Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পাকিস্তানে নির্বাচন, কলকাঠিতে কি নেপথ্যের কুশীলবরা?

| প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৮, ১২:২২ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : পাকিস্তানের আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ পিএমএল (নাওয়াজ)-এর মরিয়ম নাওয়াজের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করলেও নির্বাচন কমিশন পাকিস্তান তাহরীকে ইনসাফের(পিটিআই) প্রধান ইমরান খান এবং সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শহিদ খাকান আব্বাসিসহ বেশ কয়েক নেতার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে। আগামী ২৫ জুলাই অনুষ্ঠেয় পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে করাচির একটি আসন থেকে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন তারা। কিন্তু তাদের মনোনয়নপত্র অসম্পূর্ণ হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া নানা কারণে অল পাকিস্তান মুসলিম লিগের(এপিএমএল) প্রধান সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফ, মুত্তাহিদা কউমি মুভমেন্টের ফারুক সাত্তার, পিটিআইয়ের আয়েশা গুলালি এবং পিএমএল-এনের সরদার মেহতাব খান আব্বাসির মনোনয়নপত্রও বাতিল হয়েছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তার দল আল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এপিএমএল)-এর চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। দলের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমজাদ জিও নিউজকে এই তথ্য দিয়েছেন। গতকাল জিও নিউজকে মোহাম্মদ আমজাদ জানান, পারভেজ মোশাররফ তার পদত্যাগপত্র পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠিয়েছেন। বিদেশ থেকে তার পক্ষে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে পারভেজ মোশাররফের মনোয়ন দাখিলের ওপর সুপ্রিম কোর্টের শর্তযুক্ত অনুমোদন তুলে নেয়ার পর চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে নির্বাচন কমিশন মোশাররফের মনোয়নপত্র বাতিল করেছে। মোহাম্মদ আমজাদকে দলের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন পারভেজ মোশাররফ। সূত্র জিও নিউজকে জানিয়েছে, দলের চেয়ারম্যান পদে রদবদল সম্পর্কে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে এপিএমএল। মোশাররফের ইস্তফা সত্তে¡ও তিনি দলের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে থাকবেন।
২০১০ সালে এপিএমএলের প্রতিষ্ঠা করেন পারভেজ মোশাররফ। ২০১৩ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন আগে নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেন পারভেজ মোশাররফ। তবুও তার দলের দুজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন এবং চিত্রলে দুটি আসনে জয়লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে তখনকার নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান মোশাররফ। ২০১৩ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তিনি।
এদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া প্রার্থীরা আপিল ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সুযোগ পান। গতকাল পর্যন্ত আপিল গ্রহণ করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৭ জুনের মধ্যে এসব আবেদনের সুরাহা করবে কমিশন।
এরপর ২৮ জুন বৈধ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। ২৯ জুন পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারবেন প্রার্থীরা। আর প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে ৩০ জুন।
ওদিকে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) মনে হচ্ছে ঝামেলায় পড়ে গেছে। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র দুই মাস বাকি থাকতে দলটি একটির পর একটি দলত্যাগের শিকার হচ্ছে। আইনপ্রণেতা ও নির্বাচনের প্রার্থীরা অন্যান্য দলে, বিশেষ করে পাকিস্তান তাহরীকে ইনসাফে (পিটিআই) যোগ দিচ্ছে।
গত বছর পানামা পেপার্স মামলায় নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তা শুরু হলেও গত এপ্রিলে তা বিপুলভাবে ঘটে। ওই সময় জাতীয় পরিষদ ও পাঞ্জাব আইনসভার বর্তমান সদস্য ও সাবেক সদস্যরা একত্রিত হয়ে জানুবি পাঞ্জাব সুবা মাহাজ গঠন করে। তারা বাহ্যত আরো অধিকার ও দক্ষিণ পাঞ্জাবের লোকজনের জন্য নতুন একটি প্রদেশ সৃষ্টির দাবিতে একত্রিত হয়।
মাহাজ গঠনের উদ্যোক্তরা জানিয়েছেন, ক্ষমতায় থাকার সময় পিএমএল-এন তাদের দাবির প্রতি সাড়া না দেওয়ায় তারা দলটি ত্যাগ করছেন। এরপরপরই তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পিটিআইয়ে যোগ দেয়। এরপর আরো অনেক দলত্যাগের শিকার হয় পিএমএল-এন।
সাধারণভাবেই বোঝা যাচ্ছে, পিএমএল-এনে এ ধরনের দলত্যাগ ঘটতে থাকলে জুলাইয়ের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে। এমন ধারণা সৃষ্টির কারণ হলো, নির্বাচনী প্রার্থীদের সমর্থন বলয় থাকে। ফলে তারা যে দলেরই হোন না কেন, সমর্থকদের জোরে তারা জয়ী হয়ে যাবেন। এখানে যুক্তি হলো, স্থানীয় প্রার্থীদের বিপুল অর্থনৈতিক শক্তি, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকে। তারা এসবের সাথে স্বজন ও অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে জয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন।
এতে আরো ধারণা করা হয়ে থাকে, কোনো প্রার্থী যদি প্রতিদ্ব›দ্বী দলে যোগ দেন, তবে তিনি সাথে করে তার ভোটারদেরও নিয়ে যান। এতে দলকেন্দ্রিক না হয়ে প্রার্থীকেন্দ্রিক নির্বাচনী প্রতিযোগিতার কাঠামোর অস্তিত্বের কথা বলা হয়।
নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় এ ধরনের অনেক প্রমাণ দেখাও যায়। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত খুবই দুর্বল। তাদের মধ্যে আদর্শগত ভিত দুর্বল হওয়ায় তারা সরাসরি ভোটারদের কাছে আবেদন জানাতে পারে না। পাকিস্তানে বারবার কর্তৃত্ববাদী শাসন, পর্দার অন্তরাল থেকে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন-প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকে দায়ী করা হয়ে থাকে। তাছাড়া শক্তিশালী পার্টি পরিচয় ও ব্যবস্থার বদলে স্থানীয়, সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকেও উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। শক্তিশালী দলীয় কাঠামোর অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোও শক্তিশালী স্থানীয় প্রার্থীদের আকৃষ্ট করার প্রতিযোগিতায় নামে।
কিন্তু তারপরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, সেগুলোও পাকিস্তানের নির্বাচনী প্রতিযোগিতা বিশ্লেষণের সময় মাথায় রাখা উচিত। প্রথমত আগের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রার্থীকেন্দ্রিক ধারণাটি পুরো পাকিস্তানে একইভাবে কাজ করে না। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) মতো দলগুলোর উদাহরণ এখানে বিবেচনা করা যেতে পারে। অনেক আসনে প্রার্থীর পরিচয়ের চেয়ে তাদের দলীয় পরিচিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওইসব আসনে যে প্রার্থীই প্রতিদ্ব›িদ্বতা করুক না কেন, দলীয় পরিচিতিই প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়।
দ্বিতীয়ত, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের হার খুবই কম। ২০১৩ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ২,৩৫৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে জিতেছিল মাত্র ২৮ জন। ফলে ব্যক্তিগত সামর্থ্যে জয়ের যে কথাটি বলা হয়, তা যথাযথ নয়। তবে যোগ্য প্রার্থীরা যদি সঠিক দলের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন, তবে তাদের জয়ের হার বেড়ে যায়। অর্থাৎ দল ত্যাগের চেয়ে দল পছন্দের ব্যাপারটি জয়-পরাজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্ভাবনাময় প্রার্থীও যদি ভুল দলের টিকেট কাটেন, তবে তার পরাজয়ের আশঙ্কা থাকে।
রাজনীতিবিদেরা কেন হারেন, তা বুঝতে হলে এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। আর মতাদর্শের কারণে নয়, অনেক ক্ষেত্রেই দলের টিকেট বরাদ্দ, পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি ইস্যুতেও প্রার্থীরা দলত্যাগ করে থাকে। তাছাড়া যে দলের ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা থাকে, সুযোগ সুবিধা গ্রহণের জন্য ওই দলে যোগদানের একটি প্রবণতা দেখা যায়। দলত্যাগের এটি অন্যতম কারণ।
পিএমএল-এন থেকে কেন ও কীভাবে দলত্যাগের ঘটনা ঘটছে, তা বিবেচনার পাশাপাশি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, দলটি কি ক্ষমতায় থাকার সময় তার কর্ম সম্পাদন দক্ষতা ও মতাদর্শ দিয়ে ভোটারদের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে? দ্বিতীয়ত, পিটিআই সত্যিই কি পিএমএল-এনের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প? তারা কি সরকার গঠনের মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক আসনে জয়ী হতে পারবে?
দল হিসেবে পিএমএল-এন যদি তার জনসমর্থন গঠন করতে পারে, তবে দলত্যাগ তাদের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে না। আর পিটিআই যদি পিএমএল-এনের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তবে যত যোগ্য প্রার্থীই তাদের দলে যোগ দিক না কেন, তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ভালো করতে পারবে না। তবে পিটিআইয়ের অবস্থা কী তা এখনো স্পষ্ট নয়।
পিএমএল-এন থেকে দলত্যাগের ঘটনা বেশ বড়। কিন্তু তবুও তা এত বড় নয় যে তা দলটির নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা হুমকির মুখে ফেলবে। তাছাড়া সরকারে থাকতে তাদের সাফল্য এবং এস্টাবলিশমেন্টের শিকার হওয়ার বিষয়টি উত্তর ও মধ্য পাঞ্জাবে তাদের সমর্থন বাড়িয়ে দিয়েছে।
একইভাবে, গত কয়েক মাসে পিটিআই বিপুলসংখ্যক নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে দলে ভেড়ালেও বিশেষ করে পাঞ্জাবে তাদের জয় এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা দূর করতে মাহাজের মতো গ্রুপ গঠন সহায়ক হয়নি। বরং একে আসন্ন নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অ-গণতান্ত্রিক শক্তির প্রয়াস বলেই মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া দক্ষিণ পাঞ্জাবে আরেকটি প্রদেশের দাবি ২০১৩ সালের নির্বাচনের সময়ও ওঠেছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ওই দাবি মিলিয়ে গিয়েছিল। সূত্র : ওয়েবসাইট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাকিস্তান


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ