচক্ষণ দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের প্রতি সম্মান ও সমর্থন জানিয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, বেগম জিয়ার মতো নিবেদিতপ্রাণ, দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের এ মুহুর্তে বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ দুর্নীতি, দুঃশাসন, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের উপর জুলুম-অত্যাচার, নির্যাতন নিপীড়ন, গুম, খুন, মামলা-হামলা ও ধরপাকড় যেভাবে চলছে তা অবর্ণনীয়। মালয়েশিয়ার চেয়ে অনেকগুণ বেশি খারাপ অবস্থা বাংলাদেশে বিরাজমান। ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের চিত্র বর্ণনা করে বিএনপি মহাসচিব কদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ব্যাংক থেকে ৯ বছরে আ.লীগ ২ লাখ কোটি টাকা লুট করেছে।’ তার বক্তব্য অতীব সত্য। সুশাসনের অভাব, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা না থাকা, দুর্নীতি, লুটপাট, নীতিহীনতা ও বিশৃংখলা ব্যাংকিং থাতকে নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। উন্নয়নের ঢাকঢোল জোরেশোরে পেটালেও বাস্তবে লুটপাটের মহোৎসব চলছে।
বেগম জিয়ার সততা নিয়ে যারা কটাক্ষ বিদ্রæপ করেন তাদেরকে অনুরোধ করব মনের আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলে, উত্তর পেয়ে যাবেন। তিন বারের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশে নিজ নামে বা ছেলেদের নামে কোন বাড়ি নাই। অথচ বর্তমানে দেশের নেতা, পাতি নেতা, মধ্যমসারির নেতা, আমলা ব্যবসায়ীদের বিদেশে বাড়ি কেনা ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডায় সেকেন্ড হোম-বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে। কিন্তু বেগম জিয়ার নামে বেনামে বিদেশে কোন বাড়ি নাই। অথচ দুর্নীতির দায়ে তাকেই জেল খানায় অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। মহান আল্লাহপাক, এই অবিচারের বিচার একদিন ঠিকই করবেন। নাজিব রাজাকও প্রবল ক্ষমতাধর ছিলেন। অচিরেই কারাবাস হবে বলে মনে হয়। ক্ষমতার দর্প ভালো নয়। সকলের বিবেকের শাসনে শাসিত হওয়া উচিত আমরা আশা করি বেগম জিয়া অচিরেই জামিনে মুক্ত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করবেন। তিনিই পারবেন রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি চলছে তার অবসান ঘটাতে। তার দিকেই তাকিয়ে আছে অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-বৈষম্যের শিকার এ দেশের সব মানুষ।
লেখক: প্রফেসর (অব.), দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



 

Show all comments
  • Mohammed Kowaj Ali khan ২১ মে, ২০১৮, ২:৩৭ এএম says : 0
    সম্ভব হইয়াছে সূস্ট নির্বাচন হওয়ায়। আমাদের বাংলাদেশে সুস্ট নির্বাচনের সূ্যোগ নাই, যেই দিন হইবে সেই দিন লাত্তিয়া জাতীয় বেঈমানদেরকে ক্ষমতা হইতে জাতি বিদায় করিবেন। ইনশাআল্লাহ। ************
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনে
আরও পড়ুন