Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নজরুল : আমাদের জাতিসত্ত্বার উদ্বোধনে যার অবদান অবিস্মরণীয়

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের ছেলেবেলা কেটেছে নিদারুণ দারিদ্র্য ও দুঃখ কষ্টের মধ্যে। বাপ-মা তাই নাম দিয়েছিলেন দুখু মিঞা। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন বেপরোয়া, বেহিসেবী, প্রাণখোলা। কখনও যাত্রাদল, কখনও লেটোর দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। কাছ থেকে দেখেছেন দরিদ্র-অবহেলিত মানুষের জলছবি। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না তার অনুভূতির তন্ত্রীতে এক স্থায়ী অনুরণ সৃষ্টি করেছিল। দারিদ্র্যের কষাঘাতে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পাঠ শেষ না করে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সামরিক বাহিনীতে। তখন চতুর্দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ঊনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক হিসেবে করাচি সেনানিবাসে কাজে যোগ দেন। সৈনিক জীবন সদ্যযুবা নজরুলকে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্দীপ্ত করে। সৈনিকবৃত্তি তাঁকে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্বেল করে। পল্টনে থাকাকালীন তাঁর কানে রুশ বিপ্লবের বার্তা এসে পৌঁছায়। রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার মানুষের সংগ্রাম, সংঘর্ষ ও সমাজ পরিবর্তনের খবর তিনি জানতে পারেন। এই খবরগুলি তাঁর মনকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করে। সৈনিক জীবন তার বিশ্বচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে।
পল্টনে থাকার সময় থেকেই নজরুল কাজের অবসরে সাহিত্য চর্চা করতেন। সে সময়ও কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে তাকে নিয়ে আলোচনা সচল ছিল। নজরুলের যে কবিতাটি প্রথম পত্রিকায় ছাপানো হয় সেটির নাম ‘মুক্তি’। কবিতাটি ছাপানো হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়। রুশ বিপ্লবে সর্বহারার রাষ্ট্র গঠনের সংবাদে নজরুলের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় এই ভাষায়Ñ ‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।’ তাঁর ‘মুক্তি’ কবিতায় ফকিরের মুক্তির মতোই সর্বহারা বিপ্লবের উজ্জ্বল শিখায় সব বাঁধন বা আগল খসে পড়ে। মুক্ত চেতনায় ভাস্বর কবির হাত ধরল কলম, কণ্ঠ ধরল গান, হৃদয় উজাড় করে বেরোতে থাকল যা কিছু সম্পদ। ১৯১৮ সালে নজরুল তাঁর মুক্তি কবিতাটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র দফতরে পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই সমিতির ও সাহিত্য পত্রিকার সংগঠক ও লেখক মুজফফর আহমদের সঙ্গে তার পত্রালাপ শুরু হয়। ক্রমে এই পত্রালাপ পরিণত হয় গাঢ় বন্ধুত্বে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে বন্ধু মুজফফরের পরামর্শেই নজরুল তাঁর সৈনিক বৃত্তি ত্যাগ করে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় এসে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র দফতরে মুজফফর আহমদের সঙ্গে একত্রে বসবাস শুরু করেন। সাহিত্যকর্মকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন। বন্ধু মুজফফরসহ অন্যান্য বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষী নজরুলের মধ্যে বিরাট সাহিত্যিক সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিলেন। মূলত সেই বন্ধুদের প্রেরণা ও উৎসাহেই নজরুলের সাহিত্যসাধনা প্রাণ পেল। পরিণামে বাংলা সাহিত্য লাভ করে ফৌজি নজরুল থেকে বিবর্তিত ক্ষুরধার লেখনীসম্পন্ন শ্রেণি চেতনায় শানিত বিদ্রোহী কবি ও সাহিত্যিক নজরুল ইসলামকে। নজরুলের দেশপ্রেমে ভরপুর হৃদয় মুজফফর আহমদের সান্নিধ্যে ও কর্মপ্রেরণায় শোষিত-নিপীড়িত মানুষের স্বার্থবাহী শ্র্রেণিচেতনা তথা সাম্যবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সেই চিন্তা ও চেতনার আগুন-ক্ষরা প্রকাশ ঘটে সাংবাদিক, কবি ও প্রবন্ধকার নজরুলের লেখায়- তাঁর উদ্যোগে ও অংশগ্রহণে প্রকাশিত ও পরিচালিত ‘নবযুগ’ ‘ধূমকেতু’ ‘লাঙল’ ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায়।
‘নবযুগ’ পত্রিকায় নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। এর আগে তিনি কোনোদিন কোন কাগজের অফিসের চৌকাঠ পর্যন্ত মাড়াননি। অথচ সাংবাদিকতার উন্নত মান স্পর্শ করেছিল ‘নবযুগ’ মূলত নজরুলের সম্পাদনা ও লেখনীর জোরে। সম্পাদকীয় রচনা, শিরোনাম নির্বাচন, সংবাদ ভাষ্য রচনায় নজরুলের কলম অনবদ্য সার্থকতা লাভ করে। খিলাফত আন্দোলনের সময় ভারত থেকে বহু মুসলমান ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ স্বেচ্ছানির্বাসনে যান আফগানিস্তানে। এদের বলা হতো মুহাজির বা নির্বাসিত। এই নিরীহ মুহাজিরদের ওপর ব্রিটিশ সৈন্য অকথ্য অত্যাচার করে- নিহত হন বহু মুহাজির। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে নজরুল নবযুগে জোরালো সম্পাদকীয় লেখেন- ‘মুহাজির হত্যার জন্য দায়ী কে।’ সংবাদের শিরোনাম রচনাতেও নজরুলের বিশেষত্ব উল্লেখযোগ্য। ইরাকের বাদশাহ ফয়সলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সংবাদের শিরোনাম লেখেন রবীন্দ্রনাথের গানের কলি ব্যবহার করেÑ ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরাণসখা ফয়সল হে আমার।’ নবযুগে লেখা নজরুলের অসাধারণ একুশটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পরে ‘যুগবাণী’ নামে বইয়ের আকারে ছাপা হয়। জনমনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘নবযুগ’ সা¤্রাজ্যবাদী শাসকদের ভাবিয়ে তুলেছিল। তাই রাজরোষে ‘নবযুগ’ বন্ধ হয়ে যায়।
নজরুলের ইতিহাস সৃষ্টিকারী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। কবিতাটি বাংলা কাব্যসাহিত্যে এক অসাধারণ সৃষ্টি। কবিতাটি বাংলার বিপ্লববাদীদের ঘোষণাপত্রের ভূমিকা পালন করেছে, সব রকম ভীরুতা দীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সাহসের ও স্পর্ধার সাথে এগিয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়েছে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের সপ্নভঙ্গ’ এই দুই কবিতা সেই যুগে বিপ্লবীদের এগিয়ে চলার পথের পাথেয় ছিল। এরপরের অধ্যায় আরো সংহত চেতনা ও রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাগজ প্রকাশের প্রচেষ্টা। সেই রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো দেশের মজুর-কৃষক আপনার জনতার মুক্তির প্রয়োজনে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের সচেতন ও সংগ্রামমুখী করে তোলা।
তৎকালীন বাংলাদেশে শ্রমিক-কৃষকের জীবন যন্ত্রণাকে চিত্রিত করে স্বাধীনতার চেতনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন রকম পত্র-পত্রিকার মতো ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাও ছাপা হতো ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির দফতর থেকে। পত্রিকা প্রকাশের আড়াই মাসের মাথায় ১৯২২ সালের ৬ নভেম্বর হঠাৎ সেই দফতরে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম এবং মুদ্রক-প্রকাশক মুহাম্মদ আফজালুল হকের বিরুদ্ধে। মুদ্রক-প্রকাশক সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার হন। নজরুল তখন এক বিশেষ কাজে গিয়েছিলেন বিহারের সমস্তিপুর। পরে সেখান থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি চলে যান পূর্ববঙ্গে। অবশেষে পুলিশ তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে তাঁকে হুগলি জেলে রাখা হয়। কিন্তু স্বভাব-বিদ্রোহী দামাল নজরুলকে দমানো সহজ নয়। রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির দাবিতে ও জেলের ভেতরের নানা অব্যবস্থার প্রতিবাদে নজরুল অনশন শুরু করেন। এই অনশনের খবরে সারাদেশ সচকিত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ কবিকে তারবার্তা পাঠিয়ে অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। ‘অনশন ত্যাগ করোÑ আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়। কবির অনুরোধ ও মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে অবশেষে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। সরকারও বন্দিদের দাবি মেনে নেয়। দশমাস বন্দি জীবন যাপনের পর নজরুল জেল থেকে ছাড়া পান।
জেল থেকে বেরিয়ে নজরুল নতুন উদ্যমে রাজনৈতিক কাজ ও কবিতা রচনাসহ লেখালেখির কাজে নিয়োজিত হন। শুরু হয় আরেক অধ্যায়। সেই মুহূর্তে নিজের উদ্যোগে কোনো পত্রিকা প্রকাশ না করলেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চলতে থাকে লেখালেখি। অবশেষে ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুজফফ্র আহমদ লেবার পার্টির মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তৎকালীন বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক সংগঠকরা মিলে গড়ে তোলেন জাতীয় কংগ্রেসের ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ বা শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল। ‘লাঙল’-এর প্রধান পরিচালক হন নজরুল এবং সম্পাদক ছিলেন মনিভূষণ মুখোপাধ্যায়। প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল লেখেন ‘সাম্যের গান’Ñ ‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ গাহি সাম্যের গান।’
নজরুল তাঁর রচিত ‘ব্যথার দান’ গল্পে বাংলা সাহিত্যে প্রথম লালফৌজকে উপস্থাপন করেছেন। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে রুশ বিপ্লব সংগঠিত হবার পরে পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ভিতরের প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী বাহিনীকে সাহায্য করতে থাকে বিপ্লবকে পরাজিত করার জন্যে। সে সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণির অগ্রগামী সদস্যরা বিপ্লবকে রক্ষা করতে শ্রমিকশ্রেণির আর্ন্তজাতিকতা বোধ থেকে লালফৌজে যোগ দিয়েছিলেন। একদল ভারতীয় মধ্যএশিয়া লালফৌজের নেতৃত্বে সংগ্রাম করেছিলেন। মেহনতি মানুষের মুখপত্র হিসাবে ‘লাঙ্গল’ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ‘লাঙল’ কথাটি কৃষকদের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত, সেজন্য মুজফ্ফর আহমদ এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে ঠিক করলেন ‘লাঙল’ নামটি পরিবর্তন করা হবে। ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে ‘লাঙল’ পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে ‘গণবাণী ’ করা হয়। গণবাণীর সম্পাদক নির্বাচিত হন মুজফ্ফর আহমদ। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদলের মুখপত্র হিসেবেই ‘গণবাণীর’ আত্মপ্রকাশ ঘটে। ‘লাঙল’ গণবাণীর সাথে একীভূত হয়ে যায়।
বিশ্ব ইতিহাসে সাম্যবাদী আন্দোলনের ধারা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই এবং নিজেকে তাঁর সমসাময়িক কালের প্রগতিশীল রাজনৈতক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তাই সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও শ্রমিক শোষণের ধনবাদী নীতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল নজরুলের আপসহীন মনোভাব।
নজরুলের সাম্যবাদী চেতনাপূর্ণ বৈজ্ঞানিক না-হলেও মানব ইতিহাসে বৈপ্লবিক বিকাশ সম্পর্কে জাগ্রত ছিল। তিনি যেমন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কমিউনিস্ট ইস্তাহার পাঠ করেছেন, পরে আব্দুল হালিমের সাথে তা একত্রে অনুবাদেরও প্রয়াস নিয়েছিলেন, পাঠ করেছিলেন ক্যাপিটাল, ইবসেন, এমিল জোলা, লেনিন, বারটান্ড রাসেলের বলশেভিজম ইন রাশিয়া, আবার একই সঙ্গে পাঠ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা শক্তি সংগ্রহ করেছে ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের ঐতিহ্য এবং শেলি, হুইটম্যান, গোর্কির সাহিত্য থেকে। স্বাধীনতা প্রীতি ও জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আবেগের সমন্বয়েই নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা পরিপূর্ণতা লাভ করে। দেশের ভেতরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম প্রচেষ্টায় মুজফ্ফর আহমদের শরীক ছিলেন নজরুল। তাঁর পরিচালনায় প্রকাশিত ‘লাঙল’ পত্রিকাতে প্রথম বাংলায় ‘মার্কসের শিক্ষা, লেনিনের কথা, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বার্তা প্রচারিত হয়। কৃষ্ণনগরে কৃষক শ্রমিক দলের সম্মেলনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ গানটি রচনা করেন তিনি। যে সম্মেলনকে গোয়েন্দা রিপোর্টে কমিইউনিস্ট পার্টির ছদ্ম সম্মেলন বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই দিকগুলোর পাশাপাশি এটাও বলা যায় যে অসহযোগ আন্দোলনের বন্যায় তিনি ভেসে গিয়েছিলেন। তার জন্য কারাবরণও করতে হয়েছিল তাকে। এইখানেই নজরুলের স্বকীয়তা। আবার অসহযোগ আন্দোলনজনিত অভিজ্ঞতাও তিনি সচকিত হয়ে ব্যক্ত করেছেন। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ তার প্রমাণ।
কবির অতি প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয় বসন্তরোগে। মাত্র চার বছর বয়সে। এই সালে রুবাইয়া-ই হাফিজ গ্রন্থটির অনুবাদ পত্রে পিতার আর্জি ছিল, ‘বাবা বুলবুল’। তোমার মৃত্যুশিয়রে বসে ‘বুলবুল-ই-সিরাজ’ হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ শুরু করি, যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ, যে দেশে গেছ তুমি, সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও সুন্দর?
১৯৪১ সালের এপ্রিলে তাঁর চেতনা লোপজনিত অসুস্থতা প্রকাশ পাবার কয়েকমাস আগে কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজতজয়ন্তি উৎসবে সভাপতি রূপে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শীর্ষক জীবনের শেষ অভিভাষণ পাঠ করতে গিয়ে কবি তাঁর জীবনের লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন এই ভাষায়Ñ ‘হিন্দু-মুসলমানের দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে এদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাবÑ অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছেÑ এই অসাম্য এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্য, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করছিলাম।
কবির জীবনধারা দেখে বিস্মিত হতে হয়। অফুরন্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অফুরন্ত সৃষ্টি কীভাবে সম্ভব হলো ভাবি। যাই হোক, ১৯৬৯ সাথে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। আবার ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ২৫ মে দেশব্যাপী বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় কবির ৭৩তম জন্মজয়ন্তি পালন করা হয়। নিশ্চয়ই কবির দুঃখ-কষ্টের সার্থকতা এখানে। বাংলাদেশ সরকার কবিকে ঢাকায় এনে শুধু জন্মজয়ন্তি পালন করেনি, কবিকে রাজকীয় সম্মান দেয়। কবির সুখ-শান্তির জন্য বাড়ি-গাড়ি-ডাক্তার নার্স সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। এরপর ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ২১ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘২১শে স্বর্ণপদক’ প্রদান করে সম্মান জানানো হয়। মধ্য ’৭৫ থেকেই কবির শরীর ভালো যাচ্ছিল না। সে সময় তাকে চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পিজি হাসপাতালেই ছিলেন। ওইদিন সকাল ১০টা ১০ মিনিটে তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সমবেত হয় রমনার সবুজ চত্বরে প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আমলা সোনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী, কবি-সাহিত্যিক এবং লাখো লোকের উপস্থিতিতে রমনার সবুজ প্রান্তরে নামাযে জানাজা সম্পন্ন হয়। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাহিত করা হলো কবিকে। মরদেহ কবরে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কালেমা শাহাদাত। পতাকা অর্ধনমিত হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নজরুল

২৯ আগস্ট, ২০২২
২৬ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন