Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জটিলতার ফাঁদে এলএনজি

‘এক্সিলেন্স’ জাহাজ এক মাসেরও বেশি দিন অলস নোঙরে : লোকসান দৈনিক ৪০ হাজার ডলার

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাগরের তলদেশে পাইপলাইনের ফুটো মেরামত কাজ ব্যাহত : জাতীয় গ্রিডলাইন নির্মাণও শেষ হয়নি : সার্বিক অব্যবস্থাপনায় এলএনজি সরবরাহ পিছিয়ে গেছে
ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ শুরু না হতেই দেখা দিয়েছে একের পর এক জটিলতা। সামগ্রিকভাবে সমন্বয়ের অভাব ও অব্যস্থাপনার কারণে পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহের তারিখ পিছিয়ে গেছে এ যাবত তিন দফায়। তবে কারিগরি বা যান্ত্রিক ত্রæটি কেটে গেলে আগামী জুন মাসের মধ্যে এলএনজি সরবরাহ শুরু হতে পারে এমনটি আশাবাদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ীর কাছে সাগরে অবস্থানরত এলএনজিবাহী জাহাজটি থেকে সমুদ্রের তলদেশে পাইপলাইনে ফুটো দেখা দেয়ায় খালাস ও সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সাগর উত্তাল থাকায় ফুটো মেরামত কাজ ব্যাহত হচ্ছে। দেশে সর্বপ্রথম এলএনজি হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা সূচনা করতে গিয়ে যেখানে পাইপ লাইনসহ প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতি নতুন সংযোজনের কথা সেখানে একাধিক ফুটো কিভাবে থাকে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়েও সঙ্গত কারণেই রয়েছে প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের সুরাহা না হলে জটিলতার ফাঁদেই আটকে থাকবে এলএনজি সরবরাহ এমনটি শঙ্কা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহলের।
তাছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারা-সীতাকুÐ অংশে জাতীয় গ্রীডলাইন পর্যন্ত নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি। এ অবস্থায় গত এক মাসেরও বেশিদিন ধরে সাগরে নোঙররত অবস্থায় অলস বসে আছে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯শ’ ঘনমিটার (৬০ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন) এলএনজিবাহী জাহাজ ‘এক্সিলেন্স’। বিশালাকায় এ জাহাজের পরিচালন (ফিক্সড অপারেটিং কস্ট) ব্যয় ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ দৈনিক ডেমারেজ বা লোকসান গুণতে হচ্ছে ৪০ হাজার ডলার (প্রায় ৩৩ লাখ টাকা)। পেট্রেবাংলা এলএনজির আমদানিকারক। ফলে সরকারকে এই লোকসান দিতে হচ্ছে। গত এক মাসেরও বেশি সময়ে ডেমারেজ বা লোকসানের অঙ্ক সাড়ে ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া এলএনজির পরবর্তী আমদানি চালান কবে আসবে তাও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি তীব্র। মাহে রমজানে গ্যাসের চাপ আরও কমে গিয়ে রান্না-বান্না, শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের দুর্ভোগ সীমাহীন। এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাসের সঙ্কট অনেকটা নিরসনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। অথচ এলএনজি আমদানির পরও সরবরাহে জটিলতার ফাঁদে সাগরে ভাসছে জাহাজ। কর্ণফুলী ও তিতাস গ্যাস কোম্পানি এবং তাদের গ্রাহকরা এলএনজি সরবরাহের দিকে দীর্ঘদিন তাকিয়ে থেকে এখন চরম হতাশ। সরকারও সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কবে এলএনজির গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
বিগত ২৪ এপ্রিল আমেরিকান জ্বালানি কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির ভাসমান টার্মিনালযুক্ত জাহাজ ‘এক্সিলেন্স’ মহেশখালীর অদূরে সমুদ্রে এসে পৌঁছায়। টার্মিনাল-জাহাজটি কাতার থেকে এলএনজির প্রথম চালান নিয়ে বাংলাদেশে আসে। এরপর প্রথম দফায় ২৫ বা ২৬ এপ্রিল, দ্বিতীয় দফায় ১০ মে এবং পরে ২৬ মে পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ গত শনিবার (২৬ মে) প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এলএনজি সরবরাহ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনেরও সম্ভাব্য তারিখও রাখা হয়। কিন্তু পাইপলাইনে ত্রæটি ও গ্রীড লাইন নির্মাণকাজ সম্পন্ন না হওয়ার কারণে এলএনজি সরবরাহ শুরু করতে পারেনি এক্সিলারেট এনার্জি। ‘আওতা বহির্ভূত কারণে’ দুই দফা পিছিয়ে যাওয়ার পর পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহের নতুন সময় নির্ধারণের কথা জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। পুনঃনির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী ৬ থেকে ১২ জুনের মধ্যে জাতীয় গ্রীডে এলএনজি যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে সাগরের তলদেশে পাইপলাইনের মেরামত এবং চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রীড লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার উপর। তাছাড়া মাতারবাড়ী সমুদ্রের টার্মিনাল পয়েন্ট থেকে আনোয়ারা হয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুÐে জাতীয় গ্রীড লাইনে যদি অন্য কোনো কারিগরি, যান্ত্রিক ত্রæটি বা জটিলতা দেখা দেয় তাহলে এলএনজি সরবরাহ আরও পিছিয়ে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, টার্মিনালযুক্ত এলএনজিবাহী ‘এক্সিলেন্স’ জাহাজ থেকে যে পাইপ লাইনটি সাগরের তলদেশের পাইপলাইনে যুক্ত হবে সেখানেই কারিগরি ত্রæটি ধরা পড়েছে। এ ক্ষেত্রে পাইপ লাইনের (সাব-সি) নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত এক্সিলারেট এনার্জির ডুবুরিরা প্রতিদিন কাজ করছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগর কিছুটা উত্তাল থাকায় ঠিকমতো কাজ করা যাচ্ছে না। ডুবুরিরা পানির নিচে দৈনিক ৩/৪ ঘণ্টা কাজ করেই বিশ্রামে যেতে হয়। তাদের দেয়া তথ্য মতে পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহ শুরু করতে সবমিলিয়ে আরও ১২ থেকে ১৮ দিনের মতো সময় লাগতে পারে। তবে ভিন্ন কোনো কারিগরি সমস্যা হলে আরও বেশিদিন সময় যাবে।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, মহেশখালী জিটিসিএল-এর স্টেশন (কক্সবাজার) থেকে ৯১ কিলোমিটার পাইপলাইন দিয়ে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা হয়ে এলএনজির সরবরাহ জাতীয় গ্যাস গ্রীডের সঙ্গে যোগ হবে। টার্মিনালটি দিয়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৪৬০ মিলিয়ন (৪৫ থেকে ৫০ কোটি) ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ১৫ বছরের চুক্তির আওতায় রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ নেবে এক্সিলারেট এনার্জি। সাগরে ভাসমান টার্মিনালের অবস্থান থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটারের সাব-সি পাইপলাইন দিয়ে এই গ্যাস জিটিসিএল-এর স্টেশনে যাবে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণ এবং সরবরাহ-পূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আগেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুÐ পর্যন্ত ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের আরও ৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। অথচ এখানেই পাইপলাইন জাতীয় গ্যাস-গ্রীডের সাথে যুক্ত হবে।
অপরদিকে গত ২৪ এপ্রিল আনীত এলএনজি ‘এক্সিলেন্স’ জাহাজটি থেকে সরবরাহ করতে গিয়ে সাগরের তলদেশে পাইপলাইনে ফুটো ধরা পড়ার কারণে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। এতে করে এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ এক মাস পিছিয়ে গেছে। পরীক্ষামূলক গ্যাস সরবরাহের সময়ই ত্রæটি ধরা পড়ে। ফুটো সারাতে পাইপ লাইনের অন্তত ১০টি পয়েন্টে ওয়েল্ডিং করতে হবে। এরজন্য এক্সিলারেট এনার্জির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য ওশেন আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছে দরপত্র চেয়েছে। আগামী ৪ জুন কাজ শুরু করে ২ সপ্তাহের মধ্যে শেষ করার শর্ত দেয়া হয়। দ্য ওশেন কর্মকর্তাদের তদারকিতে পাইপলাইন মেরামত কাজ শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিকমতো অগ্রসর হলে জুনের মাঝামাঝি অথবা শেষ দিকে মাতারবাড়ী টার্মিনাল থেকে এলএনজি গ্যাসের রূপান্তরিত সরবরাহ পাইপ লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করা যাবে।
এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশে গ্যাসের ব্যাপক ঘাটতি অনেকাংশে পুরণে সরকারের আশাবাদ সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে কার্যত ফিকে হতে চলেছে। মাতারবাড়ী টার্মিনালের রি-গ্যাসিফিকেশন অর্থাৎ এলএনজি থেকে গ্যাসে রূপান্তরের ক্ষমতা দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে দেশে দৈনিক ৩৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ২৬৫ থেকে ২৭৫ ঘনফুট গ্যাস মিলছে। চট্টগ্রামে ৫০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে মাত্র ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। এলএনজি থেকে রূপান্তরিত গ্যাসের অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ কোটি ঘনফুট চট্টগ্রামের ঘাটতি আংশিক পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষ জোগান দেবে। তবে দেশে গ্যাসক্ষেত্রের তুলনায় আমদানিকৃত এলএনজির মূল্য বেশি হওয়ায় গ্যাসের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া সার্বিকভাবে গ্যাসের বিরাট ঘাটতির তুলনায় এলএনজি থেকে রূপান্তরিত গ্যাসের সরবরাহ অনেক কম হওয়ার ফলে দেশে বিদ্যমান গ্যাস সঙ্কট আপাতত দূরীভূত হচ্ছে না।
বেলজিয়ামের পতাকাবাহী ‘এক্সিলেন্স’ জাহাজ এক লাখ ৩৬ হাজার ৯শ’ ঘনমিটার বা ৬০ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন এলএনজি নিয়ে গত ২৪ এপ্রিল মাতারবাড়ীর সমুদ্রে ভিড়ে। এরপর জাহাজের সাথে যুক্ত টার্মিনালে ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে খালাস ও পাইপলাইনে সরবরাহের প্রস্তুতি নেয়া হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসকে শীতলীকরণ (রেফ্রিজারেশন) প্রযুক্তির মাধ্যমে তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ১৬০ ডিগ্রি লেসিয়াসে নামিয়ে তরলে (এলএনজি) পরিণত করা হয়। ‘এক্সিলেন্স’ জাহাজটিতে এলএনজিকে সাগরের পানির উষ্ণতাকে কাজে লাগিয়ে আবার প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তর করা হবে। পরে পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রিডে যাবে। এদিকে কাতারের রাস-গ্যাস কোম্পানির সাথে পেট্রোবাংলার চুক্তি অনুসারে বার্ষিক ২৫ লাখ মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির প্রথম চালানের গ্যাস পাইপলাইনে সরবরাহ না হওয়ায় পরবর্তী চালান আটকে গেছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাহাজ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ