Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সউদী থেকে নির্যাতিত নারী কর্মীরা দফায় দফায় ফিরছে

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২৯ পিএম, ২৬ মে, ২০১৮

সউদী আরব থেকে নানাভাবে নির্যাতিত নারী কর্মীরা দফায় দফায় খালি হাতে দেশে ফিরছে। গত জানুয়ারী থেকে ২৫ মে পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে সউদী আরব থেকে প্রায় দেড় ১ হাজার নারী কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে। সউদী আরবের কয়েকটি সেইফ হোম ও সউদী ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার আরো কয়েকশ’ নারী কর্মী দেশে ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে। সউদী প্রত্যাগত মানুষিক ভারসাম্যহীন কলারোয়ার মমতাজ বেগমকে গতকাল আগারগাঁওস্থ জাতীয় মানুষিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট-এ ভর্তি করা হয়েছে। গত ২৫ মে ভোরে সউদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফাইট যোগে মমতাজ খালি পায়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছে। বিমান বন্দরে মহিলা পুলিশরা মমতাজকে সহায়তার জন্য এগিয়ে গেলে তাদেরকে সে তাড়া করে। কর্তব্যরত একজন চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ধরে এ্যাম্বুলেন্স যোগে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টস্থ সামরিক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে মানুষিক ভারসাম্যহীন মমতাজকে জাতীয় মানুষিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শিরা এতথ্য জানিয়েছে। সউদী আরবে বিভিন্ন নিয়োগকর্তার কর্মস্থলে নিরাপত্তার অভাবে বিপুল সংখ্যক নারী কর্মী পালিয়ে দূতাবাসের সেইফ হোমে ও সউদী সফর জেলে আশ্রয় নিচ্ছে। সউদী নিয়োগকর্তারা এসব নারী কর্মীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা পরিশোধ এবং প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করেনি বলে অভিযোগ উঠছে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের আর্থিক সহায়তায় নির্যাতনের শিকার নারী কর্মীরা সউদী আরব থেকে দেশে ফিরছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্র্তৃপক্ষ সেইফ হোমে আশ্রিত নারী কর্মীদের দেখভাল করতে এবং দেশে ফেরত পাঠাতে হিমসিম খাচ্ছে। সউদীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোমে ও সউদী ইমিগ্রেশন জেলে আশ্রিত নারী কর্মীদের অনেকেই নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ নারী কর্মীদের এসব সমস্যার বিষয় সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে একাধিক লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। সউদী নিয়োগকর্তারা কেউ কেউ দায় এড়াতে সেইফ হোমে আশ্রিত অভিবাসী নারী কর্মীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ ষ্টেশনে মামলা ও জিডি দায়ের করছেন।
বিএমই’িটর’ সূত্র জানায়, সউদী আরবে ১৯৯১ সাল থেকে গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮শ’ ৩১ জন নারী কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২ লাখ ২৬ হাজার ৬শ’ ৫৬ জন নারী কর্মী, জর্ডানে ১ লাখ ৩২ হাজার ৭শ ১৬ জন নারী কর্মী, লেবাননে ১ লাখ ৪ হাজার ৭শ’ ৫৯জন নারী কর্মী , ওমানে ৬৮ হাজার ২শ’ ৮৩ জন নারী কর্মী এবং কাতারে ২৭ হাজার ১শ’ ১৪ জন নারী কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। বিগত ২০১৫ সাল থেকে সউদী আরবে পুরোপুরি নারী কর্মী যাওয়া শুরু হয়। সউদীতে মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রত্যেক নারী কর্মী’র প্রসেসিং কমিশন বাবদ ১ হাজার মার্কিন ডলার করে পাচ্ছে। এতে মহিলা প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা আয় করছে।
গাইবান্ধার মমতাজ বেগম তিন মাসের বেতন রেখেই সে পালিয়ে রিয়াদস্থ বাংলাদেশী সেইফ হোমে আশ্রয় নেয়। গত ২০ এপ্রিল সে এয়ার এরাবিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট যোগে সউদী থেকে দেশে ফিরেছেন। একই ফ্লাইটে সর্বমোট ৩৩ জন নারী কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে খালি হাতে দেশে ফিরেছে। গত ৫ মার্চ নির্যাতনের শিকার ২৬ জন নারী কর্মী সউদী আরব থেকে দেশে ফিরেছে। বিএমইটি’র সূত্র জানায়, গত জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যন্ত সউদী আরবে ১ লাখ ৭ হাজার ৯শ’ ৩৫ জন নারী-পুরুষ কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। উল্লেখিত সময়ে এর মধ্যে ৩০ হাজার ১শ’ ২ জন নারী কর্মী সউদী আরবে গেছে। গত জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশটি থেকে প্রবাসী কর্মীরা ৬শ’৫৩ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে। গত ১৯ মে সউদী আরব থেকে ৮৩ জন এবং ২০ মে ২১ জন নারী কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে। বায়রার সাবেক যুগ্ন-মহাসচিব-১ আলহাজ আবুল বাশার গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে বলেন, সউদী আরবে মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণের বিষয়টি পুরোপুরি দালাল নির্ভর হওয়ায় কিছু কিছু নারী কর্মী দেশে ফিরছে। দালালরা মহিলা কর্মীদের শিখিয়ে দেয় সউদীতে যাওয়ার তিন মাস পর দেশে ফিরে আসতে। এর পর তারা সউদী ফেরত মহিলা কর্মীকে পুনরায় রিক্রুটিং এজেন্সি’র কাছ থেকে কমিশন পেয়ে দুবাই, কাতার জর্ডানে পাঠাচ্ছে। এছাড়া হোস সিকনেস-এর কারণেও কিছু কিছু মহিলা গৃহকর্মী সউদী থেকে ফিরছে বলে আবুল বাশার উল্লেখ করেন। এতে মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এবং সউদী নিয়োগকর্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশী মহিলা গৃহকর্মীর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তিনি বলেন, এ শ্রমবাজার ধরে রাখতে হলে দালাল চক্রের অপতৎপরতা বন্ধের লক্ষ্যে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবী জানান। তিনি মানবপাচার আইন-২০১২-এর কালো ধারা সংশোধন করে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে তাদের অধিকার রক্ষায় কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি প্রবাসী সচিব ড. নমিতা হালদার বলেছেন, সউদী থেকে মহিলা কর্মীরা দেশে ফিরে মিথ্যা কথা বলছে। সউদী আরবে যৌথ কারিগরি কমিটি’র মিটিংয়ে সউদীতে কর্মরত বাংলাদেশী নারী কর্মীদের সৃষ্ট সংকট নিরসনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সউদী কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।
ফিমেল ওয়ার্কার্স রিক্রুটিং এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর আহবায়ক আফতাব উদ্দিন চৌধুরী গতকাল বলেছেন, সউদী আরবে ৯০% মহিলা গৃহকর্মী ভালো আছে। ১০% মহিলা গৃহকর্মী হোম সিকনেসসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরছে বলেও তারা দাবী করেন। তিনি বলেন, সউদী আরবে কর্মীরত নারী গৃহকর্মীরা প্রচুর রেমিটেন্স আয় করছে। বিনা খরচে সউদী গিয়ে মহিলা গৃহকর্মীরা প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করছে। তিনি বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও মহিলা গৃহকর্মী পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রা আয় করছে। হোম সিকনেস এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় ১০% মহিলা গৃহকর্মী দেশে ফিরছে। সউদী থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার মহিলা গৃহকর্মীর সংখ্যা খুবই কম বলে তিনি উল্লেখ করেন। বায়রার একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, সরকারী হিসেবে গত তিন বছরে সউদী থেকে প্রায় ৪ হাজার মহিলা গৃহকর্মী দেশে ফিরেছে। আসলে হোম সিকনেস, স্বাস্থ্যগত কারণ, খাদ্যাভাস, শিক্ষিত না হওয়া এবং শারীরিক দক্ষতার অভাবে ১০% থেকে ১২% মহিলা গৃহকর্মী সউদী থেকে দেশে ফিরছে। এক প্রশ্নের তিনি বলেন, সউদীতে কিছু কিছু মহিলা গৃহকর্মী নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতনের বিষয়টি সব জায়গাতেই হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষত নারী কর্মী বিদেশে বেশি পাঠাতে পারলে রেমিটেন্স বাড়বে এবং নির্যাতনের সংখ্যাও হ্রাস পাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সউদী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ