Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঈদের সংস্কৃতি

মাওলানা আবদুল হামিদ | প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুসলমানদের বড় দু’টো ধর্মীয় উৎসব হলো, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। পবিত্র রমজান মাসের শেষ সূর্যাস্তে পশ্চিমাকাশে শাওয়াল মাসের একফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। ঈদের আগের রাতটিকে ‘চাঁদ রাত’ বলা হয়। রাত পোহালেই ঈদ, তাই চাঁদ রাতে মুসলমানদের চিত্তে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। ঈদকে আনন্দময় করে তোলার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেনাকাটায়, কেউ মেহেদির সাঁঝে, কেউ রকমারি পিঠা তৈরিতে- মোটকথা প্রত্যেকেই নিজের সাধ্যমত ঈদকে আনন্দময় করে তোলার জন্য নানা আয়োজন করে। চাঁদ স্বচক্ষে দেখে ঈদের ঘোষণা দেয়া ইসলামী বিধান। বাংলাদেশে ঈদের দিন নির্ধারিত হয় দেশের কোথাও না-কোথাও চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে। দেশের কোনো স্থানে চাঁদ দেখা গেলে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে ঈদের দিন ঠিক করা হয়। মুসলমানদের জন্য ঈদের দিনে রোজা রাখা নিষিদ্ধ বা হারাম। দীর্ঘ এক মাস রোযা রাখার পর মুসলমানরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্যপালনসহ খুব আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে একমাস সিয়াম পালনের পর মুসলমানদের আল্লাহ তা’লার অনুগত বান্দাদের ঈদুল ফিতরের দিন বিশেষ পুরস্কার দেন। তাই এ দিনটিকে ‘পুরস্কারের দিবস’ও বলা হয়।
ঈদের দিন ভোরে মুসলমানরা সর্বাগ্রে ওযু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে উত্তম জামা-কাপড় পড়ে মিষ্টান্ন কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাত্রা করে। সেখানে ধনী-গরীব, ছোট-বড় সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হন। নিয়মানুসারে দুই রাকাত ঈদের নামাজ অতিরিক্ত ৬ তাকবিরের সাথে ময়দানে আদায় করা হয়। ফযরের নামাযের নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাযের সময় হয়। এই নামায আদায় করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে খুৎবা প্রদান করা ইমামের জন্য সুন্নত। তা শ্রবণ করা নামাযীর জন্য ওয়াজিব। সাধারণত ঈদের নামাজের পরে মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে রোজার পুরস্কারলাভ ও ভুল-ত্রুটি ক্ষমার জন্য আল্লাহর দরবাবে মুনাজাত করে। জীবিত-মৃত সবার কল্যাণ ও বিশ্ব শান্তি কামনায় মহান প্রভুর দরবারে প্রার্থনা করে। নামাজ ও মুনাজাত শেষে পরস্পর কুলাকুলি করে ঈদের সম্ভাষণ বিনিময় করে। ঈদের শুভেচ্ছাসূচক মধুর এই সম্ভাষণটি হলো, ‘ঈদ মুবারাক’।
ঈদসালামি বা ঈদি দেওয়া-নেওয়া একটা মধুর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও পারস্পরিক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ঈদের দিন বড়রা ছোটদের ঈদি দিয়ে থাকেন। শুধু সালামি নয়, মুলমানদের কর্তব্যের মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত ও গরিবের পাওনা ‘সাদাকাতুল ফিতর’। রমজান মাসের রোযার ভুল-ত্রæটির কাফফারা হিসেবে ঈদের দিন অভাবী দুঃস্থদের অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বা ফিৎরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের আগেই ফিৎরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও নামাজের পর পরই ফিৎরা আদায় করে নিতে হবে। ফিৎরার ন্যূনতম পরিমাণ ইসলামী বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট। সাধারণত ফিৎরা নির্দিষ্ট পরিমাণ আটা বা খাদ্য শস্যের (যেমন যব, কিসমিস) মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। সচরাচর আড়াই সের আটার স্থানীয় মূল্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম ফিৎরার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। আমাদের দেশে এবারের সর্ব নিম্ন ফিতরা ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, যাকাত পাওয়ার যোগ্যরাই ফিৎরা পাওয়ার যোগ্য।
ঈদ এলে সবাই নিজের মত করে এ উৎসবকে আনন্দময় করে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। বিত্তবানরা ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই ঈদ শপিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কার থেকে কে বেশি দামী, কে বেশি সুন্দর জামা-কাপড় কিনবেন চলে এমন মধুর প্রতিযোগিতা। সত্যিই এটি আনন্দের। ঈদের কেনাকাটা ঈদের আনন্দেরই অংশ। নতুন জামা কাপড় ঈদের আনন্দকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য ঈদ আনন্দের না হয়ে আসে অভিশাপ হয়ে। দারিদ্রতার কষাঘাতে যাদের জীবন জর্জরিত। নতুন পোশাক কেনা দূরে থাক, পুরানো কোন ভাল পোশাকই যাদের নেই। প্রতিদিনের অন্নের প্রয়োজনীয় যোগানও যাদের নেই। এসব পরিবারের বড়রা চোখের পানি লুকিয়ে হাসতে পারলেও ছোট্ট ছেলে-মেয়েগুলির কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের পাশে দাঁড়ানো মানবতার দাবি এবং ঈমানি দায়িত্ব। মানুষ মানুষের জন্য। গরীব, এতীম, পথশিশু এবং ছিন্নমূল ও গৃহহীন নারী বা পুরুষ সবার সমান অধিকার ও সম্মান রয়েছে। ইসলামের বিধানে দুর্বলদের জন্য রয়েছে সহজতা ও সহনশীলতা। সবার উচিত নিজের সচ্ছলতা ও আর্থসামাজিক নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং গরীব, এতিম, ছিন্নমূল, গৃহহীন ও পথশিশু ভাই-বোনদের জন্য দোয়া করা, যথাসম্ভব তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। ছিন্নমূল, গৃহহীন ও পথশিশুদের দেখাশোনা করা সমষ্টিগতভাবে সমাজের সবারই দায়িত্ব। তাই বিত্তবানরা নিজের কেনাকাটার সময় যদি গরীব, এতিম, অসহায়দের জন্য কিছু জামা-কাপড় ক্রয় করে, একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে তাহলে তাদের ঈদটাও আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে। তাদের মুখে আনন্দের হাসি ফুটতে পারে। একবার রাসুল (সা.) ঈদেগাহে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, পথের ধারে একটি শিশু কাঁদছে। রাসুল (সা.) তাকে আদর করে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শিশুটি বলল, ‘আমার বাবা-মা নেই, আমি এতিম; আজ এই ঈদের দিনে আমার নতুন জামাকাপড়ও নেই’। রাসুল (সা.) শিশুটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। হজরত আয়েশা (রা.) কে বললেন, ‘তোমার জন্য একটি ছেলে এনেছি। একে গোসল করিয়ে ভালো পোশাক পরাও’। শিশুটিকে বললেন, ‘আজ থেকে আয়েশা তোমার মা, ফাতিমা তোমার বোন, আমি তোমার বাবা’। এভাবেই শিশুটির মুখে হাসি ফুটল। রাসুল (সা.) এভাবেই অসহায় দুঃস্থদের মুখে হাসি ফুটাতেন। আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন। আমরাও চাইলে নিজেদের আশপাশের অসংখ্য অসহায় এতিম-দুঃস্থ-অসহায়ের সথে আনন্দের ভাগাভাগি করতে পারি। আর এই আনন্দের ভাগাভাগি যে করতে পারে সেই ধন্য। কবির ভাষায়- ‘ঈদের আনন্দ যে ভাগ করে নেয়, সেই জন আসলেই ধন্য।’ একজন অসহায়ে মুখে হাসি ফুটালে আল্লাহ তা’লা খুশি হন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিজেদের কল্যাণের জন্য তোমরা যে উত্তম কাজ করে থাকো, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে পাবে’ (সূরা আল- বাকারাহ: ১১০)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন। যে তৃষ্ণার্তকে পানি পান করায়, আল্লাহ জান্নাতে তাকে শরবত পান করাবেন। যে কোনো দরিদ্রকে বস্ত্র দান করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে উত্তম পোশাক দান করবেন (তিরমিজি)।’
লেখক: শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদরাসা, ইসলামপুর, সিলেট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদের

৯ জুলাই, ২০২২
৯ জুলাই, ২০২২
৯ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন