Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নদীর ঢেউ রাজধানীতে

যানজটে নাগরিক জীবন নাকাল

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

উন্নয়নের নামে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি বাণিজ্য
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট নদী নয়; গতকাল রাজধানী ঢাকা শহর সত্যিই ছোট নদীর রুপ ধারণ করেছিল। ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় জমেছিল হাটু পানি। বাস চলার সময় সে পানির ঢেউ আছড়ে পড়েছে রাস্তার ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারে। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আবর্জনা। পরিকল্পিত পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা না থাকায় এই বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে রাজধানী ঢাকার এটা যেন হয়ে গেছে স্বাভাবিক চিত্র। বৃষ্টি হলেই নগরের নদীর পানি ঢেউ খেলে।
এক. আকাশ আগে থেকেই ছিল মেঘলা। সকালে শুরু হওয়া কোথাও ঝিরি ঝিরি কোথাও মাঝারি বৃষ্টি দুপুরে মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিকালেও রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ সড়ক থেকে পানি নেমে যায়নি। রাজপথে ছিল থৈথৈ পানি। মতিঝিল, আরামবাগ, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকার ও মিরপুরের একাদিক স্পটসহ বৃষ্টিতে বেশ কয়েকটি এলাকা যেন পরিণত হয় এক একটি ছোট ছোট নদীতে। কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও তারও চেয়ে বেশি পানি। যানবাহন চলতে গেলেই সৃষ্টি হয় ঢেউয়ের পর ঢেউ। রাস্তার খানাখন্দ এবং নিচু এলাকায় জমে থাকা বৃষ্টির পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হয় যানজটের সারি। চরম দুর্ভোগে পড়ে অফিস থেকে ঘরমুখী রোজাদার মানুষ। যানজটের কারণে ২০ মিনিটের দূরত্বের রাস্তা পার হতে সময় লেগেছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। বঙ্গভবনের দক্ষিণ গেইট, পল্লবী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, তালতলা, কাজীপাড়া, শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও, দারুস সালাম, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, ধানমন্ডি-২৭, হাজারীবাগ, কারওয়ানবাজার, শংকর, জিগাতলা, রায়েরবাজার, পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড ও শান্তিনগর, আরামবাগসহ অধিকাংশ এলাকায় দেখা গেছে প্রায় অভিন্ন চিত্র; পানি আর পানি। পানির ওপর গাড়ী ছুটছে। পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও ছেলেমেয়েরা হাটু পানিতে খেলা করছে। রোজা রেখে এসব এলাকায় যারা ঘর ছেড়ে অফিসে এবং কাজে বাইরে বের হয়েছেন; তাদেরকে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়কটি হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের কবিতার ‘ছোট খাটো নদী’। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও পানি নিষ্কাষণ না হওয়ায় পুরোসড়কে হাঁটু থেকে কোমর পরিমাণ পানি জমে যায়। পানিতে ডুবে থাকা সড়কের মধ্য দিয়ে যখন যানবাহন চলে তখন সড়কজুড়ে সৃষ্টি হয় ঢেউ। যেন রাজধানীর ভিতরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার আষাঢ়ী ঢেউ। পানির মধ্যে চলতে গিয়ে বেশ কিছু প্রাইভেট কার, সিএনজি ও মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। অনেককে গাড়ী ঠেলে নিয়ে যেতেও দেখা যায়। এ দৃশ্য যেমন নাগরিকের জন্য কষ্টকর তেমনি মর্মান্তিক।
দুই. ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে, গাড়ি চলে না/ চড়িয়া মানব গাড়ি যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি/ মধ্য পথে ঠেকলো গাড়ি উপায়-বুদ্ধি মেলে না’। বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিম এই গানের পরতে পরতে যেন রাজধানী ঢাকা শহরের চালচিত্র তুলে ধরেছেন। গতকাল বৃষ্টির পর ঢাকায় অনেক এলাকায় হাটুপানি ঠেলে গাড়ী চলতে দেখা গেছে। শুধু বৃষ্টির দিন নয়; স্বাভাবিক সময়েও বাসে-সিএনজিতে উঠলে কত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাবেন কেউ জানেন না। ট্রেনের সময়সুচি নিয়ে হাস্যরসের প্রবাদ ‘স্যার ৯ টার গাড়ী কয়টায় যায়’ অবস্থার মতো এখন ঢাকায় অবস্থা। রাজধানীতে যানজট অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। গুলিস্তান থেকে গুলশান এক ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে কত ঘন্টা লাগে কেউ আন্দাজ করতে পারেন না। তার ওপর খানাখন্দ সড়কে সামান্য বৃষ্টি হতেই পানি জমে যায়। রাজধানী ঢাকা ক্রমেই নাগরিকদের জন্য অসহনীয় দূর্বিসহ নগরীতে পরিণত হচ্ছে।
তিন. বিশ্বে এক সময় ঢাকার পরিচিতি ছিল মসজিদের শহর হিসেবে। সেই ঢাকা এখন খানাখন্দ আর যানজটের শহর। সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়ক হয়ে যায় নর্দমা। খানাখন্দ ডুবে যায় সড়ক। পুরান ঢাকার বাংলাবাজার থেকে শুরু করে অভিজাত পল্লীখ্যাত গুলশান, বনানী, বারীধারায় একই চিত্র। বৃষ্টি হলেই এখানে সেখানে জমে যায় পানি। সে পানি স্যুয়ারেজ ও ময়লা-আবর্জনা মিশে চলার পথ হয়ে যায় একাকার। দুর্বিসহ এবং যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে নিত্য চলতে হয় নাগরিকদের। দয়াগঞ্জের বস্তির নি¤œ আয়ের কুলি-রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে বারীধারার অভিজাত নাগরিক সবার একই পরিণতি। যন্ত্রণা যেন একাকার হয়ে গেছে সবার জীবন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই অংশের মেয়র, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি, আমলারা প্রায়ই টিভি ক্যামেরার সামনে নাগরিক দুর্ভোগ কমানোর ঘোষণা দেন। ঢাকাকে তিলোত্তমা করতে কার্যকর পদক্ষেপের গল্প শোনান। পানিবদ্ধতা দূরকরণ, ড্রেন ও ম্যানহোল পরিস্কার, পানি নিষ্কাষণ, নগরীর সরকারি ডোবা-নালা উদ্ধার নানা গল্প শোনান। মশা তাড়ানোর জন্য কামাল দাগানোর কাহিনী অবিস্কার করেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ড্রেনে গাপ্পী মাছ ছেড়ে দেন। মশা, যানজট কোনোটাতেই নাগরিক দুর্ভোগ কমছে না বরং বাড়ছেই। শুষ্ক মৌসুমে নগরীতে উন্নয়ন কাজ এবং খোঁড়াখুড়ি কম দেখা যায়। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে নর্দমা-ড্রেন পরিস্কার, খোঁড়াখুড়ির হিড়িক পড়ে যায়। এবার এই খোঁড়াখুড়ি হয়েছে দুই সিটির অধিকাংশ সড়কে। এতে যন্ত্রণা আরো মারাত্মক আকাশ ধারণ করেছে। রোজা শুরুর দিন থেকেই রাজধানী ঢাকা যেন স্থবির হয়ে পড়েছে।
রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক নগরী গড়ে তোলার রুপকথার গল্প শোনান মন্ত্রী-মেয়র। ক’দিন আগেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন, ‘শিগগিরই নগরীর পানিবদ্ধতা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা হবে।’ উল্টো পানিবদ্ধতা আরও বেড়েছে। জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে সচিবালয়ে (২৬ জুলাই ২০১৭) স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে ঢাকায় আর পানিবদ্ধতা দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’ বাস্তবতা উল্টো। সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর বেশির ভাগ রাস্তা ডুবে যায়। যা যানজটের সৃষ্টি করে এবং মানুষকে ফেলে দেয় দুর্বিসহ ভোগান্তিতে। এর আগে ঢাকার দুই মেয়র ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানরা এক বছর সময় চেয়ে নগরবাসীকে পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। সেই দুই বছর সময় আর শেষ হয় না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা মিলে ড্রেন ও খাল পরিষ্কার করার কাজে অর্থ ব্যয় করলেও সুফল মেলেনি বলে মনে করেন নগর ও পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা। নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনের উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালের জুনে ১১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে একটি জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন কিনে আনে ডিএসসিসি। বলা হয় যন্ত্রটি নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন লাইনে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা টেনে নিয়ে পানি আলাদা করে ড্রেনে ছেড়ে দেবে। কিন্তু সফলতা দেখা যায়নি। তবে শহরের কিছু এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনের জন্য ৪০০ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে।
চার. নগরে যানজট! বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলেছে শুধু রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যা জাতীয় বাজেটের ১১ ভাগের এক ভাগ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলছেন, নগরের যানজট যদি ৬০ শতাংশ কমানো যায় তবে ২২ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যাবে। ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে; যেখানে পায়ে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ঢাকা শহরে গণপরিবহনগুলো প্রতিদিন ৩৬ লাখ ট্রিপে ৩৫ শতাংশ যাত্রীকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যায়। বুয়েটের এই অনুসন্ধানী গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকা শহরের যানজটের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
রাজধানীর নাগরিকদের সামান্য বৃষ্টি হলেই আর কতদিন রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট নদী’ যানজটে শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ী চলে না চলে না চলে না রে’ দুর্ভোগ পোহাতে হবে?



 

Show all comments
  • Kamal ২৪ মে, ২০১৮, ১:১৪ এএম says : 0
    Good news
    Total Reply(0) Reply
  • আরাফাত ২৪ মে, ২০১৮, ২:৫২ এএম says : 0
    আসলে সিটি করপোরেশনের কাজটা কী সেটাই আমার বুঝে আসে না
    Total Reply(0) Reply
  • অমিত কুমার ২৪ মে, ২০১৮, ২:৫৩ এএম says : 0
    দিনে দিনে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে
    Total Reply(0) Reply
  • ইসমাইল ২৪ মে, ২০১৮, ২:৫৩ এএম says : 0
    খালি মেয়র সাহেবের ভাষণই শুনি। কোন কাজ তো দেখতে পাচ্ছি না
    Total Reply(0) Reply
  • কামাল ২৪ মে, ২০১৮, ২:৫৪ এএম says : 0
    মনে হচ্ছে এই পানিতেই আমাদেরকে ডুবে মরতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • নাবিলা ২৪ মে, ২০১৮, ২:৫৫ এএম says : 0
    এই নিউজ কী মন্ত্রীরা দেখেন না ? তারা বলেন, ঢাকাতে নাকি ৩ ঘন্টার বেশি পানি কোথাও জমা থাকে না।
    Total Reply(0) Reply
  • ash ২৪ মে, ২০১৮, ৫:০৭ এএম says : 0
    BANGLADESH KHUB SHIGRO NAKI MODDOM AYER DESHE POWCHACHE !!! HORE KIRISHNO HORE RUMMMM
    Total Reply(0) Reply
  • md salam ২৪ মে, ২০১৮, ১২:৫২ পিএম says : 0
    জয় বাংলা নৌকা সামলা
    Total Reply(0) Reply
  • গনতন্ত্র ২৪ মে, ২০১৮, ১২:৫৩ পিএম says : 0
    এটা নদীর ঢেউ নয়, উন্নয়নের ঢেউ।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Shah Alam Khan ২৪ মে, ২০১৮, ১২:৫৪ পিএম says : 0
    উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ। কেউ যেন নৌকা ভুলে না যায় সে জন্য এই ব্যবস্থা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যানজট

১৯ জানুয়ারি, ২০২৩
৯ জানুয়ারি, ২০২৩
১৯ ডিসেম্বর, ২০২২
২৭ নভেম্বর, ২০২২
২৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ