Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক

| প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : বাণিজ্য যুদ্ধে একা হয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র! বেশ কিছুদিন ধরে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ চরমে পৌছে। এরপর স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক বসানোর পর ইউরোপ, কানাডা এবং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের। শুক্রবার চীন জানায়, তারা তেলসহ আরো মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপ করছে। একই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ভারত। এই বাণিজ্য যুদ্ধের সুযোগ এবং বাণিজ্যিক ঝুঁকি-দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য যুদ্ধের ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের জন্য কোনটা অপেক্ষা করছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের বাণিজ্যযুদ্ধ যদি নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে ট্যারিফ সুবিধার জন্য দুই দেশই বিকল্প বাজার খুঁজবে। বাংলাদেশের যদি যথাযথ প্রস্তুতি থাকে তবে এর ইতিবাচক সুযোগ নিতে পারবে। দুই দেশের অনেক বাণিজ্যই আমাদের বাজারগুলোতে নিয়ে আসতে পারবো। এর জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখতে হবে। আর যদি এই বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের মতো বাণিজ্যনির্ভর দেশগুলো। তবে এখনকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাগুলো শক্তিশালী হওয়ায় এ যুদ্ধ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে না বলেই তারা মনে করছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবীদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, এর দুটো দিক রয়েছে। যদি এটি ছড়িয়ে পড়ে তবে বিশ্ব বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সংকোচিত হবে বিশ্ব বাণিজ্য। বাণিজ্য সংকোচিত হলে আমরা যেহেতু বাণিজ্যের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল দেশ। আমাদের আয়, উৎপাদন আয়, কর্মসংস্থান বিশ্ববাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে আমাদের ওপর নেতিবাচক ঝুঁকি রয়েছে।
আবার যদি সীমিত আকারে হয় সেক্ষেত্রে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ বেড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও চীনের ট্যারিফ বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যে শুল্ক আরোপ করায় ভারতও বেকে বসেছে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি পণ্যে শুল্ক আরোপের ঘোষানা দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে। এটা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন-ভারত কি করবে। তারা যে সমস্ত দেশ থেকে আমদানি করলে ওই ট্যারিফের সম্মুখীন হবে না সেসব দেশের বাজারে চলে যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সেরকম প্রস্তুতি রাখতে পারি তবে আমাদের কিন্ত লাভই হবে। কারণ তারা বেরিয়ে কোন না কোন দেশে তো যাবে। তবে বাংলাদেশ নয় কেন? কিন্ত যদি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে যেমনটা ১৯৩০-এর দশকে হয়েছিল। বিশ্বময় একটা বাণিজ্য যুদ্ধ চলেছে। সবাই সবার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এখনও যদি কানাডা, জাপান, রাশিয়া ইত্যাদি দেশগুলো জড়িয়ে পড়ে তবে কিন্ত ট্রেডওয়ারি কেউ বিজয়ী হবে না। মাঝখানে ক্ষতি হবে অনেকের।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর একটি নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দর কষাকষির ওপর পড়বে। ডবিøউটিও-এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের ওপরও এর প্রভাব আসতে পারে। তিনি বলেন, এই ধরনের শুল্ক বৃদ্ধি কোনও একটি দেশের জন্য প্রযোজ্য না হয়ে সাধারণভাবে ‘মোস্ট ফেবারড ন্যাশন’ মর্যাদার সব দেশের ওপর বর্তায়। এর ফলে বাংলাদেশ রফতানি করে এমন কোনও পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ালে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
উদাহরণ হিসেবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীন থেকে তৈরি কাপড় আমদানি কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক বৃদ্ধি করে, তবে এটি বাংলাদেশের তৈরি কাপড়ের ওপরও প্রযোজ্য হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুল্কবৃদ্ধির এই গোটা প্রক্রিয়ায় কে লাভবান হবে, কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেসব উৎপাদনকারী আছেন, তারা লাভবান হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা ও বিদেশি রফতানিকারকরা।
এদিকে রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) বাতিল করা ছাড়াও নানা প্রতিকূলতার কারণে দেশটি বাংলাদেশের পোশাক খাতের বেশ মন্দা সময় অতিক্রম করছিল। তবে কয়েক মাস ধরে দেশটির বাজারে বাংলাদেশের পোশাক আবারও ইতিবাচক দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে বস্ত্র ও পোশাক খাতের দপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের (জানুয়ারি-এপ্রিল) প্রথম চার মাসে আয় হয়েছে ১৮৭ কোটি ডলার। এ আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দুই দশমিক নয় শতাংশ বেশি। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুসারে তার সরকার ট্রান্স ফ্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি বাতিল করায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে এ সুবাতাস তৈরি হয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টিপিপির চুক্তি ও রানা প্লাজা ধসের দুর্ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পণ্য রফতানি কিছুটা কমে এসেছিল। তবে কয়েক মাস ধরে এ বাজারে আবারও ইতিবাচক ধারা ফিরতে শুরু করেছে। আর এর মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি চুক্তি বাতিলের ঘোষণা। ফলে আমাদের পোশাক রফতানির বিশ্ববাজারে বড় প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসা আবারও বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বস্ত্র ও পোশাক দপ্তরের পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ষষ্ঠ রফতানিকারক দেশ। প্রায় ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক খাতে একক বড় রফতানি বাজারে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এ সময় সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করেছে চীন। যা প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি ডলার। এ সময় ভারত রফতানি করেছে ২৬৭ কোটি ডলার, ভিয়েতনাম প্রায় ৪০০ এবং পাকিস্তান এই বাজারে তাদের পোশাক রফতানি করেছে ৯২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার চীনের তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আমদানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। আরো এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বেইজিংও এর জবাবে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি ভারতেরও কিছু পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করে। পাল্টা ভারতও কিছু পণ্যে শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছে। এদিকে সম্ভাব্য বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কায় গতকাল মঙ্গলবার এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোয় মন্দাভাব দেখা গেছে। এদিকে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক আরোপ করায় ক্ষেপেছে কানাডা এবং ভারতও। গত মার্চে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। গত ১৬ জুন ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে জানিয়েছে, তারা ৩০টি মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। ৫০ ভাগ শুল্ক বাড়ানো হবে। স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক আরোপ করায় ভারতের ২৪০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। মার্কিন পণ্যের মধ্যে আপেল, মোটরসাইকেল, যন্ত্রপাতি এবং চিংড়িও রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক আরোপ করায় ভারতের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে হবে। এজন্যই পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন লাগার্দে গত সোমবার বার্লিনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, শীর্ষ শিল্পোন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যযুদ্ধের হুমকি তীব্র হয়ে ওঠায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে। ডবিøউটিও প্রধান রবার্তো আজেভেদো বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যে বর্ধনশীল উত্তেজনা ‘অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাবের ঝুঁকি বাড়াবে এবং আর্থিক সংকটের পর বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে শক্তিশালী টেকসই এ মুহূর্তকে বাধাগ্রস্ত করবে।



 

Show all comments
  • বিপ্লব ২০ জুন, ২০১৮, ৪:৫২ এএম says : 0
    সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ