Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রমজানের ঐ রোজার শেষে গেল খুশির ঈদ

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৮, ১০:৪৬ পিএম

এক মাস রমজানের রোজার শেষে ভালয় ভালয় আমাদের সবচাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়ে গেছে। ঈদুল ফিতর শুধু আমাদের সবচাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব নয়, দেশের সর্বপ্রধান জাতীয় উৎসবও বটে। তাই গ্রামের আপনজনদের সাথে এ উপলক্ষে কয়েকটি দিন কাটানোর জন্য শত কষ্ট মেনে নিয়ে রাজধানীর লোকেরা গ্রামে ছুটে গিয়েছিল, যাদের অনেকেই এখন ঢাকায় ফিরে এসেছে। যারা এখনও আসতে পারেনি তারাও গ্রামের আপনজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের জনগণের আসল নিবাস এখনও গ্রামে। সুযোগ পেলেই তারা ছুটে যায় গ্রামের আপনজনদের সাথে ক’টা দিন কাটাতে। সম্ভবত এ কারণেই ইংরেজিতে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে : বাংলাদেশ লিভস ইন ভিলেজেস। যারা গ্রামে থাকে তারা তো বটেই, তবে যারা চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা জরুরি কারণে রাজধানীতে থাকতে বাধ্য হয়, তাদেরও মন পড়ে থাকে গ্রামে। সামান্যতম সুযোগ পেলেই তারা সংক্ষিপ্ততম সময়ের জন্য হলেও গ্রামে গিয়ে হাজির হয়।
ঈদুল ফিতর নানা কারণেই আমাদের দেশে প্রধান জাতীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। একটা বড় কারণ তো এই যে, এই ঈদুল ফিতর আসে পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনার পর। রমজান মাস তা সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল বয়স্ক সুস্থ মুসলমান শুধু পানাহার নয়, বৈধ যৌনাচার থেকেও বিরত থেকে আল্লাহর নির্দেশ পালনের এই অনন্য কঠোর সাধনার পরীক্ষা দিয়ে থাকে। তাদের এই বিরত থাকার মেয়াদ মৌসুম ভেদে ১৪-১৫ ঘণ্টা থেকে ১৭-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়। এই দীর্ঘ সময় পানাহার বর্জন করে থাকা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু সায়েম বা রোজাদাররা এই কঠোর সাধনায় অংশগ্রহণ করে শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে।
এই দীর্ঘ ১৭-১৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের এমন অনেক সুযোগ আসে তারা কিছু পানাহার করতে পাবে তাদের ক্ষুধা বা পিপাসা নিবারণের লক্ষ্যে। কিন্তু এ ধরনের সুযোগ পাওয়া সত্তে¡ও তারা সে সুযোগ গ্রহণ করে না এই ভেবে যে, কোনো মানুষ তাদের এই পানাহার না দেখলেও আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা, তিনি তো দেখছেন। এই যে শুধু আল্লাহর ভয়ে তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি সাধনের জন্য রোজাদার সিয়াম সাধনা করে, এ কারণে আল্লাহ বলেন, রোজাদার রোজা রাখে শুধু আমার জন্য, তাই তার ছওয়াব বা পুরস্কার আমি নিজে দেবো।
এ তো গেল সিয়াম সাধনার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্কের কথা। সিয়াম সাধনার সামাজিক দিকও রয়েছে এবং তাও মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রোজা পালনের মাধ্যমে ধনীরা দরিদ্রদের ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করতে সক্ষম হয়। এর ফলে তারা সমাজের অভাবী মানুষের দুঃখ অনুভব করে অভাবীদের অভাব মোচনের লক্ষ্যে তাদের মধ্যে বিবেকের দংশন অনুভব করতে সক্ষম হয়। ফলে তার মধ্যে মানবিকতা বোধ জাগ্রত ও জোরদার হয়। এর ফলে রোজাদারদের মধ্যে ভালো মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা হয় প্রবলতর।
মানুষের দৈহিক অস্তিত্ব ও সুস্থতার জন্য নিয়মিত ব্যবধানে তার পানাহারের ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। এটা প্রাকৃতিক দাবিও বটে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময় স্বেচ্ছায় এই প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখে। প্রতিদিন সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্তÍ সময়-কালের পর প্রকৃতিসম্মত ব্যবস্থায় ফিরে যায়। এই সময়টায় যে কাজের মাধ্যমে মাহে রমজানে প্রতিদিন তারা এই কাজটা সম্পন্ন করে তাকে বলা হয় ইফতার, তথা প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন। মাহে রমজানে প্রতিদিন যে কাজের মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে তাকে ই বলা যায় ইফতার বা প্রাত্যহিক প্রত্যাবর্তন, তেমনি যে সেদিতানেটায় মানুষ সারা বছরের জন্য রমজানের রোজান্ধ করার জন্য উৎসব পালন করে, তার নাম ফিতরের উৎসব তথা ঈদুল ফিতর।
ইসলামে উৎসব পালনের নামে লাগামহীন আনন্দ বা ভোগবিলাসের অবকাশ নেই। সেখানেও ধর্মের মূল মর্মবাণীর আলোকে উৎসব পালনের বিধান রয়েছে। পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনার সুযোগদানের জন্য আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশে শোকরিয়া জ্ঞাপনের লক্ষ্যে এলাকার সকল মুসলমান এক স্থানে জমায়েত হয়ে আল্লাহর উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। শুধু তাই নয়, সেখানে তারা ধনী-দরিদ্র, দেশী-বিদেশী এ এলাকা-সে এলাকারা সকল মুসলমান সকল ভেদাভেদ ভুলে পাশাপাশি দু’রাকাত নামাজ আদায় করে এবং নামাজের পরপর সকল বিভেদসাম্য ভুলে গিয়ে পরস্পর কোলাকুলি করে ইসলামের সামাজিক আদর্শের মূল মর্মবাণী সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও আমরা গত ১৬ জুন শনিবার মাহে রমজান শেষে সারা দেশে পবিত্র ঈদুল ফিতর যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত পালন করেছি। কিন্তু আমরা কি আমাদের বুকে হাত দিয়ে জোর করে বলতে পারি আমাদের রোজা আল্লাহর কাছে কবুল হয়েছে কি না? পারি না। কারণ রোজা রেখে মিথ্যা, পরনিন্দা, গীবত প্রভৃতি থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছি, তা জোর করে বলতে পারি না। রোজা রেখে রাসূলুল্লাহর (সা.)-এর সামনে দিয়ে এক ব্যক্তি পরনিন্দারত থাকাকালে সময়কালে তিনি বলেছিলেন, তার ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া কোনো লাভ হচ্ছে না।
এই হাদিসের আলোকে যদি বিগত রমজান মাসের আমাদের সামগ্রিক কাজকর্র্মের বিচার করি, তাহলে প্রমাণিত হবে, আমাদের অনেকেরই রোজা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। শুধু তাই নয়, সিয়াম সাধনার অন্যতম লক্ষ্য এমন সমাজ গড়ে তোলার সাধনা করা, যে সমাজেরা ধনসম্পদ যেন শুধু গুটি কয়েক ধনীর হাতে সীমাবদ্ধ না হয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
সিয়াম সাধনা ফরজ হত্তয়া সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে যে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে। কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামো কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিনা কাবলিকুম লাআল্লাকুম তাত্তাকুন। অর্থাৎ তোমাদের জন্য সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। সে নিরিখে সিয়াম সাধনার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন। তাকওয়ার অর্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে কণ্টকপূর্ণ পথ দিয়ে চলার সময় যেমন প্রতি মুহূর্তে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, যাতে আমরা কণ্টকের আঘাত থেকে রক্ষা যেতে পারি।
জীবনকে উচ্চস্তরে পৌঁছে দেয়াই জন্যই সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য। জীবনকে মহত্বের উচ্চস্তরে পৌঁছে দেয়া যে সিয়াম সাধনার লক্ষ্য, তাকে আমরা শুধু নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখে প্রমাণ করেছি যে, আমরা সিয়াম সাধনার মূল মর্মবাণীই বুঝতে সক্ষম হইনি। সিয়াম সাধনাকে দিনের বেলা পানহার থেকে বিরত থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে আমরা সিয়াম সাধনার গভীর মর্মবাণী বুঝতে শুধু ব্যর্থতারই পরিচয় দেইনি, প্রকৃত সিয়াম সাধনা মানুষের জীবনে যে সর্বাঙ্গীণ ও সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে তাকিদ দেয় সেটা অনুুধাবন করতেও ব্যর্থ হয়েছি। ফলে আমাদের সিয়াম সাধনা মধ্যে শুধু রমজানের এক মাস পানাহার বর্জনে মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অথচ সিয়াম সাধনা এমন এক সাধনা যার সুপ্রভাব রমজান-পরবর্তী বাকি এগারো মাসেও পড়তে বাধ্য। যে ব্যক্তি সিয়াম সাধনায় পূর্ণ সফলতা অর্জন করে সে প্রকৃত অর্থেই তাকওয়া অর্জন করে বলে তার এই তাকওয়া অর্জনের সুপ্রভাব বছরের বাকি এগারো মাসও পড়তে বাধ্য। এ কারণেই সিয়াম সাধনা সম্পর্কে হাদিসে কুদসীতে আল্লাহর জবানীতে বলা হয়েছে : সিয়াম শুধু আমার (আল্লাহর) জন্য, তাই আমি নিজে সিয়ামের প্রতিদান দেবো। সিয়াম সাধনার সুপ্রভাব কোনোক্রমেই শুধু মাহে রমজানে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সিয়ামের সুপ্রভাব সারা বছরই পড়তে বাধ্য। রমজান মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমরা পানাহার ও অন্যান্য অচরণে যেমন লামামছাড়া হয়ে উঠি, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়, আমাদের সিয়াম অনেকটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। বিশ্বনবীর আমলের বিখ্যাত ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে হয়, এক মাস আমাদের ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্ট পাওয়াই সার হয়েছে।
সিয়াম সাধনাকে সার্থক করতে হলে তাই যেমন মাহে রমজানের পূর্ব থেকেই এ জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করতে হবে, তেমনি রমজান-পরবর্তী মাসসমূহেও আমাদের সচেতন সাধনা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সিয়াম ও সাধনা সার্থক করতে হলে আমাদের গোটা বছরই এবং প্রকৃতপক্ষে সমগ্র জীবনভরই সাধনা চালিয়ে যেতে হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদ


আরও
আরও পড়ুন