Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে

| প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : তৈরি পোশাক কারখানায় ঈদের আগে নির্ধারিত সময়ে বেতন-বোনাস না দেওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। শ্রমিকদের অভিযোগ, পোশাক মালিকরা ব্যাংকের দোহাই দিয়ে তাদের বেতন দিতে দেরি করছে। গতকালও গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেতন-বোনাসের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ ও গাড়ি ভাঙচুর করেছেন প্যারাডাইস গ্রæপের ‘প্যারাডাইস ইলেকট্রনিকস’ কারখানা এবং বেড়াইদেরচালা এলাকার ওয়েস্টারিয়া টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকেরা। সব শিল্প খাতের শ্রমিকদের মে মাসের বেতন পরিশোধের কথা ছিল ১০ জুন। ওইদিন বেতন পরিশোধ না করায় গত সোমবার শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয় ঢাকার নোমান ফ্যাশনে। ঘোষিত সময় অতিবাহিত হলেও বেতন পাননি পোশাক কারখানাটির সাড়ে ৭শ’ শ্রমিক। ঘোষিত সময়ে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি গাজীপুরের জাহিন টেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ইউনিট-১ও। বেতন নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়ায় কারখানাটি পর্যবেক্ষণে রেখেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ঘোষিত সময়ে বেতন না পাওয়ায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের তারাবোতে এনএম ফ্যাশনেও।
গতকাল শ্রমিকরা বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত নতুনবাজার এলাকায় ও দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা প্রায় দেড়টা পর্যন্ত শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় দুই পাশে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। বেতন-বোনাস না হওয়ায় প্যারাডাইস গ্রæপের ‘প্যারাডাইস ইলেকট্রনিকস’ কারখানার পাঁচ শতাধিক শ্রমিক ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই-তিন মাসের ওভারটাইমের টাকা ও মে মাসের বেতন বোনাসের টাকা নিয়ে কর্তৃপক্ষ টালবাহানায় করছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার বেতন দেওয়া হবে বলে জানানো হলেও বেতন দেয়নি। এর আগে শ্রীপুর উপজেলার বেড়াইদেরচালা এলাকার ওয়েস্টারিয়া টেক্সটাইল কারখানার ২৮৩ জন কর্মচারী তাঁদের বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে শিল্প পুলিশ ও শ্রীপুর পুলিশ লাঠিপেটা করে তাঁদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।
প্যারাডাইস কারখানার অপারেটর রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা দুই মাসের ওভারটাইম পাইনি। মে মাসের বেতনও দেওয়া হয়নি। ঈদের আগে আমাদের টাকা দরকার, অথচ তারা আমাদের প্রয়োজনটা বুঝতে চাইছে না। তাই শেষ পর্যন্ত আমরা রাস্তায় নেমেছি। টাকা না দিলে অবরোধ চলবেই।’ একই কারখানার লেদ অপারেটর তানজীম আকন্দ বলেন, ‘তারা (কারখানা কর্তৃপক্ষ) ব্যাংকের দোহাই দিয়ে আমাদের বেতন দিতে দেরি করছে। অথচ ঈদে আমরা বাড়ি যাব। পরিবার-পরিজন আমাদের দিকে চেয়ে আছে।’
প্যারাডাইস গ্রæপের প্যারাডাইস ইলেকট্রনিকস ইউনিটের জেনারেল ম্যানেজার মশিয়ার রহমান বলেন, ‘আমরা বেতন ব্যাংকে জমা দিয়েছি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে আমাদের শ্রমিকদের বেতন হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। গতকালই বেতন দেওয়ার কথা বলেছে তারা। কিন্তু ব্যাংকের জটিলতায় দেরি হচ্ছে। আশা করছি, আজকে তাঁরা বেতন পেয়ে যাবেন।’
শিল্প পুলিশ গিভেন্সি গ্রæপ ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইস্কান্দর হাবিব বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। তারা বেতন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, মালিক কাল (বুধবার) বেতন দিবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যথায় কঠোর কর্র্মসূচি দেয়া হবে।
সূত্র মতে, প্রতি বছরই ঈদের আগে বেতন পরিশোধ নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা থাকে। পরিস্থিতি এড়াতে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকও করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠক থেকেই বেতন ও বোনাস পরিশোধের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়। এবারো সব শিল্প খাতে মে মাসের বেতন ১০ জুনের মধ্যে পরিশোধের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন মালিকরা। আর বোনাস পরিশোধের ঘোষণা দিয়েছেন ১৪ জুনের মধ্যে। যদিও শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মাত্র ৪৩ শতাংশ কারখানা সঠিক সময়ে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেছে। বাকি ৫৭ শতাংশ কারখানার শ্রমিকই প্রতিশ্রæত সময়ে বেতন পাননি।
দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে আশুলিয়া গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনা। শিল্প পুলিশের হিসাবমতে, এসব অঞ্চলে শিল্প-কারখানা রয়েছে মোট ৭ হাজার ৭৮টি। এর মধ্যে পোশাক খাতের কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ২৮৮ ও অন্যান্য খাতের ৩ হাজার ৭৯০। সব কারখানা মিলে ঘোষিত সময়ে বেতন পরিশোধ করেছে ৩ হাজার ২২টি। এছাড়া বোনাস পরিশোধ করেছে ১ হাজার ৫৬৬টি কারখানা।
ঈদের আগ পর্যন্ত বেতন-বোনাস পরিশোধ চলবে বলে জানান শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক অ্যাডিশনাল আইজিপি আবদুস সালাম। তিনি বলেন, বেতন-বোনাস পরিশোধ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। বন্ধের আগের দিন পর্যন্তও চলবে। এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, সে বিষয়ে নজরদারি করে যাচ্ছি আমরা। আশা করছি, তেমন কোনো সমস্যা হবে না। যেসব কারখানা অসন্তোষপ্রবণ, সেগুলো কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
শিল্প পুলিশের সূত্রমতে, বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে চামড়া ও আবাসনসহ মোট ৪৪২টি কারখানায়। এসব কারখানার আওতায় শ্রমিক রয়েছেন ৪ লাখ ২৬ হাজার ২৩৮ জন। অসন্তোষপ্রবণ কারখানাগুলোর মধ্যে পোশাক খাতের কারখানার সংখ্যা ২৮৮, যেগুলোয় কর্মরত ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩৯ শ্রমিক। এর মধ্যে ১৬৫টি কারখানা আবার বিজিএমইএর সদস্য। অবশিষ্ট ৮৬টি বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা। আর ১৪টি কারখানা রয়েছে বিটিএমএর সদস্যভুক্ত। ঈদুল ফিতরে শ্রম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম চালু করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে (ডিআইএফই)। কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছ থেকে টেলিফোনে বেতন-বোনাস পরিশোধের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের তথ্যও বলছে, বিভিন্ন শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কারখানা এখনো বেতন পরিশোধ করতে পারেনি।
ডিআইএফই মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া বলেন, বেতন-বোনাস পরিশোধ চলছে। বড় ধরনের অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। যেসব কারখানায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ছোট ও সাব-কন্ট্র্যাক্ট ভিত্তিতে পরিচালিত। নারায়ণগঞ্জে এমন একটি কারখানা ঋতিকা। কারখানাটির মালিক লাপাত্তা। এছাড়া একটি কারখানার মালিক আত্মহত্যা করেছেন বলে জানতে পেরেছি। অসন্তোষপ্রবণ কারখানাগুলোয় আমাদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। শিল্প পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, শিল্প অধ্যুষিত সব এলাকায়ই কম-বেশি অসন্তোষপ্রবণ কারখানা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ রয়েছে শিল্প পুলিশ-১ বা আশুলিয়ার কারখানাগুলো ঘিরে।
জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, বরাবরের মতো এবারো ঘোষিত সময়ে বেতন পরিশোধ শেষ করেননি পোশাক কারখানা মালিকরা।
প্রতি বছর ঈদের আগে শ্রম মন্ত্রণালয় মালিকদের সাথে বসে বেতন-বোনাস পরিশোধ করার জন্য দায়সারা গোছের একটা নির্দেশ দিয়ে থাকে এমন অভিযোগ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, আসলে কত টাকা বোনাস দেয়া হয়েছে, কত তারিখে দেয়া হয়েছে, কতগুলো কারখানা ঠিকমত বেতন-বোনাস দিয়েছে; এসবের কোনো তদারকি করে না শ্রম মন্ত্রণালয়। সরকারের নির্দেশ যদি যথাযথ বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে ঘোষণা কেন প্রশ্ন রাখেন মোশরেফা মিশু। তিনি জানান, শতাধিক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। শ্রমিকদের দিয়ে হয়তো ১৫ জুন পর্যন্ত কাজ করানো হবে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেন মিশু। তবে বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, যেহেতু এত বড় একটা খাত। দুই-একটি কারখানায় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে সবাই মিলে তা সমাধান করা হবে।

 



 

Show all comments
  • Mohammed Shah Alam Khan ১৩ জুন, ২০১৮, ৭:৫৩ এএম says : 0
    শ্রমিকদের এই দুর্গতির জন্য কে দায়ী এটা বেরকরা খুবই প্রয়োজন। প্রতিবছর আমরা দেখতে পাই এই খেটে খাওয়া শ্রমিকরা ঈদের আগে এসে এধরনের অবস্থার শিকাড় হয়। এখন এসব ধনী রক্তচোষা মালিকদেরকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এটা দেখার দায়িত্ব আমাদের শ্রমমন্ত্রী চুন্নু মিয়ার তাই না?? কিন্তু তিনি এরকোন স্থায়ী সমাধান বেরকরছেন না এটাই সত্য। ইসলামে বলে শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তাঁর মজুরি দিয়ে দিতে আর সেখানে বিগত মাশের পাওনা অতিরিক্ত কাজের মূল্য সহ মূল বেতন ঈদ বোনাস বাকী পরে আছে। অপরদিকে এসব মালিকরা পরিবার পরিজন নিয়ে খুব মৌজের সাথে জীবন যাপন করছেন তাই না?? দেশে শ্রমিকদের উপর এধরনের জুলুম কিভাবে হচ্ছে এটা একটা প্রশ্ন নয় কি?? আল্লাহ্ আমাদেরকে সঠিক ভাবে ইসলামের উপর চলার ক্ষমতা দান করুন। আমীন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ