Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিদেশ সফরের হিড়িক

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সরকারের মেয়াদের শেষ সময় কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের হিড়িক পড়েছে। কেউ আসছেন, কেউ যাচ্ছেন। আবার কেউ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মধ্যে কোন কোন কর্মকর্তা ঘুরে ফিরে বার বার বিদেশ যাচ্ছেন। এতে অনেক কর্মকর্তাই বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণে অংশ নিতে বিদেশ যাত্রার এমন হিড়িক লেগেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে।
শিক্ষা, পরিবেশ ও বন, স্বাস্থ্য, কৃষি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের হিড়িক লেগেছে। প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সভা, সেমিনারের কথা বলে বিদেশ সফর করা হলেও কর্মজীবনে তার তেমন প্রভাব দেখা যায় না। অথচ প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে এই বিদেশ সফরে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন আগামী অক্টোবর মাসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে। নিবার্চনের আগে প্রতি সরকারের আমলে কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ যান। নিবাচনের ফলাফল দেখে হয় তারা ফিরেন নতুবা বিদেশেই থেকে যান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে স্বাস্থ্য বিভাগের দেড় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারির নামে বিদেশ ভ্রমণের সরকারি পরিপত্র জারি হয়েছে।
পরিপত্রে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহা-পরিচালক, পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারি পরিচালক, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারি অধ্যাপক, ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান রয়েছেন। সফরের দেশগুলো হচ্ছে সুইজারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানি, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কা। আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও প্রশিক্ষণের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার উপর বিশেষায়িত বিভিন্ন প্রশিক্ষণে যারা যান, তারা প্রশিক্ষণ শেষে দেশে এসে বাস্তবে তা কাজে লাগান না। অথচ তাদের পেছনে জনগণের করের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। গত কয়েক বছরে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র), সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট), কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টসহ জটিল রোগ ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজন নার্সের উদাহরণ টেনে তারা বলেন, যারা এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন, বাস্তবে তা কাজে লাগাতে পারেন না। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার চিকিৎসকদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হলেও ঘন ঘন বদলির কারণে প্রশিক্ষণ শুধু ভ্রমণস্মৃতি হিসেবেই থেকে যায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এভাবে সরকারি অর্থের এক ধরনের অপচয় হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য) মো. হাবিবুর রহমান খান ইনকিলাবকে বলেন, বছরের শেষ সময়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চিকিৎসক, শিক্ষক, নার্সসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। জুলাই থেকে জুন বছর হিসাবে বাজেট বরাদ্দই এর অন্যতম কারণ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব (পিপিসি) সরকারি টাকায় রীতিমতো প্রমোদ ভ্রমণ করে বেড়ান বলে অভিযোগ উঠেছে। চলতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় গবেষণা ও উদ্ভাবনী ব্যায় ১০ কোটি টাকা রেখেছিল। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের ব্যাচমেট এই কর্মকর্তা ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সচিবকে ভুল বুঝিয়ে তৎকালীন সিনিয়র সহকারি সচিব বর্তমানে উপসচিব পর্যায়ের এক মহিলা কর্মকর্তাকে নিয়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন।
প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ তার অধীন দফতরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। অথচ নামে শিক্ষক প্রশিক্ষণ হলেও সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের অংশগ্রহণ থাকছে নামমাত্র। শিক্ষা খাতে একাধিক প্রকল্প চলমান থাকায় কোন না কোন প্রকল্প থেকে প্রতি মাসেই প্রশিক্ষণের নামে আয়োজন করা হচ্ছে বিদেশ সফরের। বিদেশ থেকে ফিরে শিক্ষক ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা অধিকাংশই প্রতিবেদন দিলেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তার প্রয়োজন মনে করছেন না। বরং অনেকেই শিক্ষা ক্যাডার বা যে কোন শিক্ষককে তার প্রশিক্ষক থেকে বঞ্চিত করে নিজেরাই সেখানে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ এক সফর শেষে দেশে ফিরেই আবার চলে যাচ্ছেন অন্য দেশে। এসব ঘটনায় অসন্তোষ বাড়ছে শিক্ষা প্রশাসনে।
জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একাধিক প্রকল্প থেকে আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা প্রায় প্রতিবারের প্রশিক্ষণেই থাকেন। সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রæভমেন্ট (টিকিউআই)-২ এবং সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ)।
সূত্র জানায়, বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার ঋণে পরিচালিত এসব প্রকল্পের প্রশিক্ষণে কর্মকর্তাদের জন্য রাখা হয় বড় অংকের ভাতা। প্রতিটি প্রশিক্ষণ শিক্ষা কর্মকর্তাদের ও শিক্ষকদের জন্য আয়োজন করা হলেও সেখানে রাখা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। ফলে এই প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ কোন প্রশ্নই তুলতে পারে না। মাউশির কর্মকর্তারাও সাহস পান না মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলতে।
টিচার এ্যাক্রিডিটেশন’ বিষয়ক দুই মাসের এক প্রশিক্ষণে নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলেন ১৪ জন। অথচ সেখানে তাদের মধ্যে একজন শিক্ষকও ছিলেন না। এই টিমে ছিলেন এনটিআরসিএ’র দু’জন কর্মকর্তা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মকর্তা। যাদের চারজনই শিক্ষকের বাইরের কর্মকর্তা এমনকি তারা শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাও নন। এছাড়া মাউশি অধিদফতরের একজন সিনিয়র কম্পিউটার অপারেটরও ছিলেন এই টিমে। তিনি কিভাবে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করবেন- সে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা। এছাড়া রয়েছে এনসিটিবি, মাউশি অধিদফতরসহ বিভিন্ন প্রকল্প ও দফতরের কর্মকর্তারা। যদিও বিভিন্ন দফতরের ৯ জন কর্মকর্তা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য। তারা শিক্ষক হলেও বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনে চাকরি করছেন। শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধানরা মূল ভূমিকা পালন করলেও তাদের কাউকেও এই টিমে রাখা হয়নি।
টিকিআই-২ এর অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর এক প্রতিক্ষণে ১৩ জন কর্মকর্তা ফিলিপাইনে গিয়েছিলেন। এর কিছুদিন আগে একই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ১৯ কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়ায় যান। একই বিষয়ের প্রশিক্ষণ হলেও একই ব্যক্তিরাও পরপর দু’বার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। অথচ যারা সুযোগ পাননি তাদের কোন প্রশিক্ষণেই পাঠানো হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ার প্রশিক্ষণটি মূলত মাউশি অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জন্য হলেও সেখানে ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু’জন অতিরিক্ত সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, বাস্তবায়ন মনিটরিং ও মূল্যায়ন বিভাগের মহাপরিচালক, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।

 



 

Show all comments
  • সাইফুল ইসলাম চঞ্চল ২০ জুন, ২০১৮, ৪:৩৯ এএম says : 1
    অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধ করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • জহির উদ্দিন ২০ জুন, ২০১৮, ৪:৪০ এএম says : 1
    এটা অনেককের কাছেই হয়ে যায় বিনোদন ট্যুর
    Total Reply(0) Reply
  • কাজল ২০ জুন, ২০১৮, ৪:৪১ এএম says : 1
    খুব ভালো একটা রিপোর্ট।
    Total Reply(0) Reply
  • মামুন ২০ জুন, ২০১৮, ৪:৪১ এএম says : 1
    কবে যে আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে ?
    Total Reply(0) Reply
  • নাহিদ ২০ জুন, ২০১৮, ৪:৪১ এএম says : 1
    এভাবে দেশের টাকা অপচয় করা বন্ধ করুন।
    Total Reply(0) Reply
  • Nannu chowhan ২০ জুন, ২০১৮, ৭:২৯ এএম says : 0
    Ashole shushashoner ovabei ovabei proshashone ojoggo bektira boshe ase jade daaittobodh o desher proti kono valobasha nai shudho nijeder akher gujatei besto eaijonnoi tader odhine jara ase tarao kortader briddo angguli dekhaia she i pothei chole.Ar eai jonno voktovogi holo desher appmor jonogoshti.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সরকার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ