Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাস্তা নির্মাণে নিউইয়র্কের চেয়েও বেশি ব্যয় বাংলাদেশে

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০১৮, ১০:১১ পিএম

করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা করার সুপারিশ
‘দেশের আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে তা যথেষ্ট সন্দেহজনক’ উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য জানিয়েছেন, কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশের আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। আমদানি ব্যয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার হতে পারে। আর তাই পণ্য আমদানিতে দেশের নিজস্ব নীতিমালা থাকা দরকার। একই সঙ্গে দেশের ব্যাংকিংখাত এবং পুঁজি বিপর্যয়কর পরিস্তিতি থেকে উত্তোরণের জন্য স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বলেছেন তিনি। গতকাল রোববার রাজধানীর মহাখালি ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০১৭-১৮’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিডিপির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া সিডিপির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সিনিয়র গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বিভিন্ন দিক ছাড়াও দেশের ব্যাংকিং খাত, পুঁজি বাজার, মুদ্রানীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি তুলে ধরা হয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ছে তা কোনোভাবেই দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা সার্বিক অর্থনীতির তুলনায় একবারেই বিস্ময়কর। আমাদের নিজস্ব আমদানি নীতিমালা থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিংখাত, পুঁজি বাজার খুবই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, বাংলাদেশে এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে কত টাকা ব্যয় হয়, সেটা আমাদের জানা আছে, যেটা নিউইয়র্কের চেয়েও অনেক বেশি। বাংলাদেশে আরও বড় বড় ৩/৪টা মেগা প্রকল্প চলছে, তার ব্যয় বিশ্লেষণ করলেও একই তথ্য পাওয়া যাবে।
দেশের উন্নয়ন ব্যয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এসব তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যতটা না উন্নয়ন ব্যয় নিয়ে চিন্তিত থাকি, তার চেয়ে বেশি চিন্তার বিষয়- এর গুণমান সম্পর্কিত। এটা এখন প্রকাশ্য যে, যে ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটি দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তবায়নের ফলে তার প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু প্রকল্পগুলো অতি মূল্যায়িত হয়েছে কিনা সেটাও কিন্তু বড় বিষয়।
তিনি বলেন, একটা হচ্ছে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতিকে সামনে বিবেচনায় নিয়ে মূল্য বৃদ্ধি হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে-প্রথমে আপনি এক টাকা তিন টাকা ধরে ব্যয় বাড়ালেন কিনা? তবে উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকল্পের কথা বলেননি। দেবপ্রিয় বলেন, দেশের জন্য প্রকল্পগুলো প্রয়োজন, কিন্ত অতি মূল্যায়নের কারণে বৈদেশিক লেনদেনের পরিস্থিতি সমস্যার ক্ষেত্র আরও ঘনীভূত করছে।
তিনি বলেন, একটা বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতিককালে দশকব্যাপী বাংলাদেশ যে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা ভোগ করে আসছে, সেই সামষ্টিক স্থিতিশীলতার ভেতরে কিছু ক্ষেত্রে চির দেখা দিচ্ছে। এর ফলে আগামী দিনে বেশ কিছু উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ্য করছি।
‘দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে-বিগত সময়কাল ধরে আমরা একটি শোভন প্রবৃদ্ধির ধারার মধ্যে আছি। এবং এই শোভন প্রবৃদ্ধির ধারা বাংলাদেশে যথোপযুক্ত আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং বৈষম্য বিলোপের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে-যতখানি প্রবৃদ্ধি মাত্রা নিয়ে আলোচনা, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধির চরিত্র নিয়ে আলোচনা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমরা ফল দেখতে পাচ্ছি না।
কী ধরনের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আয়ভোগ, সম্পদের বৈষম্য কমাবে এবং শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে-সিপিডির সামগ্রিক মূল্যায়নে এই দুটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানান তিনি। সিপিডি বলছে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে যতখানি না সমস্যা আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা রাষ্ট্রের সঙ্গে বা বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেটা বিদ্যমান।
দেবপ্রিয় বলেন, রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় তুলনীয় দেশের চেয়ে এখনো অনেক কম। কিন্ত বাজেট ঘাটতি বা আর্থিক ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। কারণ এটা পাঁচ শতাংশের নিচে থাকছে।
সিপিডির মূল আশঙ্কার জায়গাটি হলো-এটার অর্থায়নের ক্ষেত্রে অতি পরিমাণে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে করা হচ্ছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর এই যে নির্ভরশীলতা এ বছর হয়েছে, যখন কিনা বিদেশী ঋণ গত বছরের চেয়ে বেশি এসেছে। অর্থাৎ অর্থায়নের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নির্ভরশীলতা কিন্ত সেই অর্থে যাচ্ছে না। কিন্ত তারপরও আর্থিক খাত নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ আছে এমনটার চেয়ে বেশি উদ্বেগ আছে বৈদেশিক খাত নিয়ে।
তিনি বলেন, ইদানিং আমাদের সামগ্রিক বাণিজ্যিক লেনদেনের ঘাটতি বেড়েছে। একইসঙ্গে চলতি হিসাবেও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বেড়েছে। রফতানি, রেমিটেন্স ও বৈদেশিক সাহায্য বেড়েছে, কিন্ত তারপরও ঘাটতি বেড়েছে। এরপর বড় কারণ হলো আমদানি। রেমিটেন্স, রফতানি ১৭ দশমিক ৪ ও ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে আমদানি ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এটা এক প্রকার ছাদ ফুড়ে চলে যাওয়ার মতো।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা উন্নীত করার সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বর্তমান আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক করমুক্ত থাকে। সিপিডি বলেছে, তাড়াহুড়ো করে করপোরেট করহার কমানো ঠিক হবে না। করপোরেট কর কমালে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে-এটা ঠিক নয়। সার্বিকভাবে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হলেই বিনিয়োগ বাড়বে। সিপিডি আরও বলছে, সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকবে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
রাজস্ব খাত সম্পর্কে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচনের বছরে রাজস্ব খাতে জোরালো সংস্কার হবে না। বিগত বছরগুলোতেও বড় ধরনের সংস্কার হয়নি। মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট, আয়কর ও শুল্ক-এই তিন নতুন আইন হওয়ার কথা। তবে এবার না হলেও প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়নের শেষ সময়ে এসে বলা হয়েছিল, পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব আছে।
সামষ্টিক অর্থনীতির চারটি খাতে ঝুঁকি ও দুর্বলতা আছে বলে মনে করে সিপিডি। এগুলো হলো আর্থিক ও বাজেটীয় কাঠামো, মুদ্রানীতি ও ব্যাংক খাতের পারফরম্যান্স, শেয়ারবাজার ও বৈদেশিক লেনদেন পারফরম্যান্স।
কালোটাকা প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমরা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সমর্থন করি না। এতে সৎ করদাতাদের ওপর অন্যায় করা হয়। সুযোগ দিলেও খুব বেশি টাকা ঘোষণায় আসে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশে


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ