Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঈদ উৎসবে কাটছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী

দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) থেকে মো. রেজাউল করিম | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ক’দিন পরেই ঈদুল ফিতর। দিনটিকে কেন্দ্র করে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে মহোৎসব। আর এই আনন্দকে আরও আনন্দময় করতে সব বয়সের নারী পুরুষের চাই নতুন পোশাক। বিশেষ করে নারীদের চাই শাড়ি। টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি নারীদের দুর্বলতা বহুকাল আগের। নারীদের ঈদের সাজে সাজাতে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীতে পুরোমাস কাটছে ঈদ উৎসবে। শবে বরাতের পর থেকে বাড়তি কাজে চাপ পড়েছে তাঁতপল্লীতে। যেন এটা ঈদ আনন্দ। শাড়ী তৈরি থেকে বিক্রি পর্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পুরো তাঁতপল্লী। ঈদকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল শাড়িতে যোগ হয়েছে বাহারি রঙ আর নতুন কারুকাজ। ঈদের আগেই নিপুন হাতে ঈদের শাড়ি তৈরি শেষ করতে হবে। এ কারণেই মুলত তাঁতপল্লী এখন উৎসবমুখর আর তাঁতীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। টাঙ্গাইল সদরের বাজিদপুর, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডী, নলশোধা, ধুলটিয়া, কালিহাতীর বল্লা রামপুরের তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও টাঙ্গাইল শহর থেকে ৬ কিঃ মিঃ দক্ষিণে দেলদুয়ারের চন্ডী । গ্রামের সাথে ডাকঘরটি জুড়ে দিয়ে বলা হয় চন্ডী পাথরাইল। এটাই মুলত টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী। ভোর না হতেই এখানে শুরু হয় তাঁতের খটখটি শব্দ। রাতভর কাজ করেও তাঁতীর ক্লান্তি নেই। প্রতিযোগিতা একটাই, উৎপাদন যত বেশী হবে, সাপ্তাহিক বিল তত বেশী পাবে। সুতা রং করা থেকে শুরু করে শাড়ি বিক্রি করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই পরিবারের সব বয়সের মানুষ ব্যস্ত সময় পার করছেন। শাড়ি শব্দটি এসছে মুলত সংস্কৃত সাটি শব্দ থেকে। সাটি মানে পরিধিয় বস্ত্র। প্রাচনীকাল থেকেই সেলাইবিহীন এই পরিধিয় বস্ত্রের জনপ্রিয়তা শুধু বাংলাদেশে নয় পুরো উপমহাদেশে। রঙবাহারি, মাসলাইস কটন, কিটকট, মঞ্চুলি ডেঙ্গু, সিল্ক, হাফ সিল্ক, মিক্সট ও কটনসিল্কসহ নানা ধরনের শাড়ি বুনে টাঙ্গাইলের তাঁতীরা। তাঁতের সংখ্যা কমে গেলেও এখনও প্রায় চার হাজার তাঁত সচল রয়েছে এই তাঁতপল্লীতে। লোক ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতা মিলিয়ে শিল্পমনা তাঁতীরা নিত্যদিন গড়ছে বাহারি বিন্যাস। তাঁত শিল্পের প্রধান কাচামাল সুতা। নিজেদের মতো করে রাঙিয়ে নেই এই সুতা। তাঁতী বাড়িতে কাজ হয় ধাপে ধাপে। সুতা রাঙানোর কাজটা সারে সবার আগে। এবার রোদের তাপে সুঁতোকে শুকানোর পালা। তাঁতীরা একসময় নিজেরাই বানাতো সুতা। এখন মিলে বানানো সুঁতোই ব্যবহার করে ওরা। একেক ধরনের কাপড় বানাতে লাগে একেক ধরনের সুতা। এরপর শুকনো সুতাকে চরকায় কাটার পালা। দু একজন পুরুষ এ কাজে থাকলেও সুতো কাটায় কাজ মুলত নারীরার করে আসছে যুগযুগ ধরে। শতবছর আগে চরকা দিয়েই সুতা বানাতো তাঁতীরা। তবে এখন সুতা না বানালেও সুতা প্যাচানোর কাজে চরকা রয়েছে প্রতিটি তাঁতবাড়ীতে। এরপর সুতাকে কাপড়ের মতো লম্বা করে সাজিয়ে নেওয়া হয়। একে ওরা তানা বলে থাকে। একাজে ব্যস্ত থাকে ভিন্ন শিল্পী।একেকটি তানায় সাধাণত ২৫ থেকে ৩৫ টি শাড়ি একসাথে সাজানো হয়ে থাকে। এরপর নাতায় জড়ানো সুতা ব্যবহার করা হয় হস্তচালিত তাঁত যন্ত্রে। আরেক শ্রেণীর শিল্পীরা নাতায় পেচানো সুতোয় আড়াআড়ি সুতো সিটায় প্যাচানোর কাজে থাকে। শাড়ির নকশা অনুযায়ী কয়েক হাজার সুতো লম্বালম্বি সানা করা হয়। সব কিছু ঠিকঠাক মতো সাজানোর পর শুরু হয় কাপড় বুনানো। টাঙ্গাইল শাড়িতে কখনো নকশা করা হয় শাড়ি বুনানোর সময়, কখনও বা শাড়ি বানানোর পর রঙিন সুতো দিয়ে হাতে হাতে নকশা করে। এসব কাজ নিয়ে তাঁতীবাড়ির সব বয়সের সদস্যরাই ব্যস্ত । একসময় দেশীয় শিল্পিদের নিপুন হাতে তৈরি মসলিন কাপড় দেশ বিদেশী রমনীদের নজর কেড়েছিল। সময়ের বিবর্তনে পুরনো মসলিনের কথা আধুনিক নারীদের স্মৃতিতে ধারন না থাকলেও টাঙ্গালের তৈরি তাঁতের শাড়ি সেই মসলিনের মতই দেশ বিদেশী রমনীদের মনে স্থান করে নিয়েছে। উৎপাদন ও বাজার উভয়ই ভাল যাচ্ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে নেমেছে নতুন কারুকাজের শাড়ি। ভিন্ন বুটি আর নতুন নকশায় তৈরি এই শাড়ি শুধু ঈদ উৎসবের জন্য। দেশের সবচেয়ে বড় তাঁতের শাড়ির হাট টাঙ্গাইলের করটিয়া ঘুরে দেখা যায়, তাঁতিরা তাদের উৎপাদিত কাপড় নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। স্থানীয় ও দূর থেকে আসা অধিকাংশ ক্রেতাদের চাহিদা এখন ঈদের শাড়ি। মূল্যসীমা হাতের নাগালে রয়েছে সুতি শাড়ির। যার খুচরা মূল্য ৩ থেকে ৪শ’ টাকার মধ্য। এছাড়া সিল্ক, সপসিল্ক, রেশন ও দুতারের মধ্যেও রয়েছে উন্নতমানের টাঙ্গাইল শাড়ি। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা। টাঙ্গাইলের জামদানির রয়েছে বাড়তি আকর্ষণ। শাড়ি বিক্রেতা মীর জাকির হোসেন বলেন, বর্তমানে স্থানীয় ও বহিরাগত অধিকাংশ গ্রাহকের চাহিদাই ঈদের শাড়ি। বিক্রির পরিমানও বেড়েছে। তাঁতশিল্পি তাপস রাজবংশী বলেন, সামনে ঈদের কাপড় বানাতে ব্যস্ততা অনেকটাই বেড়েছে। নকশা তৈরিকারক আবুল হোসেন বলেন, ঈদের শাড়ি তৈরির জন্য নতুন নকশা তৈরি করতে হয়েছে। তবে নকশ প্রস্তুতকারকদের প্রথম পর্যায়ে ব্যস্ততা যায়। ঈদ আসলে ব্যস্ততা কমতে থাকে। টাঙ্গাইল শাড়ী ব্যবসায়ী খোকন বসাক জানান, উৎসবনুসারে টাঙ্গাইল শাড়ির কারুকাজ ভিন্ন হয়। ঈদকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইল শাড়িতে যোগ হয়েছে ৪০ শতাংশ ভিন্নধর্মী নকশা ও কারুকাজ। যা সহজেই নারীদের পছন্দনীয়। কিন্তু ইন্ডিয়ান শাড়ি অনুপ্রবেশের কারণে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারছিনা। তাঁতপল্লীতে ঈদের এক মাসে আমদানানী রপ্তানী ৫শ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ